বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আল কোরআনের অলৌকিকতাঃ মানব সৃষ্টি
  • শিরোনাম: বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আল কোরআনের অলৌকিকতাঃ মানব সৃষ্টি
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 18:16:31 1-9-1403

মানব শিশুর জন্ম

 

মানুষকে বিশ্বাসের পথে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে কোরআনে বহু বৈচিত্রময় বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। কখনো বা আকাশ, কখনো প্রাণী জগৎ, কখনো বা উদ্ভিদসমূহকে আল্লাহ মানুষের জন্য সাক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেক আয়াতে মানুষকে আহ্বান জানানো হয়েছে নিজেদের সৃষ্টি সম্পর্কে মনোযোগী হতে। প্রায়ই মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সে কিভাবে এ পৃথিবীতে আসল, কি কি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে সে এলো, তার মৌলিক স্বভাব কি ?

 

আমিই তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তবে তোমরা কেন বিশ্বাস করছ না ? তোমরা কি ভেবে দেখেছ তোমাদের বীর্যপাত সম্পর্কে ? তোমরা কি তা সৃষ্টি কর, না আমি তার স্রষ্টা ? (কোরআন, ৫৬ : ৫৭-৫৯)

বহু আয়াতে মানুষের জন্ম আর জন্মের অলৌকিক অংশগুলোর উপর জোর দেয়া হয়েছে। এই আয়াতগুলোয় কিছু কিছু বিষয়ের তথ্যাদি এত পুংখানুপুংখ যে, সপ্তম শতাব্দীতে বিদ্যমান কোন লোকের পক্ষে জানা অসম্ভব ছিল । এদের কিছু কিছু নিম্নরূপ :

১. সম্পূর্ণ বীর্য থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়নি, এর অত্যন্ত ক্ষুদ্রাংশ থেকে তা সৃষ্টি হয়েছে (শুক্রাণু)।

২. পুরুষ থেকেই শিশুর লিংগ নির্ধারিত হয়।

৩. মানুষের ভ্রুণ জরায়ুর গায়ে জোঁকের মত লেগে থাকে।

৪. মানব শিশু জরায়ুতে তিনটি অন্ধকার অঞ্চলে বেড়ে উঠে।

কোরআন যে সময়ে নাযিল হয়েছে, সে সময়ের মানুষেরা জানতো যে, যৌনমিলনের সময় বের হয়ে আসা বীর্যের সঙ্গে মানব জন্মের মৌলিক বিষয়টির সম্পর্ক রয়েছে। আর নয় মাস সময়সীমা পরে বাচ্চা জন্ম গ্রহন করে যা স্পষ্টভাবেই দৃষ্টিগ্রাহ্য একটি বিষয় ছিল; এটিকে আরো ঘাটিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল না। যাই হোক এই আয়াতগুলোয় বর্ণিত বিষয়গুলো সে সময়ের মানুষের জানার পরিধি থেকে আরো অধিক দূরের ব্যাপার ছিল । যা বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান কর্তৃক সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এখন চলুন একের পর এক বিষয়গুলোয় যাই।

একবিন্দু বীর্য

যৌন মিলনের সময় পুরুষের দেহ থেকে প্রতিবারে ২৫০ মিলিয়ন শুক্রকীট বের হয়ে আসে। মায়ের দেহে শুক্রকীট একটি দুরারূহ যাত্রা চালায় ডিম্বাণুতে পৌছা পর্যন্ত । ২৫০ মিলিয়নের মাঝে কেবলমাত্র এক হাজারটি শুক্রাণু ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌছুতে সফল হয়ে থাকে। এই পাঁচ মিনিটের দৌড় শেষে একটি লবণের দানার অর্ধেক আকারের একটি ডিম্বাণু কেবলি একটি শুক্রাণুকে তার ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। তাই মানুষের জন্মের সারংশ পুরু বীর্য নয়, বরং এটি তার একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। কোরআনে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে :

মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি বেহিসাব ছেড়ে দেয়া হবে? সে কি একবিন্দু শুক্র ছিলনা, যা মাতৃগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়েছিল ? (কোরআন, ৭৫ : ৩৬-৩৭)

আমরা দেখেছি যে, মানুষ সবটুকু বীর্য থেকে নয় বরং এর অতি অল্প অংশ থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এই উক্তিটি এমন একটি বিষয়ের ঘোষণা করছে যা কেবলি আধুনিক বিজ্ঞান কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছে । তাই এই উক্তিটি যে স্বর্গীয় এটি তারই প্রমাণ।

বীযের্র মিশ্রণ

বীর্য নামক তরল পদার্থটি শুধুমাত্র শুক্রাণু নিয়েই গঠিত নয়। বিপরীতক্রমে এটি আসলে বিভিন্ন তরল পদার্থের মিশ্রণ। এই তরল পদার্থটির বিভিন্ন কাজ রয়েছে। যেমন, এতে শুক্রকীটের শক্তি সরবরাহের জন্য শর্করা থাকে, জরায়ুতে শুক্রের প্রবেশ পথের এসিড নিষ্ক্রিয় করে থাকে এই তরল পদার্থটি, আর শুক্রকীটটির সহজ গতিবিধির জন্য একটি পি‪চ্ছিল পরিবেশ বজায় রাখে।

যথেষ্ট কৌতূহলের বিষয় হলো যে, কোরআনে এই বীর্যের কথা উল্লেখিত আছে আর এটিকে তরল পদার্থের মিশ্রণ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান কেবল সেদিন এটি আবিষ্কার করলঃ

আমিতো মানুষকে মিশ্র শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি তাকে পরীক্ষা করার জন্য; এ কারণে আমি তাকে করেছি শ্রবণশক্তি সম্পন্ন ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন। (কোরআন, ৭৬ : ২)

অন্য একটি আয়াতে বীর্যকে আবার মিশ্র তরল পদার্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আর মানুষকে যে এই তরলের নির্যাস থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেটি জোর দিয়ে বলা হয়েছে।

যিনি অত্যন্ত সুন্দররূপে তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সৃজন করেছেন এবং মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি দিয়ে, তারপর তার বংশধরকে সৃষ্টি করেন নগণ্য পানির নির্যাস থেকে। (কোরআন, ৩২ : ৭৮)

আরবী শব্দ “সুলালার” অনুবাদ করা হয়েছে নির্যাস হিসেবে, যার মানে হলো কোন কিছুর দরকারী অথবা উত্তম অংশ হিসেবে। ব্যঞ্জণার্থেও এর অর্থ একটি অখণ্ড জিনিষের একটি অংশ। এটি দেখিয়ে দেয় যে, কোরআন এক মহাশক্তির কথা যিনি মানুষের সৃষ্টির প্রতিটি অণু পরমাণু অংশ জানেন। আর এই মহাশক্তিশালীই হলেন আল্লাহ, মানুষের সৃষ্টিকর্তা।

শিশুর লিঙ্গ

এইতো সেদিন পর্যন্ত ধারণা করা হতো যে, মাতৃকোষ দিয়ে বাচ্চার লিঙ্গ নির্ণয় হয়ে থাকে। অথবা এটুকু অন্তত বিশ্বাস করা হতো যে বাবামা উভয়ের কোষ দিয়ে বাচ্চার লিঙ্গ নির্ণিত হয়। অথচ পবিত্র কোরআন আমাদের ভিন্ন তথ্য দিয়ে থাকে যা বলে যে, “নির্গত শুক্রবিন্দু থেকে” মেয়ে বা ছেলে লিঙ্গ নির্ণিত হয়।

আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন জোড়া নর ও নারী শুক্রবিন্দু থেকে যখন তা গর্ভপাত করা হয়। (কোরআন, ৫ : ৪৫-৪৬)

