গারানিকের উপাখ্যান
  • শিরোনাম: গারানিকের উপাখ্যান
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 14:26:1 3-9-1403

অনেকেই আছেন যাঁরা ‘গারানিক’-এর উপাখ্যানের উৎসমূল উদ্ধার করতে চান এবং বুঝতে চান যে,এ ধরনের মিথ্যা কল্প-কাহিনী তৈরি ও প্রসার করার ক্ষেত্রে কাদের হাত রয়েছে। স্মর্তব্য যে,গারানিকের এ উপাখ্যানটি আহলে সুন্নাত মাজহাবভুক্ত ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন।

ইয়াহুদীরা,বিশেষ করে তাদের নেতা ও ধর্মীয় পণ্ডিতগণ (আহবার) ইসলাম ধর্মের এক নম্বর শত্রু ছিল এবং আছে। কাবুল আহবার ও অন্যান্যের মতো একদল ব্যক্তি বাহ্যত ঈমান এনে মহান নবীদের নামে উদ্ধৃতি দিয়ে ভিত্তিহীন রেওয়ায়েতসমূহ প্রচার করে এবং মিথ্যা কল্প-কাহিনী বানিয়ে সত্য ঘটনাবলীর বিকৃতি সাধনে লিপ্ত হয়েছে। কতিপয় মুসলমান লেখক সকল মুসলিম ভাইয়ের প্রতি সুধারণা পোষণ করার কারণে গবেষণা ও অনুসন্ধান ব্যতিরেকেই তাদের বানোয়াট কাহিনীগুলোকে বিশুদ্ধ হাদীস ও ইতিহাসের সমপর্যায়ভুক্ত বিবেচনা করে লিপিবদ্ধ করেছেন।

কিন্তু এখন যখন এ ধরনের বিষয় অধ্যয়ন ও গবেষণা করার জন্য বিদগ্ধ পণ্ডিতগণের অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ও সুযোগ রয়েছে এবং বিশেষ করে একদল ইসলামী গবেষকের বহু চেষ্টা-সাধনার ফলশ্রুতিতে কাল্পনিক উপাখ্যানসমূহ থেকে সঠিক ঐতিহাসিক ঘটনাবলী পৃথক করার মূলনীতিসমূহ প্রণীত হয়েছে তখন এ কারণেই একজন ধর্মীয় আলেম লেখকের জন্য যে কোন বই-পুস্তকে যা কিছু তিনি দেখতে পাবেন তা অকাট্য সত্য বিষয় হিসাবে গণ্য করা এবং যাচাই-বাছাই না করে তা গ্রহণ ও মেনে নেয়া অনুচিত।

গারানিকের উপাখ্যান কি?

বলা হয় যে,ওয়ালীদ,আ’স,আসওয়াদ ও উমাইয়্যার মতো কুরাইশ নেতৃবর্গ ও গোত্রপতিগণ মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে অনুরোধ জানায় যে,মতপার্থক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য উভয় পক্ষই একে অন্যের উপাস্যদেরকে মেনে নেবে। এ সময়ই সূরা আল কাফিরূন তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয় এবং মহানবী (সা.) এ ধরনের কথা বলার জন্য আদিষ্ট হন যে,“তোমরা যার ইবাদাত কর,আমি তার ইবাদাত করি না এবং আমিও যাঁর ইবাদাত করি,তোমরা তাঁর ইবাদাতকারী নও।”

এতদ্সত্ত্বেও মহানবী (সা.) কুরাইশদের সাথে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন;তাই তিনি মনে মনে বলছিলেন,“হায় যদি এমন কোন বিধান অবতীর্ণ হতো যা আমাদের ও কুরাইশদের মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনত।”

একদিন তিনি কাবার পাশে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠে সূরা নাজম তিলাওয়াত করছিলেন। যখন তিনি

) أفرأيتم اللّاتَ والعزّى ومناة الثّالثة الأخرى(

 (অতঃপর তোমরা কি লাত,উয্যা এবং অপর তৃতীয় প্রতিমা মানাতকে দেখেছ? অর্থাৎ আমাকে লাত,উয্যা ও মানাত সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে?)-এ দুই আয়াতে (সূরা নাজমের ১৯ ও ২০ আয়াত) উপনীত হলেন তখন হঠাৎ শয়তান তাঁর (সা.) কণ্ঠে নিম্নোক্ত দু’টি বাক্য উচ্চারিত করায়:

تلك الغرانيق العلى، منها الشّفاعةُ ترتجى

“এগুলো (লাত,উযযা ও মানাত) হচ্ছে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মহান গারানিক (গারানিক (غرانيق ) শব্দটি গিরনাওক (غرنوق ) অথবা গারনিক-এরই বহুবচন যার অর্থ হচ্ছে এক ধরনের গাংচিল অথবা সুদর্শন যুবক।) এদের শাফায়াতই কাম্য।”

