بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
আল্লাহ্ রাব্বুল্ ‘আালামীন্ হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন :
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ (١) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (٢) إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الأبْتَرُ
“(হে রাসূল!) অবশ্যই আমি আপনাকে কাওছার দিয়েছি। সুতরাং আপনি আপনার রবের উদ্দেশে (শুকরিয়া স্বরূপ) নামায আদায় করুন ও পশু যবেহ্ করুন। নিঃসন্দেহে আপনার দুশমনই হচ্ছে আবতার।” (সূরাহ্ আল্-কাওছার : ১-৩)
সূরাহ্ আল্-কাওছার-এর শা’নে নুযূল্ সম্পর্কে উম্মাহর মধ্যে মতৈক্য রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জীবিত পুত্রসন্তান না থাকায় তাঁর দুশমনরা তাঁকে “আবতার” বলে উপহাস করতো। “আবতার”-এর আভিধানিক অর্থ ‘লেজকাটা’, আর পারিভাষিক অর্থ ‘নির্বংশ’। পশুদের লেজ যেহেতু তাদের পিছনে থাকে সেহেতু মানুষের নিজদের পরে বা পিছনে তাদের সন্তান-সন্ততি ও ক্রমান্বয়ে অধঃস্তন বংশধরদের আগমন ঘটতে থাকে বিধায় উপমাস্বরূপ বংশধরকে মানুষের জন্য লেজতুল্য গণ্য করা হয়।
অবশ্য সাধারণ রেওয়াজ অনুযায়ী তৎকালে আরবদের মধ্যে কেবল পুত্রসন্তান ও তাদের অধঃস্তন পুরুষ বংশধরদেরকেই বংশধর বলে গণ্য করা হতো। তাই কন্যাসন্তান থাকা ও না থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হতো না। এ কারণেই যে ব্যক্তির পুত্রসন্তান থাকতো না তাকে ‘নির্বংশ’ অর্থে লেজবিহীন পশুর সাথে তুলনা করে “আবতার” বলা হতো। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কে এ সূরাহ্ নাযিল করে জানিয়ে দেন যে, তিনি নির্বংশ তো ননই, বরং তাঁর কন্যাসন্তান হযরত ফাতেমা (সালামুল্লাহি ‘আলাইহা) এমন এক কন্যাসন্তান যার মাধ্যমে নবী করীম (ছ্বাঃ) বিপুল সংখ্যক বংশধরের অধিকারী হবেন।
অনেকের মতে অবশ্য এখানে “কাওছার” বলতে বেহেশতে নবী করীম (ছ্বাঃ) কে যে হাউযে কাওছার দেয়া হবে তা-ই বুঝানো হয়েছে। অবশ্য আলোচ্য সূরায় “কাওছার” শব্দের তাৎপর্যে এ-ও শামিল থাকতে পারে। কিন্তু এটা মূল উদ্দেশ্য হতে পারে না। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগত বান্দাহরা বেহেশতে সীমাহীন ও অকল্পনীয় নে‘আমতের অধিকারী হবেন এ তো তাঁদের জানা কথা। এটা যাদের বংশধর আছে বা নেই তাঁদের সকলের জন্যই সত্য। এমতাবস্থায় হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর দুশমনরা যে তাঁকে “আবতার” বলে উপহাস করতো তার জবাব এটা হতে পারে না। বরং তাদের জবাব এটাই হতে পারে যে, তিনি জীবিত পুত্রসন্তানের অধিকারী না হলেও তাঁকে এমন এক কন্যাসন্তান দেয়া হয়েছে কোনো পুত্রসন্তানও যার সমকক্ষ হতে পারে না - যার মাধ্যমে তাঁকে অন্য যে কোনো মানুষের তুলনায় সবচেয়ে বেশী বংশধর দেয়া হবে।
এছাড়া শুকরিয়া স্বরূপ পশু যবেহ্ করে তথা ‘আক্বীক্বাহ্ করে সকলকে নিয়ে আনন্দ-উৎসব করা কেবল সন্তানরূপ পার্থিব জীবনের নে‘আমতের জন্যই সর্বাধিক মানানসই। কারণ, এ আনন্দ-উৎসবের সঙ্গত কারণ বন্ধু-দুশমন নির্বিশেষে সকলের কাছে সুস্পষ্ট থাকে এবং তাতে কারোই সন্দেহ থাকে না। তার বিপরীতে লক্ষ লক্ষ বছর পরে বা হয়তো আরো বেশী পরে পরকালীন জীবনে যে নে‘আমত পাওয়া যাবে সে জন্য এভাবে আনন্দ-উৎসব করা হলে তা অন্ততঃ দুশমনদের কাছে অর্থবহ বলে মনে হবে না। তাই এটা তাদের উপহাসের জবাব হতে পারে না। কিন্তু এই কন্যাসন্তান যে এক ব্যতিক্রমী কন্যাসন্তান - যার বংশধরগণ সংখ্যায় ও গুণে সর্বশীর্ষে থাকবেন এমন সম্ভাবনাকে দুশমনদের পক্ষে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মানুষ সাধারণভাবে পুত্রসন্তানকে কন্যাসন্তানের ওপর অগ্রাধিকার দিলেও কোনো কোনো কন্যাসন্তান যে এমন ব্যতিক্রমী হতে পারেন যার সাথে কোনো পুত্রসন্তানই তুলনীয় হতে পারে না - এ কথা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাই কোরআন মজীদে জানিয়ে দিয়েছেন। এরশাদ করেন :
فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنْثَى وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالأنْثَى
“অতঃপর সে (‘ইমরানের স্ত্রী) যখন তাকে (মারইয়ামকে) প্রসব করলো (এবং দেখলো যে, তার প্রত্যাশিত পুত্রসন্তান হয় নি) তখন বললো : “হে আমার রব! অবশ্যই আমি কন্যাসন্তান প্রসব করেছি।” আল্লাহ্ তো জানেনই যে, সে কী প্রসব করেছে, কিন্তু কোনো পুত্রসন্তানই এ কন্যাসন্তানের সমতুল্য নয়।” (সূরাহ্ আালে ‘ইমরান্ : ৩৬)
হযরত ফাতেমা (সালামুল্লাহি ‘আলাইহা)-ও অনুরূপ - কোনো পুত্রসন্তানই যার সমকক্ষ নয়। কারণ, তিনি হচ্ছেন বংশধরের প্রশ্নে সংখ্যাগত ও গুণগত উভয় বিচারে প্রভূত আধিক্যের উৎস।
প্রকৃত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁর বন্ধু-দুশমন নির্বিশেষে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর যুগের বিশ্বের কোনো মানুষেরই বংশধররা সংখ্যা ও গুণের বিচারে এতো আধিক্যের অধিকারী হয় নি। বিশেষ করে তাঁর বংশে যুগে যুগে এতো বেশী ও এতো উঁচু মানের জ্ঞানী-গুণীর আবির্ভাব ঘটেছে এবং এখনো আছে যে, অন্য কারো বংশধররা এর ধারেকাছেও পৌঁছতে পারে নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ্ যে এরশাদ করেছেন : إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الأبْتَرُ - “নিঃসন্দেহে আপনার দুশমনই হচ্ছে আবতার (নির্বংশ)।” এখানে কোন্ দুশমনের কথা বলা হয়েছে? কোনো বিশেষ দুশমনের কথা, নাকি সকল দুশমনের কথা?
شَانِئَكَ (আপনার দুশমন) কথাটি যেমন বিশেষ কোনো দুশমনকে বুঝাতে পারে তেমনি নিঃশর্তভাবে বা সাধারণভাবে ‘দুশমন’কে অর্থাৎ সকল দুশমনকে বুঝাতে পারে। আর সাধারণ বিশেষ্যের (اسم ذات) বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা শব্দগত দিক থেকে একবচন হলেও তার তাৎপর্যে ঐ শব্দটি যাদের বেলায় প্রযোজ্য তাদের সকলকে শামিল করে।
তবে এখানে বিশেষ কোনো ব্যক্তি-দুশমনকে বুঝানো হয়েছে বলে গণ্য করা চলে না। কারণ, এর আগে এমন কোনো ব্যক্তির কথা সুনির্দিষ্টভাবে বুঝানো হয় নি। সুতরাং এতে নিরঙ্কুশভাবে তাঁর দুশমনকে বুঝানো হয়েছে। এছাড়া নবী করীম (ছ্বাঃ) কে ‘আবতার’ হিসেবে অভিহিত করার কাজটি প্রথমে কোনো এক ব্যক্তি করলেও নিঃসন্দেহে পরে আর তা ঐ এক ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি, বরং তাঁর শত্রুরা সকলেই তাঁকে উপহাস করার জন্য সাধারণভাবে এটি ব্যবহার করতো, নচেৎ আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে বিষয়টি গুরুত্ব পাবার কথা নয়। সুতরাং এর শাস্তি কেবল ঐ খারাপ উপাধি প্রদানকারীর একার প্রাপ্য ছিলো না, বরং এর ব্যবহারকারীদের সকলেরই প্রাপ্য ছিলো।
অবশ্য এখানে একটি কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তা হচ্ছে ক্ষেত্রবিশেষে এমনও হতে পারে যে, কোনো ব্যক্তি ইখলাছ্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বুঝতে না পেরে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাময়িকভাবে দুশমনী করতে পারে এবং পরে ভুল বুঝতে পেরে দুশমনী থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারে; এহেন দুশমন এ আয়াতের বক্তব্যে শামিল হবে না এটাই স্বাভাবিক। বরং এর লক্ষ্য হচ্ছে এমন দুশমন যারা জেনেবুঝে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে দুশমনী করেছে। অবশ্য অনেক সময় দুশমন পরাজিত ও ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাহ্যতঃ দুশমনী পরিত্যাগ করতে পারে এবং বাহ্যতঃ বন্ধুও সাজতে পারে, কিন্তু অন্তরে দুশমনী পোষণ অব্যাহত রাখতে পারে এবং তা চরিতার্থ করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে পারে। এ ধরনের দুশমন বাহ্যতঃ বন্ধু হলেও অবশ্যই এ আয়াতের তাৎপর্যে শামিল রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এরা কা’রা ছিলো?