ক্রমে উন্নত জেনেটিকস আর মলিকিউলার বায়োলজীর শাখা কোরআনে প্রদত্ত এই তথ্যটি সত্য বলে প্রমাণ করেছে। এখন বুঝা গেছে যে, পুরুষের শুক্রকীট থেকেই লিঙ্গ নির্ণিত হয় আর এ প্রক্রিয়ায় নারীর কোন ভূমিকা নেই। লিঙ্গ নির্ধারণের ব্যাপারে ক্রোমোজোমই প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। সনাক্ত করা গেছে যে ৪৬টি ক্রোমোজমের মাঝে দুইটি মানুষের গঠন প্রকৃতি নির্ণয় করে আর এগুলোকে বলে সেক্স ক্রোমোজোম। পুরুষে এ দুটি ক্রোমোজোম হলো “XY” আর নারীতে এ দুটি “XX”। কেননা এ দুটি ক্রোমোজোমের আকৃতি এ দুটি অক্ষরের মতোই। Y ক্রোমোজোমে বিদ্যমান জীনগুলো পুরুষালী ভাবের কোড বা সংকেত বহন করে আর X ক্রোমোজোম স্ত্রীসুলভ ভাবের কোড বহন করে থাকে।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে, “নির্গত এক বিন্দু শুক্রের উপর” পুরুষত্ব বা নারীত্ব বিষয়টি নির্ভর করে। যাই হোক মোটামুটিভাবে সাম্প্রতিক কালেও বিশ্বাস করা হতো যে, মাতৃকোষ হতেই শিশুর লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। কোরআনে প্রদত্ত এই তথ্যটি বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান উদঘাটন করেছে। মানুষের জন্ম সম্বন্ধে এটি এবং বহু তথ্যাদি শতাব্দী পূর্বে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।

Y ক্রোমোজোম পুরুষালী বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ করে থাকে আর X ক্রোমোজোমে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। মায়ের ডিম্বাণূতে থাকে শুধু X ক্রোমোজোম যা নারীর স্বভাব নির্ণয় করে। পিতার বীর্যে শুক্রাণুতে থাকে হয় X ক্রোমোজোম অথবা Y ক্রোমোজোম। সুতরাং বাচ্চার লিংগ নির্ভর করে-পিতার শুক্রাণুর X অথবা Y ক্রোমোজোম ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে কিনা তার উপর। অন্য কথায় আয়াতটিতে বলা হয়েছে ঠিক তেমনি বা‪চ্চার লিংগ নির্ধারণকারী উপাদান আসে পুরুষ থেকে নির্গত বীর্য থেকে। এই জ্ঞানটি কোরআন নাযিল হওয়ার সময়ে মানুষের জানা ছিল না যা কিনা প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহরই কথা।

এ ক্রোমোজোমদ্বয়ের যে কোন একটির ক্রস কম্বাইনেশনের মাধ্যমে নুতন এক মানব সন্তানের জন্মের সূত্রপাত ঘটে আর এ ক্রোমোজোমগুলো পুরুষ আর নারীতে জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে। অভ্যূলেশনের (ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হওয়ার সময়) সময় নারীর সেক্স কোষের দুটি অংশ দুটিভাগে বিভক্ত হয়, এদুটি অংশই X ক্রোমোজোম বহন করে থাকে। অন্যদিকে পুরুষের সেক্স কোষ দু ধরণের শুক্রকীট বা স্পার্ম তৈরী করে, এদের একটিতে থাকে X ক্রোমোজোম আর অন্যটিতে Y ক্রোমোজোম। যখন নারীর X ক্রোমোজোম পুরুষের Y ক্রোমোজোমের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বাচ্চাটি হবে মেয়ে। আর যদি তা পুরুষের শুক্রাণুর Y ক্রেমোজোমের সঙ্গে মিলিত হয় তবে বাচ্চাটি হবে ছেলে।