এরপর তিনি সূরা নাজমের অবশিষ্ট আয়াতগুলোও তিলাওয়াত করলেন। যখন তিনি সিজদার আয়াতে পৌঁছলেন(فاسجدوا لِلّه واعبدوا -যা হচ্ছে সূরাটির সর্বশেষ আয়াত।) তখন স্বয়ং তিনি,মুসলমান ও মুশরিক নির্বিশেষে সকল উপস্থিত ব্যক্তি প্রতিমাগুলোর সামনে সিজদাহ্ করলেন। কেবল ওয়ালীদ বার্ধক্যজনিত কারণে সিজদা করতে পারে নি।

মসজিদুল হারামে তুমুল হৈ চৈ ও আনন্দের বান বয়ে গেল। আর মুশরিকরা বলতে লাগল : মুহাম্মদ আমাদের উপাস্যদের প্রশংসা এবং সম্মানের সাথে স্মরণ করেছে। কুরাইশদের সাথে মুহাম্মদ (সা.)-এর সন্ধি-চুক্তির খবর হাবাশায় হিজরতকারী মুসলমানদের কানে গিয়েও পৌঁছায়। আর কুরাইশদের সাথে মুহাম্মদ (সা.)-এর সন্ধি ও শান্তি চুক্তি একদল মুহাজির মুসলমানের নিজেদের আবাসস্থল (হাবাশা) থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার কারণ ছিল। কিন্তু মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর তাঁরা দেখতে পেলেন যে,অবস্থা পুনরায় পরিবর্তিত হয়ে গেছে এবং ওহীর ফেরেশতা মহানবীর ওপর অবতীর্ণ হয়ে তাঁকে পুনরায় মুশরিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও জিহাদ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন,“এ দু’টি বাক্য শয়তান আপনার কণ্ঠে জারী করেছে। আর আমি কখনই এ ধরনের কথা বলি নি।” আর এতদ্প্রসঙ্গে সূরা হজ্বের ৫২-৫৪ নং আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।

এটিই ছিল গারানিক উপাখ্যান যা তাবারী তাঁর (তারিখে তাবারী,২য় খণ্ড,পৃ. ৭৫-৭৬) ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং প্রাচ্যবিদগণও তা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বর্ণনা করেছেন।

উপাখ্যান সংক্রান্ত একটি সাদামাটা পর্যালোচনা

আপনারা ধরে নিন যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) নির্বাচিত আসমানী ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না;কিন্তু তাই বলে তাঁর বুদ্ধিমত্তা,দক্ষতা এবং জ্ঞান কখনই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই কি এ ধরনের কাজ করবে? যিনি জ্ঞানী,বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান এবং দেখতে পাচ্ছেন যে,প্রতিদিনই তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শত্রু শিবিরে বিরোধ ও ফাটল ব্যাপকতর হচ্ছে তখন কি এ ধরনের পরিস্থিতিতে তিনি এমন কোন কাজ করবেন যার ফলে তাঁর ব্যাপারে বন্ধু ও শত্রু সবাই হতাশ হয়ে পড়বে? আপনারা কি বিশ্বাস করবেন,যে ব্যক্তি তাওহীদী ধর্ম ইসলামের পথে কুরাইশদের প্রস্তাবিত সকল পদ ও বিত্ত-বৈভব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনিই আবার শিরক ও প্রতিমাপূজার প্রবর্তক হয়ে যাবেন? আমরা একজন সংস্কারক ও সাধারণ রাজনীতিবিদের ব্যাপারেই এ ধরনের সম্ভাবনা আরোপ করি না,আর সেখানে মহানবী (সা.)-এর ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই আসে না।

এ উপাখ্যান প্রসঙ্গে বিবেক-বুদ্ধির ফায়সালা

১. ঐশ্বরিক শিক্ষকগণ (অর্থাৎ নবী-রাসূলগণ) বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে সব সময় ইসমাত অর্থাৎ পবিত্রতার শক্তির বদৌলতে সব ধরনের পাপ,স্খলন ও ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত ও নিরাপদ। আর যদি অবধারিত থাকে যে,তাঁরা ধর্মীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রেও ভুল-ভ্রান্তির শিকার হবেন,তাহলে তাঁদের কথা ও বাণীর প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ধ্বংস হয়ে যাবে।

অতএব,এ ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে আমাদের যুক্তিভিত্তিক আকীদা-বিশ্বাস দিয়ে অবশ্যই বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। আমাদের দৃঢ় আকীদা-বিশ্বাসের আলোকে ইতিহাসের অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য বিষয় ও ঘটনাবলীর সমাধান করতে হবে। নিশ্চিতভাবে খোদায়ী ধর্ম প্রচার মহানবী (সা.)-এর ইসমাত এ ধরনের ঘটনাবলী ঘটার ক্ষেত্রে অন্তরায়স্বরূপ।

