ইমাম হোসাইন (আ.) ৫০ হিজরি থেকে ৬১ হিজরি পর্যন্ত ১১ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১০ বছর মুয়াবিয়ার শাসনামলে অতিবাহিত হয়। ঐ সময় ধরে তার সঙ্গে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল। এ দ্বন্দ্বের কতগুলো নমুনা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিভিন্ন চিঠিতে লক্ষ্য করা যায়। ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর চিঠিতে মুয়াবিয়ার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডগুলো (যেমন আল্লাহর রাসূলের সাহাবী আমর ইবনে হামেক ও হুজর ইবনে আদীকে হত্যা) তুলে ধরে মুসলমানদের ওপর মুয়াবিয়ার শাসনকে ‘বড় ফিতনা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।(আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০; ইবনে আব্দুল বার বলেন, ইসলামের ইতিহাসে একজন মানুষের মাথা কেটে অন্য স্থানে প্রেরণের ঘটনা মুয়াবিয়ার দ্বারা সংঘটিত হয় যখন সে সাহাবী আমর ইবনে হামেকের মাথা কেটে তার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। আল ইসতিয়াব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭৪) আর এভাবে ইমাম হোসাইন (আ.),মুয়াবিয়ার খেলাফতের বৈধতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে জিহাদ করাকে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল মনে করতেন। এছাড়া তিনি মনে করতেন,যদি কেউ তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই ইস্তিগফার করতে (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে) হবে।(ইবনে কুতাইবা দিনওয়ারী, আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০) কিন্তু এরপরও ইমাম হোসাইন (আ.) কেন মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি তার কতগুলো কারণ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বক্তব্যে পাওয়া যায়। যদি আমরা ঐ কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই,তাহলে আমাদেরকে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করতে হবে।
এক : মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তি
ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার যে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল,ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার কাছে দেয়া চিঠিতে সেই সন্ধিচুক্তির প্রতি তাঁর নিবেদিত থাকার কথা বলে তাঁর বিরুদ্ধে তা লঙ্ঘন করার যে অভিযোগ মুয়াবিয়া তুলেছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।(মাওসুআতু কালিমাতি ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ২৩৯) কিন্তু প্রশ্ন হলো,মুয়াবিয়া যেখানে কুফায় প্রবেশ করার পর সন্ধিচুক্তির কালি শুকানোর আগেই তা লঙ্ঘন করেছিল এবং তার প্রতি নিবেদিত থাকা তার জন্য আবশ্যক নয় বলে ঘোষণা দিয়েছিল(আল-ইরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩৫৫)সেখানে কেন ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি মেনে চললেন?
এ প্রশ্নের উত্তর কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া যেতে পারে :
ক. যদি আমরা মুয়াবিয়ার বক্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে,সে সুস্পষ্টভাবে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘনের কথা বলেনি। কারণ,সে বলেছিল : ‘আমি হাসানকে কতগুলো বিষয়ের ওয়াদা দিয়েছি।’ আর হতে পারে সে যে ওয়াদার কথা বলেছে তা সন্ধিচুক্তির বহির্ভূত কোন বিষয় ছিল যার প্রতি নিবেদিত থাকা মুয়াবিয়ার মতে আবশ্যক ছিল না। আর অন্তত এর ভিত্তিতে সে অজুহাত দেখাত যে,তার পক্ষ থেকে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘিত হয়নি।
খ. রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও ইমাম হোসাইন (আ.) এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ ছিল,ঠিক যে রকম তফাৎ ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার ছিল।
আসলে মুয়াবিয়া এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিল,যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে কোন অন্যায়-অবিচার,(মুয়াবিয়ার মনোনীত শাসক ও সেনাপতিরা কোনপ্রকার অন্যায় ও হত্যা করতে দ্বিধা করত না। তার গভর্নর বুশর ইবনে আরতাত ইয়েমেনে প্রবেশ করে অসংখ্য মুসলমান নারীকে বন্দি করে বাজারে বিক্রি করে (আল ইসতিয়াব, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪০, সংখ্যা ১৭৫) এবং একযুদ্ধে শিশু-বৃদ্ধসহ ত্রিশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে (আলগারাত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৩৯)। মুয়াবিয়ার মনোনীত গভর্নরদের দ্বারা সংঘটিত হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের বীভৎস ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। দ্রষ্টব্য: তারিখে তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৭৭-৮১, কামিল ফিত তারিখ, ইবনে আছির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬২-১৬৭ ও ৪৫০, তারিখে ইবনে আসাকির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২২২ ও ৪৫৯; আলইসতিয়াব, পৃ. ৬৫-৬৬; তারিখে ইবনে কাসির, ৭ম খণ্ড, ৩১৯-৩২২; ওয়াফাউল ওয়াফা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৯৬) প্রতারণা ও ছল-চাতুরির আশ্রয় নিত। এসব প্রতারণার কতক নমুনা ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়েও দেখা যায়। যেমন উসমানের রক্তকে বাহানা হিসেবে তুলে ধরা,তালহা এবং যুবায়েরকে ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা,সিফফিনের যুদ্ধে বর্শার মাথায় কুরআন শরীফ তুলে ধরা এবং ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন শহরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা।
অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক পবিত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন,যিনি স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সত্যের পরিপন্থী কোন পথে অগ্রসর হতেন না। যেভাবে ইমাম আলী (আ.) বলেছিলেন : ‘আমি জোর-জবরদস্তি করে বিজয়ী হতে চাই না।’(নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১২৬)
অতএব,এটা স্বাভাবিক যে,ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে যে চুক্তি করেছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) কোনক্রমেই তা লঙ্ঘন করতে পারেন না। এমনকি মুয়াবিয়া তা লঙ্ঘন করলেও ইমামের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।
গ. অবশ্যই আমাদেরকে ঐ সময়ের অবস্থা বিবেচনা করে দেখতে হবে। আর এটাও দেখতে হবে যে,ইমাম যদি সন্ধির খেলাফ কাজ করতেন তাহলে কী ঘটত? কারণ,ঐ সময় মুয়াবিয়া মুসলমানদের একচ্ছত্র খলীফা ছিল। আর তার শাসনব্যবস্থা সিরিয়া থেকে শুরু করে মিশর,ইরাক,আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেন তথা গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রতিটি এলাকাতে তার অনুচর ও দালালরা তার খেলাফতের বৈধতার পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতো। এহেন পরিস্থিতিতে ইমামের পক্ষে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না।
মুয়াবিয়া,হযরত আলী (আ.)-এর সাথে দ্বন্দ্বের সময় সিরিয়াবাসীদের কাছে নিজেকে উসমান দরদী এবং তাঁর খুনের একমাত্র দাবিদার (প্রতিশোধ গ্রহণকারী) হিসেবে তুলে ধরেছিল। যদিও উসমান হত্যার ঘটনায় সে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে কোন সাহায্যই করেনি।(তারীখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০২) অতএব,এটা সুস্পষ্ট যে,ঐ সময় কেউ তার সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস করত না। এ পরিস্থিতিতে যদি ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করতেন,তাহলে মুয়াবিয়া তাঁকে মুসলিম সমাজে চুক্তি লঙ্ঘনকারী ও বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত করাতো এবং উম্মাহর চিন্তাধারাকে তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করাতো। আর ঐ পরিস্থিতিতে ইমামের আহ্বান মুসলিম জাতির কাছে পৌঁছত না। ইমাম এবং তাঁর সাথিরা এ সময় মুয়াবিয়াকে প্রথম সন্ধি লঙ্ঘনকারী হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু তাঁরা এতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
দুই. মুয়াবিয়ার শক্তিশালী অবস্থান
ঐ সময় মুয়াবিয়ার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিশেষ করে সিরিয়াবাসীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটাকে কঠিন করে তুলেছিল। কারণ,সিরিয়াবাসী তাকে নবীর সাহাবা,ওহী লেখক এবং ‘মুসলমানদের মামা’ মনে করত। তাদের দৃষ্টিতে,সিরিয়া ও দামেশকে ইসলাম প্রচারে মুয়াবিয়ার ভূমিকাই ছিল মূখ্য।
এছাড়া মুয়াবিয়া একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ ছিল। আর তার বয়সও ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.) থেকে বেশি ছিল। এজন্য সে সবসময় ইমামদের কাছে দেয়া চিঠিতে এ দুটি বিষয় উল্লেখ করত এবং নিজেকে খেলাফতের জন্য বেশি উপযুক্ত মনে করত।(আবুল ফারাজ ইসফাহানী, মাকাতিলুত তালিবীয়ীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০। যেমন সে ইমাম হাসানকে একটি পত্রে লিখে : ...তুমি অবশ্যই জান যে, আমি দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব করছি। এ ক্ষেত্রে তোমার থেকে আমি অভিজ্ঞ এবং বয়সেও তোমার চেয়ে বড়।... তাই আমার আনুগত্যের ছায়ায় প্রবেশ কর) অতএব,এটা স্বাভাবিক যে,ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধি লঙ্ঘন করলে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগত।
তিন. মুয়বিয়ার রাজনৈতিক কূটচাল ও ধূর্ততা
সন্ধির পর যদিও মুয়াবিয়া বনি হাশেম,বিশেষ করে ইমাম আলী (আ.)-এর পরিবারকে কোণঠাসা করার জন্য সকল প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল,এমনকি বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান (আ.)-কে শহীদ করেছিল,(মাকাতিলুত তালিবীয়ীন, পৃ. ১ম খণ্ড, পৃ. ৮০; আল-ইরশাদ, পৃ. ৩৫৭) কিন্তু সে বাহ্যত মানুষদের দেখাত যে,নবী-বংশের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে,মুয়াবিয়া প্রতি বছর এবং প্রতি মাসে ইমাম হাসান (আ.),ইমাম হোসাইন (আ.) এবং আবদুল্লাহ বিন জাফরের জন্য প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন পাঠাত। আর তারাও যেহেতু নিজেদেরকে বায়তুল মালের হকদার মনে করতেন তাই ঐসব উপঢৌকন গ্রহণ করতেন এবং উপযুক্ত জায়গায় সেগুলো খরচ করতেন।(মাওসুআতু কালিমাতিল ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ২০৯ ও ২১০)