অন্য কথায় পুরুষের যে ক্রোমোজোমটি নারীর ডিম্বাণুর ক্রোমোজোমের সঙ্গে মিলিত হয় সেটির উপরই নিভর্র করছে বাচ্চার সেক্স বা লিঙ্গ।

বিংশ শতাব্দীতে জেনেটিক্স আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এই তথ্যগুলো জানা সম্ভব ছিল না। বাস্তবে বহু সংস্কৃতিতেই বিশ্বাস ছিল যে, বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারিত হয় নারীর দেহ দ্বারা। আর সেজন্যেই কন্যা সন্তান জন্ম নিলে নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করা হত।

মানুষের জীন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে তেরোশত বছর পূর্বে কোরআন তথ্য দিয়েছিল যা অন্ধ বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে এবং লিংগ নির্ণয়ে পুরুষের ভূমিকার কথা বলে।

জরায়ুতে আটকে থাকা রক্তপিন্ড

মানব শিশুর জন্ম সম্পর্কে কোরআনে ঘোষিত তথ্যাদিসমূহ যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করে যেতে থাকি তবে আমরা অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অলৌকিক ঘটনাসমূহের সম্মুখীন হব।

পুরুষের শুক্রকীট যখন মহিলার ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হয় তখন জন্ম নেয়া শিশুর মৌলিক অংশ গঠিত হয়ে যায়। জীববিদ্যায় “জাইগোট” নামের একটি কোষ তৎক্ষণাৎ বিভাজনের মাধ্যমে পুণরুৎপাদন শুরু করে দেয় আর ফলে তা ভ্রুণ নামক একটি “মাংসল পিন্ডে” পরিণত হয়। অবশ্য এটি মানুষ কেবল মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে দেখতে পারে।

যাই হোক এই ভ্রুণ পূর্ণতা লাভ করার সময় জরায়ুতে কেবলি শূণ্যে সময় কাটায় না। শেকড় যেমন এর আঁকশির মাধ্যমে মাটিতে শক্তভাবে গেঁথে থাকে, ভ্রুণও তেমনি জরায়ুর গায়ে শক্ত হয়ে লেগে থাকে। এ বন্ধনের মাধ্যমে ভ্রুণ তার বৃদ্ধির জন্য মায়ের দেহ থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে থাকে।

এ বিষয়ে কোরআনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অলৌকিক বিষয় প্রকাশিত আছে। মাতৃগর্ভে ভ্রুণের পূর্ণতা লাভের ব্যাপারটি উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা “আলাক্ব” শব্দটি ব্যবহার করেছেন :

পাঠ করুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত (আলাক্ব) থেকে, পাঠ করুন, আর আপনার রব অতিশয় দয়ালু । (কোরআন, ৯৬ : ১৩)

আরবী ভাষায় “আলাক্ব” শব্দের অর্থ এমন “একটি জিনিষ যা কোন জায়গায় আটকে থাকে।” আক্ষরিক অর্থে একটি জোঁকের বর্ণনা দেয়া যায় যা কোন দেহে লেগে থেকে তার রক্ত শোষণ করে।

জরায়ুতে প্রথম পূর্ণতা লাভের সময় বাচ্চা জাইগোট আকারে মায়ের জরায়ুতে লেগে থাকে যেন মায়ের রক্ত থেকে পুষ্টি পেতে পারে। উপরের চিত্রটি একটি জাইগোটের, যা দেখতে একটি মাংসপিন্ডের ন্যায়। আধুনিক ভ্রুণবিদ্যা এই গঠনটি আবিষ্কার করতে পেরেছে যা কিনা পবিত্র কোরআনে ১৪০০ বছর আগেই অলৌকিকভাবে “আলাক্ব” শব্দটি দ্বারা উল্লেখিত হয়েছিল যার অর্থ “এমন একটি জিনিষ যা কোন জায়গা আকড়ে পড়ে থাকে” । আর এ শব্দটি দ্বারা জোঁকের বর্ণনা দেয়া হয়েছে যা রক্ত শোষণের জন্য দেহকে আটকে ধরে থাকে।