২. এ উপাখ্যানের ভিত্তি হচ্ছে এরূপ : মহান আল্লাহ্ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাঁধে যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন তিনি তা পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। মূর্তিপূজক ও পৌত্তলিকদের বিচ্যুতি তাঁর কাছে খুবই দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তাই তিনি তাদের অবস্থার পরিবর্তন ও সংস্কার সাধনের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে নবী-রাসূলদেরকে অবশ্যই সীমাহীনভাবে ধৈর্যশীল হতে হবে। ধৈর্যাবলম্বনের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে নিরঙ্কুশভাবে সকলের জন্য অনুসরণীয় উদাহরণে পরিণত হতে হবে। বাস্তবতা ও ময়দান থেকে পলায়ন করার চিন্তা যেন তাঁরা কখনই মাথায় না আনেন।

আর গারানিকের উপাখ্যানটি যদি সত্য হয় তাহলে এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যাবে যে,আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু মহানায়ক পুরুষটি তাঁর ধৈর্য-ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন,তাঁর মন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। আর এ বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে মহান নবী-রাসূলদের ক্ষেত্রে মোটেও খাপ খায় না। আর তা মহানবী (সা.)-এর জীবনীর সাথে মোটেও সংগতিশীল নয় যা ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও আলোচনা করা হবে।

এ কাহিনী ও উপাখ্যানের রচয়িতা ভেবেও দেখে নি যে,পবিত্র কোরআন এ ঘটনাটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট সাক্ষী। কারণ মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে,এতে কখনই বাতিল অনুপ্রবেশ করতে পারবে না। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) لا يأتيه الباطلُ من بين يديه ولا من خلفه(

“বাতিল (মিথ্যা) না সামনে থেকে এতে (পবিত্র কোরআনে) আসতে পারবে,না পেছন থেকে।” (সূরা ফুসসিলাত : ৪২)।

পবিত্র কোরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে :

) إنّا نحنُ نزّلنا الذِّكرَ وإنّا له لحافظون(

“নিশ্চয়ই আমরা যিকর (আল-কোরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর হিফাযতকারী।” (সূরা হিজর : ৯)।

এতদ্সত্ত্বেও মহান আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত (শয়তান) কিভাবে মহান আল্লাহর মনোনীত বান্দার ওপর বিজয়ী হবে এবং তাঁর ওপর অবতীর্ণ কোরআনে বাতিলের অনুপ্রবেশ করাবে। আর যে কোরআনের ভিত্তি হচ্ছে মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সে কোরআনটিকেই সে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতার প্রচারক বানিয়ে দিয়েছে।

খুবই আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে,এ কাহিনী ও উপাখ্যানের রচয়িতা অনুপযুক্ত স্থানে একটি বেমানান গীত তৈরি করেছে এবং এমন এক স্থানে তাওহীদের ওপর অপবাদ আরোপ করেছে যে,অল্প কিছুক্ষণ আগে স্বয়ং কোরআনই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ মহান আল্লাহ্ এ সূরায় এরশাদ করেছেন,

) وما ينطقُ عن الهوى إنْ هو إلّا وحيٌ يوحى(

“তিনি নিজ প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাবশত কথা বলেন না;যা কিছু বলেন তা তাঁর কাছে প্রেরিত ও অবতীর্ণ ওহী।”

কিন্তু কিভাবে মহান আল্লাহ্ এত অকাট্য ও নিশ্চিত সুসংবাদ দিয়েও তাঁর নবীকে অরক্ষিত রাখবেন এবং শয়তানকে তাঁর হৃদয়,চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতায় প্রভাব বিস্তার করার অনুমতি দেবেন?

এ সব বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল-প্রমাণ ঐ সব ব্যক্তির জন্য উপকারী যারা মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতে ঈমান রাখে। তবে যে সব প্রাচ্যবিদ তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতে বিশ্বাসী নন এবং ইসলাম ধর্মের অবমূল্যায়ন করার জন্য এ ধরনের ভিত্তিহীন উপাখ্যান বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করে থাকেন তাঁদের জন্য এগুলো যথেষ্ট নয়। অবশ্যই আরেক পদ্ধতিতে তাঁদের বক্তব্যের সমুচিত জবাব দিতে হবে।