মুয়াবিয়া নিজেকে নবীর পরিবারের ভক্ত হিসেবে দেখানোর জন্য মৃত্যুর সময়ে স্বীয় পুত্র ইয়াযীদকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে অসিয়ত করেছিল যে,যদি ইমাম আন্দোলন করেন তাহলে যেন তাঁকে হত্যা করা না হয়।(আল-আখবারুত তোয়াল, পৃ. ২২৭; তাজারিবুল উমাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯)
মুয়াবিয়ার এ রকম রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট। কারণ,সে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সন্ধি করে নিজের খেলাফতকে বৈধতা না থাকার সংকট থেকে মুক্তি দান করে এবং মানুষের মাঝে নিজেকে বৈধ খলীফা হিসেবে পরিচিত করায়। আর সে চাইত না যে,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করার মাধ্যমে সে মুসলিম সমাজে ঘৃণিত হোক। এর বিপরীতে সে চেষ্টা করত যে,নবীপরিবারের প্রতি লোকদেখানো ভালোবাসা প্রদর্শন করার মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে নিজের সুনাম বজায় রাখা।
আর সে ভাবত যে,এভাবে সে নবীর বংশধরদের নিজের প্রতি ঋণী করছে। ফলে তারা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে তার অনুগত হয়ে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকবে। একবার সে ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে বিপুল পরিমাণে উপঢৌকন পাঠিয়ে খোঁটা দিয়ে বলেছিল,‘এ উপহারগুলো গ্রহণ কর,আর জেনে রাখ যে,আমি হিন্দার ছেলে। খোদার শপথ,এর আগে কেউ তোমাদেরকে এ রকমভাবে দান করেনি। আর আমার পরেও কেউ তোমাদেরকে এভাবে দান করবে না।’
ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়াকে দেয়া চিঠিতে তার উপঢৌকনগুলো যে করুণা প্রদর্শনের যোগ্যতা রাখে না তা উল্লেখ করে বলেছেন : ‘খোদার শপথ,তোমার আগের এবং পরের কোন লোকের পক্ষে আমাদের থেকে
শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত কোন ব্যক্তির কাছে উপহার পাঠানো সম্ভব নয় (কেননা,নবুওয়াতের গৃহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন গৃহ নেই)।’(তারীখে ইবনে আসাকির, তারজুমাতুল ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ৭, পাদটীকা ৫)
মুয়াবিয়া জানত যে,সে যদি কঠোর নীতি গ্রহণ করে,তাহলে পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যাবে। পরিশেষে মানুষ মুয়াবিয়ার শাসনের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠবে। আর স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম সমাজ আহলে বাইতের পাশে একত্র হবে।
ঐ সময়ে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ থেকে বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করত না। কিন্তু ভবিষ্যতে যেহেতু নবী-পরিবারের পক্ষ থেকে কোন বিপদ না আসতে পারে এজন্য এ রকম কলা-কৌশল অবলম্বন করে চলত যাতে অঙ্কুরেই বিপদের বীজ বিনাশ হয়ে যায়।
অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার খেলাফতকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলার জন্য প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাতেন। এর সুস্পষ্ট নমুনা হলো মুয়াবিয়াকে লেখা চিঠিতে মুয়াবিয়ার সৃষ্ট বেদআত ও তার কৃত অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা(বিহারুল আনওয়ার, ৪৪ তম খণ্ড, পৃ. ২১২) এবং যুবরাজ হিসেবে ইয়াযীদের মনোনয়নের বিরোধিতা করা।(তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮; আল-ইমামাত ওয়াস সিয়াসাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৬) অবশ্য ইমাম হোসাইন (আ.) ভালো করেই জানতেন যে,যদি তিনি মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন,তাহলে সাধারণ মানুষ মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক কলা- কৌশলের কারণে তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিবে না। উপরন্তু সরকারি অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে মুয়াবিয়াকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করবে।
চার. তৎকালীন সময়ের মুসলমানদের চিন্তাগত ও সামাজিক অবস্থা
যদিও একদল কুফাবাসী ইমাম হাসান (আ.) শহীদ হওয়ার পর সমবেদনা জ্ঞাপন করে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে চিঠি লিখেছিল এবং নিজেদেরকে ইমামের নির্দেশের অপেক্ষাকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল(তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮),কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ভালোভাবেই জানতেন যে,সিরিয়ায় মুয়াবিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কুফা শহরও উমাইয়া গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছে। এছাড়া কুফাবাসী ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে অনেকবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। যখন সমগ্র ইসলামী ভূখণ্ডের ওপর মুয়াবিয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি বহাল হয়েছে তখন যদি তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তাহলে পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু ঘটবে না। আর যে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য তাঁর সাথে রয়েছে তারাও অযথা নিহত হবে এবং তিনি বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত হবেন। পরিশেষে তিনি কোন ফলাফল ছাড়াই শহীদ হবেন এবং তাঁর রক্ত বৃথা যাবে। কিন্তু ইয়াযীদের শাসনামলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ এর বিপরীত ছিল।
(এ প্রবন্ধটি ‘আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)