নিশ্চিতভাবেই মাতৃগর্ভে ভ্রুণের বৃদ্ধির বেলায় এমন একটি সঠিক শব্দের ব্যবহার আরো একবার প্রমাণ করে যে, কোরআন সারা জাহানের মালিক আল্লাহ কর্তৃক নাযিল হয়েছে।

মাংস অস্তিকে জড়িয়ে আবৃত করে রাখে

কোরআনের আয়াতে প্রেরিত তথ্যাদির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মাতৃগহ্বরে মানব শিশুর বৃদ্ধির পর্যায়গুলোর বর্ণনা। সে আয়াতসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জরায়ুতে অস্তিসমূহ প্রথম তৈরী হয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় আর তারপর মাংসপেশী সৃষ্ট হয়ে সেগুলোকে জড়িয়ে ঢেকে দেয়।

এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি এমন ‘আলাক্বে’ যা লেগে থাকে, এরপর সে আলাক্বকে পরিণত করি পিন্ডতে, তারপর সেই পিন্ড থেকে সৃষ্টি করি অস্তি, পরে অস্তিকে ঢেকে দেই-গোশ্ত দিয়ে, তারপর তাকে গড়ে তুলি এক নূতন সৃষ্টিরূপে। সুতরাং কত মহান কল্যাণময় আল্লাহ যিনি সর্বোত্তম স্রষ্টা। (কোরআন, ২৩ : ১৪)

বিজ্ঞানের একটি শাখা ভ্রুণবিজ্ঞান মাতৃগর্ভে ভ্রুণের বৃদ্ধি নিয়ে পর্যালোচনা করে । অতি সাম্প্রতিককালের ভ্রুণতত্ত্ববিদগণের ধারণা ছিল যে, মাংস আর অস্তি ভ্রুণ থেকে একই সময়ে সৃষ্ট হয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এ কারণে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কিছু কিছু লোক দাবি করতে থাকে যে, বিজ্ঞানের সঙ্গে এ আয়াতগুলোর বিরোধ রয়েছে। নুতন প্রযূক্তির গুণে সৃষ্ট আধুনিক মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে গবেষণা চালিয়ে উদঘাটিত হয়েছে যে কোরআনের কথাই অক্ষরে অক্ষরে সত্য।

আনুবিক্ষীনিক পর্যায়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, কোরআনের আয়াতটিতে যেভাবে বর্ণনা করা আছে ঠিক সেভাবেই মাতৃগর্ভে মানব শিশুর বৃদ্ধি বা উন্নয়ন চলতে থাকে। প্রথমে ভ্রুণের উপাস্তি (Cartilage) টিস্যূ অস্তিতে পরিণত হয়। এরপর অস্তিসমূহের চারদিকের নির্বাচিত টিস্যূ অনুযায়ী মাংসের কোষসমূহ একত্রে এসে অস্তিসমূহকে আবৃত করে রাখে।

কোরআনে শিশুর বৃদ্ধির বহু পর্যায়ের বর্ণনা রয়েছে। যেমন সূরা মুমিনুনের চৌদ্দ নং আয়াতে বর্ণিত আছে যে, জরায়ুতে প্রথম উপাস্তিগুলো অস্তিতে পরিণত হয়। এগুলো পরে মাংসপেশী দিয়ে আবৃত হয়। আয়াতে আল্লাহ তাআলা উন্নয়নের এই পর্যায়গুলোকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, ”......পিন্ডকে পরে অস্তিতে পরিণত করি আর তারপর মাংসপেশী দ্বারা অস্তিকে জড়িয়ে দেই।”

একটি বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় Developing Human নামে টাইটেল দেয়া একটি পরিচ্ছদে এই ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে :

সপ্তম সপ্তাহের দিকে অস্তিসমূহ পুরো দেহে ছড়িয়ে যায় আর তাদের পরিচিত আকৃতি ধারণ করে । সপ্তম সপ্তাহের শেষদিকে আর অষ্টম সপ্তাহে মাংসপেশীসমূহ অস্তিসমূহের চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করে।

সংক্ষেপে কোরআনে জরায়ুতে মানুষের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির পর্যায়গুলোর যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা আধুনিক ভ্রুণবিদ্যার প্রাপ্ত তথ্যসমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে।

মাতৃগর্ভে বাচ্চার তিনটি পর্যায় মানুষ যে মাতৃগর্ভে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্ট হয়েছে-এটাই বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরাআনে :

...তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে এক অবস্থার পর অন্য অবস্থায় ত্রিবিধ অন্ধকারের মধ্যে। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব, সর্বময় কর্তৃত্ব তারঁই। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। অতএব তোমরা কোথায় ফিরে যাচ্ছ ? (কোরআন, ৩৯ : ৬)

মানুষ যে মাতৃগর্ভে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্ট হয়েছে তাই আয়াতটি নির্দেশ করে বলে বুঝা যাবে। সত্যিই বর্তমান জীববিদ্যা প্রকাশ করছে যে, মাতৃগর্ভে স্পষ্টভাবে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি অঞ্চলে শিশুর ভ্রুণের বৃদ্ধি হয় । বর্তমানে চিকিৎসাবিদ্যার প্রতিটি শাখায় পঠিত সমস্ত ভ্রুণদ্যিার বইগুলোয় এ বিষয়টি মৌলিক জ্ঞানের একটি উপাদান হিসেবে নেয়া হয়। উদাহরণ স্বরূপ মূল ভ্রুণ বিদ্যার (ভ্রুণ বিদ্যার শাখায় এটি একটি মৌলিক রেফারেন্স) এ সত্যটি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে : জরায়ুতে জীবনের তিনটি পর্যায় রয়েছে : প্রথম আড়াই সপ্তাহ-ভ্রুণ পুর্ববর্তী অবস্থা (Pre-embrynic), আটসপ্তাহের শেষ পর্যন্ত ভ্রুণাবস্থা (Embyonic), আর আট সপ্তাহ থেকে জন্ম পর্যন্ত অবস্থা (Fetal)।

এই অবস্থাসমূহ শিশুর বৃদ্ধির সময় বিভিন্ন পর্যায়ের উল্লেখ করে থাকে। সংক্ষেপে এই পরিপক্ক হওয়ার সময়ের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ :

ভ্রুণ পূর্ববর্তী পর্যায় :

এ স্তরে জাইগোট বিভাজনের মাধ্যমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে আর যখন এটি কোষগুচ্ছে (cellcluster) পরিণত হয়; এটি তখন নিজেকে নিজে জরায়ুর দেয়ালে আংশিক ঢুকিয়ে দেয়। যখন বর্ধিত হতে থাকে তখন কোষগুলো নিজেরা তিনটি স্তরে সজ্জিত হয়।

ভ্রুণাবস্থা :

দ্বিতীয় এই পর্যায়টি বিদ্যমান থাকে সাড়ে পাঁচ সপ্তাহ। এ সময় শিশুকে বলা হয় ভ্রুণ। এ সময় কোষস্তর থেকে দেহের মৌলিক অঙ্গাদি আর তন্ত্রসমূহ হাজির হয়।

ভ্রুণ পরবর্তী অবস্থা :

এ অবস্থা থেকে ভ্রুনকে বলা হয় ফিটাস । গর্ভাবস্থার অষ্টম সপ্তাহ থেকে এ অবস্থাটি শুরু হয় আর জন্মের মুহূর্ত পর্যন্ত এ অবস্থাটি বিদ্যমান থাকে। এ পর্যায়ে ভিন্ন একটি বৈশিষ্ট হলো যে মুখ, হাত আর পাসহ শিশুটি এ পর্যায়ে মানব শিশুর মতো দেখা যায়। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে এটি মাত্র তিন সেন্টিমিটার লম্বা, তথাপি সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গসমূহ পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। এ অবস্থাটি ত্রিশ সপ্তাহ বজায় থাকে আর বাচ্চার বৃদ্ধি জন্ম পর্যন্ত অব্যাহত হতে থাকে।