উপাখ্যানটির ভিত্তিহীনতা

ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে,যখন মহানবী (সা.) এ সূরাটি তিলাওয়াত করছিলেন তখন কুরাইশ নেতৃবর্গ যাদের অধিকাংশই ছিল প্রথিতযশা সাহিত্যিক,কথাশিল্পী এবং ভাষার প্রাঞ্জলতা,সাবলীলতা ও অলংকারশাস্ত্রের দিকপাল তারা মসজিদুল হারামে উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে সেখানে ওয়ালীদও উপস্থিত ছিল। এই ওয়ালীদ ছিল আরবের প্রজ্ঞাবান কথাশিল্পী ও সাহিত্যিক। সে বিচক্ষণতা,বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার জন্য আরব জাতির মাঝে অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিল। সে সহ উপস্থিত সকল ব্যক্তি এ সূরাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ এ সূরার সর্বশেষ আয়াতটি যা হচ্ছে সিজদার আয়াত তা সহ শুনেছে এবং সিজদা করেছে।

কিন্তু এ গোষ্ঠীটি যারা ছিল অলংকারশাস্ত্রের স্থপতি এবং তুখোড় সাহিত্য ও কাব্য সমালোচক তারা কিভাবে মাত্র এ দু’টি বাক্যের ওপর নির্ভর করেছে যেগুলোয় তাদের উপাস্যদের স্তুতি বিদ্যমান? অথচ এ দু’টি বাক্যের পূর্বের ও পরবর্তী বাক্যগুলোয় আদ্যোপান্ত তাদের উপাস্যদের তীব্র নিন্দা,তিরস্কার ও দোষারোপ করা হয়েছে।

স্পষ্ট এ বানোয়াট কাহিনীর রচয়িতা তাদেরকে কি ধরনের ব্যক্তি বলে মনে করেছে? যে গোষ্ঠীটির ভাষা আরবী এবং সমগ্র আরব সমাজে যাদেরকে ভাষাবিদ ও অলংকারশাস্ত্রের স্থপতি বলে গণ্য করা হতো এবং যারা স্পষ্ট অর্থবোধক বাক্য ও উক্তিসহ নিজেদের মাতৃভাষার সকল ইশারা-ইঙ্গিত এবং পরোক্ষ অর্থবোধক উক্তি অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম তারা কিভাবে মাত্র দু’টি বাক্যের ওপর নির্ভর করতে পারল যেগুলোয় তাদের দেব-দেবী ও উপাস্যদের প্রশংসা ও স্তুতি রয়েছে এবং কিভাবে তারা এ দু’টি বাক্যের পূর্ববর্তী বাক্যগুলোর ব্যাপারে সম্পূর্ণ অমনোযোগী থেকে গেল? যেখানে সাধারণ মানুষকে ঐ সব বাক্য যেগুলোয় আদ্যোপান্ত তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও আচার-আচরণের তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কেবল এ দু’টি বাক্য দিয়ে ধোঁকা দেয়া সম্ভব নয় সেখানে অসাধারণ ব্যক্তিদেরকে এ দু’টি বাক্য দিয়ে ধোঁকা দেয়া কিভাবে সম্ভব?

এখন আমরা সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো এখানে উল্লেখ করছি এবং এ দু’টি বাক্যের স্থানে বিন্দু স্থাপন করছি অর্থাৎ তা খালি রাখছি;এরপর এগুলোর বঙ্গানুবাদ করছি। আপনারা ভালোভাবে লক্ষ্য করবেন যে,আসলেই কি এ বাক্যদ্বয় (تلك الغرانيق العلى، منها الشّفاعةُ ترتجى অর্থাৎ এরা হচ্ছে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন সুন্দর যুবক যাদের কাছ থেকেই কেবল শাফায়াত প্রত্যাশা করা যায়) এ সব আয়াতের মাঝে স্থান দেয়া যায় যেগুলোয় প্রতিমা ও মূর্তিসমূহের নিন্দা ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে?

أفرأيتمُ اللّاتَ والعُزّى ومناةَ الثّالثةَ الأخرى ألكمُ الذّكرُ وله الأُنثى تلكَ إذاً قِسْمةٌ ضيزى إنْ هي إلّا أسماءٌ سمَّيتموها أنتم وآباؤكم ما أنزلَ اللهُ بها مِنْ سلطانٍ

“আমাকে লাত,উয্যা ও মানাত যা হচ্ছে তৃতীয় প্রতিমা সে সম্পর্কে বল...(এ শূন্যস্থানে  تلك الغرانيقُ العلىمنها الشّفاعةُ ترتَجى -এ দু’ বাক্যের অনুবাদ রাখা হলে নিশ্চিতভাবে দেখতে পাবেন যে,এর ফলে তা আদ্যোপান্ত স্ব-বিরোধিতায় পূর্ণ হয়ে যাবে। অনুবাদ : এগুলো (লাত,উয্যা ও মানাত) হচ্ছে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বলাকা (সুন্দর যুবা);এগুলো থেকে কেবল শাফায়াতই প্রত্যাশা করা যায়।)  পুত্রসন্তান কি তোমাদের এবং কন্যাসন্তান মহান আল্লাহর? (তাহলে) এ তো এক ধরনের অন্যায্য বণ্টন-রীতি। প্রতিমাগুলো নিছক কতগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয় যেগুলো তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষগণই রেখেছ;আর মহান আল্লাহ্ এ ব্যাপারে (এ প্রতিমার ব্যাপারে) কোন স্পষ্ট দলিল-প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি?”