এদেরকে চিহ্নিত করার জন্য অনেক বেশী চিন্তা-গবেষণার প্রয়োজন নেই। বরং এ জন্য কেবল এটা দেখাই যথেষ্ট যে, হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর দুশমনদের মধ্যে কোন্ দুশমনরা পুরোপুরি নির্বংশ হয়ে গিয়েছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, একমাত্র বানী উমাইয়াহ্ হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিরুদ্ধে স্থায়ীভাবে দুশমনী করেছে এবং তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর আহলে বাইত্ (‘আঃ)-এর বিরুদ্ধে পুরুষানুক্রমে দুশমনী অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে ইতিহাসের একটা পর্যায়ে এসে বানী উমাইয়াহ্ ধরণীর বুক থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাদের এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকেই প্রমাণিত হয় যে, আলোচ্য আয়াতে তাদের কথাই বলা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভ করার পর থেকে মক্কাহ্ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত কতক একান্ত বিরল ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে বানী উমাইয়াহর লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে নি, বরং তাঁর বিরুদ্ধে দুশমনী অব্যাহত রাখে। এরপর মক্কাহ্ বিজয়ের সময় তারা নিরূপায় হয়ে জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নেফাক্বের আশ্রয় নিয়ে বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু তারা তাদের অন্তরে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর প্রতি দুশমনী অব্যাহত রাখে।
তারা যে, মক্কাহ্ বিজয়ের দিনে জীবন বাঁচানোর জন্য নেফাক্ব সহকারে ঈমানের ঘোষণা দেবে আল্লাহ্ তা‘আলা সে সম্বন্ধে আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং জানিয়ে দেন যে, তখন তাদের সে ঈমান কবূল হবে না। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
وَيَقُولُونَ مَتَى هَذَا الْفَتْحُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ. قُلْ يَوْمَ الْفَتْحِ لا يَنْفَعُ الَّذِينَ كَفَرُوا إِيمَانُهُمْ
“আর তারা বলে : এ বিজয় কখন (আসবে) যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো? (হে রাসূল!) বলুন, বিজয়ের দিনে কাফেরদের ঈমান তাদেরকে কোনো কল্যাণ দেবে না।” (সূরাহ্ আস্-সাজদাহ্ : ২৯)
এ থেকে সুস্পষ্ট যে, কতক একান্ত বিরল ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে বানী উমাইয়াহ্ পুরুষানুক্রমে সব সময়ই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও তাঁর আহলে বাইত্ তথা আালে মুহাম্মাদ্ (ছ্বাঃ)-এর বিরুদ্ধে দুশমনী অব্যাহত রাখে এবং এক সময় তারা ধরণীর বুকে আর কোনো বংশধর রাখতে না পেরে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
[কেউ কেউ উপরোক্ত আয়াতের يَوْمَ الْفَتْحِ-এর অর্থ ‘ফয়ছ্বালার দিন’ অর্থাৎ ‘শেষ বিচারের দিন’ করার চেষ্টা করেছেন। তা যে ঠিক নয় সে সম্পর্কে ‘কোরআনের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী ও রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগের মুনাফিক্ব্’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।]
(লিখেছেন : নূর হোসেন মজিদী)