সূরা যুমারের ৬নং আয়াতে নির্দেশিত হয়েছে যে, মায়ের জরায়ুতে মানব শিশু সুস্পষ্ট তিনটি পর্যায়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। সত্যিই আধুনিক ভ্রুণবিদ্যায় এটি আবিষ্কৃত হয়েছে যে, জরায়ুতে শিশুর ভ্রুণের বৃদ্ধি তিনটি পৃথক পৃথক স্তরে ঘটে-থাকে।

কেবলি আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে অবলোকনের পরই মায়ের জরায়ুতে মানব শিশুর বৃদ্ধিপাপ্তির খবরাখবর নেয়া সম্ভব হয়েছে। অথচ অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সত্যসমূহের মতোই এ ব্যাপারটি কোরআনে-সংযোজিত হয়েছে অলৌকিকভাবে। যে সময়ে চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে মানুষের অল্পই জ্ঞান ছিল সে সময়ে কোরআনে খুঁটিনাটি আর সঠিক তথ্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে-এটি কোরআন যে মানুষের নয়, বরং আল্লাহর বাণী এটিই পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়।

জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি

পবিত্র মহান তিনি, যিনি জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন উদ্ভিদ, মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে। (কোরআন, ৩৬ : ৩৬)

যদিও জোড়া বা যুগল শব্দটি দ্বারা পুরুষ আর নারীর জোড়াই ধারণা করা হয়ে থাকে, “......কিন্তু তারা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে .......” এ উক্তিটির আবার বিস্তৃত পরিসরের ব্যবহার অথবা ব্যাখ্যা রয়েছে। অধুনা এই আয়াতটির একটি ব্যাখ্যার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী Paul Dirac ১৯৩৩ সালে পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব করেন যে,বস্তুসমূহ জোড়ায় জোড়ায় বা যুগল হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে। Parite নামের এই আবিষ্কার এটাই বলে যে, প্রতিটি বস্তুরই (Matter) রয়েছে এর বিপরীত প্রতিবস্তু (Antimatter)। অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুই বিপরীত গুণাবলীর প্রতিবস্তুর সঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় বা যুগলরূপে বিদ্যমান রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ,প্রতিটি বস্তুর পরমাণুর বৈশিষ্ট্যের ঠিক উল্টো বৈশিষ্ট্য বহন করে তারই প্রতিবস্তু। অর্থাৎ বস্তুর উল্টো প্রতিটি প্রতিবস্তুর রয়েছে ধনাত্মক বিদ্যুৎবাহী ইলেকট্রন আর ঋণাত্মক বিদ্যুৎবাহী প্রোটন। এক বৈজ্ঞানিক সূত্রে বিষয়টি নিম্নরূপে বর্ণিত রয়েছে :

“প্রতিটি কণারই (Particle) বিপরীত বিদ্যুৎবাহী প্রতিকণা (Anti-particle) বিদ্যমান রয়েছে-আর অনিশ্চিত সম্পর্ক এটাই আমাদের বলে যে, জোড়ায় জোড়ায় বা যুগলের সৃষ্টি বা ধ্বংস শূণ্যে সকল সময় সকল স্থানে ঘটে থাকে।”

মায়ের দুধ

মহান আল্লাহ তাআলা মায়ের দুধের মতো একটি অতুলনীয়, অসমকক্ষ মিশ্রণ তৈরী করেছেন, যা কিনা জন্ম পরবর্তী বাচ্চার একটি অপূর্ব খাদ্যউৎস্য, তার উপরে এটি বাচ্চার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। এমনকি আজকের টেকনলজীর মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে তৈরী বাচ্চাদের খাদ্যসমূহকে অলৌকিক এই মিশ্রণের উৎসটির (মায়ের দুধ) বিকল্প খাদ্য হিসেবে প্রতিস্থাপন করা যায় না।