একজন সাধারণ মানুষও কি মহানবী (সা.)-এর মতো-যে শত্রু দশ বছর যাবত তাঁর ধর্মের ওপর তীব্র আঘাত হেনেছে এবং তার অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা বিপন্ন করে তুলেছে সেই শত্রুর পক্ষ থেকে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী কতিপয় বাক্য শুনেই তার বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে হাত গুটিয়ে নেবে এবং তার সাথে সকল বিরোধের নিষ্পত্তি করবে?

ভাষাগত দিক থেকে কাল্পনিক এ উপাখ্যানটি রদ করার দলিল

প্রখ্যাত মিশরীয় আলেম আবদুহু বলেন,“আরবী ভাষা ও কবিতায় কখনই গারানিক শব্দটি দেব-দেবী ও উপাস্যদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় নি;غرنيق  ওغرنوق যা অভিধানে বর্ণিত হয়েছে এগুলোর অর্থ হচ্ছে জলচর পাখি (গাংচিল,বলাকা) অথবা সুদর্শন শ্বেতাঙ্গ যুবক। আর এ অর্থগুলোর কোন একটিই দেব-দেবী,প্রতিমা ও উপাস্য অর্থের সাথে সংগতিশীল নয়।

স্যার উইলিয়াম মূর নামক একজন প্রাচ্যবিদ ‘গারানিক’ -এর উপাখ্যানকে ইতিহাসের অকাট্য বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেছেন। আর তাঁর এ অভিমতের পক্ষে দলিল হচ্ছে এই যে,হাবাশায় হিজরতকারী প্রথম দলটি হিজরতের তিন মাস গত হতে না হতেই কুরাইশদের সাথে মহানবী (সা.)-এর সন্ধিচুক্তির সংবাদটি শুনতে পায় এবং তারা মক্কায় প্রত্যাবর্তন করে। যে সব মুসলমান ঐ দেশে হিজরত করেছিলেন তাঁরা সেখানে বাদশাহ্ নাজ্জাশীর আশ্রয়ে নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করছিলেন। যদি তাঁদের কাছে কুরাইশদের সাথে মহানবীর নৈকট্য ও সন্ধি-চুক্তি সম্পাদনের সংবাদ না পৌঁছত তাহলে তাঁরা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য মক্কা প্রত্যাবর্তন করতেন না। অতএব,মহানবী শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি পন্থার উদ্ভাবন করে থাকবেনই। আর এ গারানিকের উপাখ্যানই হচ্ছে সেই পন্থা।

কিন্তু এখন আমরা সম্মানিত এ প্রাচ্যবিদের কাছে প্রশ্ন করতে চাই,হাবাশায় হিজরতকারী মুসলমানদের মক্কায় প্রত্যাবর্তন যে অবশ্যই একটি সত্য সংবাদের ভিত্তিতে হতে হবে এ ধরনের কি কোন আবশ্যকতা আছে? এমন কোন দিন নেই যে,প্রবৃত্তির পূজারী ও স্বার্থান্বেষী চক্র জনগণের মাঝে হাজার ধরনের মিথ্যা সংবাদ ও তথ্য প্রচার করত না,বরং এসব মুহাজির মুসলমানদের হাবাশা থেকে মক্কায় ফিরিয়ে আনার জন্য একদল লোক যে কুরাইশদের সাথে মহানবীর সন্ধি-চুক্তি সম্পাদনের সংবাদটি জাল করে থাকতে পারে সে সম্ভাবনাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান। এর ফলে এ সংবাদ শুনে হিজরতকারী মুসলমানরা নিজেরাই হাবাশা থেকে পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ কারণেই কতিপয় হিজরতকারী মুসলমান এ সংবাদটি বিশ্বাস করেছিলেন এবং মক্কায় ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু অপর কিছু সংখ্যক হিজরতকারী এ গুজব দ্বারা প্রতারিত না হয়ে হাবাশায় থেকে যান।

দ্বিতীয়ত আপনারা ভেবে দেখুন যে,মহানবী (সা.) সন্ধি-চুক্তি সম্পাদন করার মাধ্যমে কুরাইশদের সাথে তাঁর বিরোধ নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ কারণে সন্ধি-চুক্তির মূল ভিত কেন এ দু’টি বাক্য জাল করার সাথেই সংশ্লিষ্ট হবে? বরং কুরাইশদের আকীদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত এক নিরঙ্কুশ নীরবতা-একটি সহায়ক প্রতিজ্ঞা তাদের হৃদয়কে তাঁর নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য ছিল যথেষ্ট।

যা হোক হিজরতকারীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এ উপাখ্যান সত্য হওয়ার দলিল নয়। আর এ বাক্য (এগুলো হচ্ছে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বলাকা,এদের শাফায়াত-ই কেবল প্রত্যাশা করা যায়) উচ্চারণ করার মধ্যেই কেবল শান্তি ও সন্ধি নিহিত নেই।

এর চেয়ে আরো আশ্চর্যজনক হচ্ছে এই যে,কোন কোন ব্যক্তি ধারণা করেছেন যে,সূরা হজ্বের ৫২-৫৪ আয়াত গারানিক উপাখ্যানকে কেন্দ্র করেই অবতীর্ণ হয়েছে। যেহেতু এ আয়াতগুলো প্রাচ্যবিদ ও ইতিহাস বিকৃতকারীদের হাতের দলিল সেহেতু আমরা এগুলোর

অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যা করব এবং সুস্পষ্ট করে দেব যে,এ সব আয়াত ভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করে।

আয়াতগুলো এবং এগুলোর অনুবাদ নিচে উল্লেখ করা হলো :

) وما أرسلنا مِن قبلكَ مِنْ رسولٍ ولا نبيٍّ إلّا إذا تمنّى ألقى الشّيطانُ في أُمنِيَّته فينسخُ اللهُ ما يُلْقي الشَّيطانُ ثمَّ يحكِمُ الله آياته واللهُ عليمٌ حكيمٌ(

“আমরা আপনার আগে যে রাসূল ও নবীকেই প্রেরণ করেছি তিনি যখনই আকাঙ্ক্ষা করেছেন তখনই শয়তান তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষায় হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপ করেছে এবং মহান আল্লাহ্ নবী-রাসূলদের আশা-আকাঙ্ক্ষায় শয়তান যা প্রক্ষেপ করে তা বিলুপ্ত (করে দেন)। অতঃপর তিনি (মহান আল্লাহ্) তাঁর আয়াতসমূহ দৃঢ় করে প্রতিষ্ঠিত করে দেন (অর্থাৎ নিদর্শনসমূহে দৃঢ়তা প্রদান করেন)। মহান আল্লাহ্ অত্যন্ত জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান।”(সূরা হজ্ব ৫২ নং আয়াত)

) ليجعل ما يلقي الشيطان فتنة للّذين في قلوبهم مرض والقاسية قلوبهم وإنّ الظّالمين لفي شقاقٍ بعيدٍ(

“যাতে শয়তান যা কিছু সম্পন্ন করে,মহান আল্লাহ্ তা দিয়ে যাদের অন্তরে রোগ আছে এবং যাদের হৃদয় পাষাণ তাদেরকে পরীক্ষা করেন;আর নিশ্চয়ই অত্যাচারীরা চরম দুর্ভাগ্যে পতিত ও পারলৌকিক মুক্তি থেকে বহু দূরে (আছে)।”(সূরা হজ্ব ৫৩ নং আয়াত)

) وليعلم الذين أوتوا العلم أنّه الحقّ من ربّك فيؤمنوا به فتخبتَ له قلوبهم وإنّ اللهَ لهادِ الذين آمنوا إلى صراطٍ مستفيمٍ(

“যাতে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ জানতে সক্ষম হয় যে,এ কোরআন সত্য এবং আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে (অবতীর্ণ) এবং এর প্রতি ঈমান আনতে পারে। অতঃপর তাঁর প্রতি অবনত ও বিনয়ী হয়ে যায়;আর নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সরল সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন।”(সূরা হজ্ব ৫৪ নং আয়াত)

এখন আয়াতের অন্তর্নিহিত মূল অর্থ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। প্রথম আয়াতটিতে তিনটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে :

ক. নবী-রাসূলগণ আকাঙ্ক্ষা করেন।

খ. শয়তান তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষায় হস্তক্ষেপ করে।

গ. মহান আল্লাহ্ শয়তানের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপের অশুভ প্রভাব বিলুপ্ত করে দেন।

ক. নবী-রাসূলগণের আকাঙ্ক্ষা বলতে কি বোঝানো হয়েছে?