প্রতি দিনেই মায়ের দুধের গুণাগুণ একটি একটি করে আবিষ্কার করা হ‪চ্ছে। মাতৃদুগ্ধ সম্পর্কে বিজ্ঞানে যা আবিষ্কার করা হচ্ছে তারই একটি হলো যে-জন্মের পর দু বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ পানের বিশেষ উপকারিতা রয়েছে। অতি সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞান কর্তৃক আবিষ্কৃত এই ব্যাপারটিই আল্লাহ তাআলা কোরআনে ১৪০০ বছর আগে এই আয়াতে আমাদের অবহিত করেছেন-আর আমি মানুষকে তার পিতামাতা সম্বন্ধে নির্দেশ দিয়েছি (তাদের সাথে সদাচরণ করতে)। তার মাতা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দুবছরে তার দুগ্ধ ছাড়ানো হয়। সুতরাং শোকরগুজারী কর আমার এবং তোমার মাতা-পিতার। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। (কোরআন, ৩১ : ১৪)

আঙ্গুলের ছাপে মানুষের পরিচয়

যখন কোরআনে বলা হয় যে, মৃত্যুর পর মানুষকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা আল্লাহ তাআলার জন্য অতি সহজ কাজ, তখন মানুষের আঙ্গুলের রেখাসমূহের (ছাপের) উপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। মানুষ কি ধারণা করে যে, আমি তার হাড়সমূহ একত্র করতে পারব না ?

হ্যাঁ, অবশ্যই আমি একত্র করব। কেননা আমি তার অঙ্গুলির অগ্রভাগ পর্যন্ত যথাযথভাবে ঠিক করে দিতে সক্ষম। (কোরআন, ৭৫ : ৩৪)

এমনকি হুবহু একই রূপ যমজ পর্যন্ত প্রত্যেকেরই রয়েছে অনন্য সাধারণ অঙ্গুলির রেখাসমূহ। অন্য কথায় মানুষের পরিচয় তাদের অঙ্গুলি সমূহে সংকলনভুক্ত অর্থাৎ সংকেত লিপির সাহায্যে লেখা রয়েছে। সংকলনের এই সিস্টেমটি অধুনা ব্যবহৃত বারকোড বা রেখাসঙ্কেত সিস্টেমের সঙ্গে তুলনা করা চলে।

অঙ্গুলীর রেখা সমূহের উপর গুরুত্ব প্রদান করার ব্যাপারে একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। কারণ প্রত্যেকের অঙ্গুলীর রেখাসমূহ অনন্য, অদ্বিতীয়। প্রতিটি মানুষ, জীবিত কিংবা কোন কালে জীবিত ছিল, এরূপ প্রত্যেকেরই একসেট অনন্য রেখাঙ্গুলী রয়েছে।

আর তাই অঙ্গুলীর রেখাসমূহকে মানুষের পরিচয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে একচেটিয়াভাবে গ্রহন করে নেয়া হয়েছে আর এ উদ্দেশ্যেই তা পৃথিবীর সর্বত্র ব্যবহার করা হয়।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি যে কেবল গত ঊনবিংশ শতাব্দিতে অঙ্গুলির ছাপের বৈশিষ্ট্যগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে। এর আগে মানুষ এগুলোকে কোন গুরুত্বহীন সাধারণ বক্ররেখা হিসেবেই জানতো। কিন্তু কোরআনে এই অঙ্গুলী রেখাসমূহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যা সে সময়ে কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি এবং আল্লাহ এই গুরুত্বটির প্রতি আমাদের মনোযোগ দেয়ার জন্য আহ্বান করেছেন যে গুরুত্বের কথা অবশেষে আমাদের কালে মানুষ বুঝতে পারছে।