মহান নবিগণ সব সময় তাঁদের নিজ উম্মাহ্ ও জাতির মাঝে হেদায়েত ও সত্য ধর্ম প্রচার ও প্রসারের আকাঙ্ক্ষা করতেন;আর তাঁরা তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রভূত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন এবং এ পথে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের বিপদাপদ ও কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করেছেন এবং সেগুলোর প্রতিরোধ করেছেন। মহানবীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তাঁর বেশ কিছু পরিকল্পনা ছিল। তাই তিনি তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপদান করার জন্য বেশ কিছু পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন। পবিত্র কোরআন এ বাস্তবতাকে-

) وما أرسلنا من رسول ولا نبي إلّا إذا تمنّى(

“আমি আপনার পূর্বে যে রাসূল ও নবীই প্রেরণ করেছি তিনি যখনই আকাঙ্ক্ষা করেছেন...” (সূরা হজ্বের ৫২ নং আয়াত)-এ আয়াতের মাধ্যমে বর্ণনা করেছে।

এ পর্যন্তتمنّى (আকাঙ্ক্ষা করেছেন) এর অর্থ পরিষ্কার হয়ে গেছে;এখন আমরা দ্বিতীয় বিষয়টি ব্যাখ্যা করব।

খ. শয়তানের হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপের (القاء ) অর্থ কি?

নিম্নোক্ত প্রক্রিয়াদ্বয়ের যে কোন একটির দ্বারা শয়তান হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপ করে থাকে :

১. মহান নবীদের গৃহীত সিদ্ধান্তে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করে এবং তাঁদের ও তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের মাঝে অগণিত বাধা বিদ্যমান আছে এবং এ সব বাধা-বিপত্তির কথা বিবেচনা করলে তাঁরা তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যে সফল হবেন না-এ ব্যাপারে তাঁদেরকে সন্দিহান করার মাধ্যমে।

২. যখনই মহান নবিগণ কোন কাজের প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করতেন এবং যখনই নিদর্শনাদি থেকে কোন নবীর দৃঢ় পদক্ষেপ ও উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে যেত ঠিক তখনই শয়তান ও শয়তান প্রকৃতির লোকেরা মহান নবীদের বিরুদ্ধে জনগণকে প্ররোচিত করত এবং তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করে তাঁদেরকে তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করা থেকে বিরত রাখত।

প্রথম সম্ভাবনা যেমন পবিত্র কোরআনের অন্যান্য আয়াতের সাথে মোটেও খাপ খায় না ঠিক তেমনি তা আলোচ্য দ্বিতীয় আয়াতের সাথেও সংগতিসম্পন্ন নয়;কিন্তু অন্যান্য আয়াতের দৃষ্টিতে পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদের ওপর শয়তানের যে আধিপত্য ও কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা নেই তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বর্ণনা করেছে (যদিও শয়তান এভাবে তাঁদেরকে দেখাতে ও বোঝাতে চায় যে,তাঁরা তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না) এবং বলেছে :

) إنَّ عبادي ليس لك عليهم سلطانٌ(

“নিশ্চয়ই আমার (প্রকৃত) বান্দাদের ওপর তোমার কোন আধিপত্য ও কর্তৃত্ব নেই।” (সূরা হিজর : ৪২ ও সূরা ইসরা : ৬৫)

) إنّه ليسَ له سلطانٌ على الّذين آمنوا وعلى ربّهم يتوكّلون(

“নিশ্চয়ই ঐ সব ব্যক্তির ওপর শয়তানের কোন কর্তৃত্ব ও আধিপত্য নেই যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের প্রতিপালকের ওপর ভরসা করে।” (সূরা নাহল : ৯৯)

এ আয়াত ও আরো অন্যান্য আয়াত যেগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহান আল্লাহর ওয়ালীদের (বন্ধু) অন্তরে শয়তান অনুপ্রবেশ ও প্রভাব বিস্তার করতে পারে না সেগুলো থেকেও প্রমাণিত হয়ে যায় যে,মহান নবীদের আশা-আকাঙ্ক্ষায় শয়তানের হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপের প্রকৃত অর্থ তাঁদের ইচ্ছাশক্তি দুর্বল করা এবং তাঁদের কাছে তাঁদের কাজের পথে বিদ্যমান বাধা-বিপত্তিগুলো বড় করে দেখানো নয়।

কিন্তু আলোচ্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতের দৃষ্টিতে শয়তানের এ হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপের বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে,আমরা এ কাজের দ্বারা দু’টি গোষ্ঠীকে পরীক্ষা করব। একটি গোষ্ঠী যাদের অন্তঃকরণ অসুস্থ এবং অন্য দলটি হচ্ছে জ্ঞানী যাঁরা মহান আল্লাহ্ ও তাঁর নিদর্শনসমূহে আস্থা রাখেন।

অর্থাৎ জনগণকে মহান নবীদের সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার মাধ্যমে শয়তানের অযাচিত হস্তক্ষেপ প্রথম গোষ্ঠীটির ক্ষেত্রে মহান নবী ও রাসূলদের প্রতি তাদের অবাধ্যতা ও বিরুদ্ধাচরণের কারণ হয়,অথচ অপর গোষ্ঠীটির ক্ষেত্রে এ হস্তক্ষেপের প্রভাব পূর্ববর্তী গোষ্ঠীর ঠিক বিপরীত হয়ে থাকে এবং এর ফলে তাঁদের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।

যেহেতু মহান নবীদের আশা-আকাঙ্ক্ষায় শয়তানের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপের এমন দু’টি ভিন্ন ধরনের প্রভাব রয়েছে (অর্থাৎ একদল লোক মহান নবী-রাসূলগণের বিরোধী এবং অন্য একটি দল মহান আল্লাহ্,তার নবী-রাসূলগণ এবং নিদর্শনাদির প্রতি ঈমান রাখার ব্যাপারে অধিকতর দৃঢ় ও অবিচল হয়ে থাকে) সেহেতু এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,শয়তানের হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপ আসলে দ্বিতীয় অর্থে অর্থাৎ মহান নবীদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে ও প্ররোচিত করে শত্রুদের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিয়ে এবং তাদের সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে শয়তান হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপ করে থাকে। তার হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপ কখনো এমন নয় যে,সে নবীদের অন্তরে হস্তক্ষেপ করে তাঁদের ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্তকে দুর্বল ও খর্ব করে দিতে সক্ষম।

এ পর্যন্ত মহান নবীদের আশা-আকাঙ্ক্ষায় শয়তানের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও প্রক্ষেপের অর্থ স্পষ্ট হয়ে গেল। এরপর এখন তৃতীয় বিষয় অর্থাৎ শয়তানের এ অযাচিত হস্তক্ষেপের কুপ্রভাবগুলো বিলুপ্ত করা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করব।

গ. হস্তক্ষেপ করার প্রভাবসমূহ মিটিয়ে দেবার প্রকৃত তাৎপর্য কী?

যদি শয়তানের হস্তক্ষেপের অর্থ একদল মানুষের বিরুদ্ধে আরেকদল মানুষকে উসকে দেয়া বোঝায় তাহলে এ কাজ তাদেরকে উন্নতি থেকে বিরত রাখবে। তাহলে এ পর্যায়ে মহান আল্লাহ্ কর্তৃক শয়তানের কাজ পরিপূর্ণ বিলুপ্ত করার অর্থ হচ্ছে এই যে,তাদের (শয়তানদের) ষড়যন্ত্র ও অমঙ্গল তাঁদের থেকে দূর করে দেন যে পর্যন্ত না মুমিনদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,পরীক্ষা কেবল আঁধার হৃদয়েরই জন্য। উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত আয়াতটিতে বর্ণিত হয়েছে :

) إنّا لننصرُ رسلنا والّذين آمنوا في الحياة الدّنيا(

“নিশ্চয়ই আমরা আমাদের প্রেরিত রাসূলগণ এবং পার্থিব জগতে যারা ঈমান এনেছে তাদের সবাইকে সাহায্য করব।” (সূরা মুমীন : ৫১)

সংক্ষেপে : পবিত্র কোরআন এ সব আয়াতে নবীদের মাঝে মহান আল্লাহর সনাতন ও প্রতিষ্ঠিত একটি সুন্নাহ্ বা নিয়ম সম্পর্কে তথ্য জ্ঞাপন করে। আর তা হচ্ছে মহান নবিগণ কর্তৃক সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং জনগণকে সুপথে পরিচালনা করার ব্যাপারে সাফল্য লাভের আশা-আকাঙ্ক্ষা। আর ঠিক তখনই মহান নবী-রাসূলদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে শয়তান এবং মানুষ ও জ্বিনরূপী শয়তানদের পালা চলে আসে। এরপরই শয়তানী ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাসমূহ নস্যাৎ করার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশী সাহায্য এসে পৌঁছায়। এটিই ছিল অতীত সকল উম্মাহ্ ও জাতির মাঝে মহান আল্লাহর সুন্নাহ্। হযরত নূহ,হযরত ইবরাহীম এবং বনি ইসরাইলের নবী-রাসূলগণ,বিশেষত হযরত মূসা ও হযরত ঈসাসহ সকল নবী-রাসূলের জীবনেতিহাস এবং বিশেষ করে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনেতিহাস এ ঐতিহাসিক সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে।

মূল: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী রচিত ‘চিরভাস্বর মহানবী (সা.)’ গ্রন্থ

অনুবাদ : মোহাম্মদ মুনীর হোসেন খান

সঙ্কলন ও সম্পাদনা: এম এফ বারী