সূরা নাহল; আয়াত ১১৬-১১৯
সূরা নাহলের ১১৬ ও ১১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ (116) مَتَاعٌ قَلِيلٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (117(
“তোমাদের জিহ্বা যেসব মিথ্যা বর্ণনা করে (তার ওপর ভিত্তি করে) এবং আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপের উদ্দেশ্য বল না যে, এটা হালাল এবং ওটা হারাম। নিশ্চয় যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করে, তারা সফল হয় না।” (১৬:১১৬)
“(তাদের জন্য ইহকালের অংশ হিসেবে রয়েছে) সামান্য কিছু ভোগ্য সামগ্রী। এরপর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।” (১৬:১১৭)
আগের পর্বের আলোচনায় নিষিদ্ধ জন্তু নিষিদ্ধ গোশত সম্পর্কিত আয়াতের ব্যাখ্যা শুনেছি আমরা। এ দুই আয়াতে আবারও মুশরিক ও কুসংস্কার-পূজারীদের আল্লাহ বলছেন: তোমাদের মুখে যাই আসে তা দিয়ে কেন খোদায়ী বিধান সম্পর্কে মন্তব্য করছ এবং যা খুশি তাই হালাল বা হারাম বলে ঘোষণা করছ? তোমরা কি জান না যে এইসব ঘোষণার অর্থ আল্লাহকে অপবাদ দেয়া বা আল্লাহর নামে মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করা? যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করে তারা ইহকালেও কোনো কল্যাণের দেখা পাবে না, পরকালেও ভালো কিছু পাবে না। ইহকালে পাবে সামান্য কিছু ভোগ সামগ্রী। এরপর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি তথা জাহান্নামের আগুন।
এই দুই আয়াতে উচ্চারিত হুঁশিয়ারি কেবল মক্কার মুশরিকদের জন্যই প্রযোজ্য নয়। এই আধুনিক যুগেও যারা খোদায়ী বিধানের বিপরীত আইন পাস করে তথা আল্লাহর ঘোষিত হালালকে নিষিদ্ধ করে এবং খোদার ঘোষিত নিষিদ্ধ বা হারাম বিষয়গুলোকে বৈধ করে ও এসবের প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখে তাদের জন্যেও এ হুঁশিয়ারি প্রযোজ্য। এরাও সফল হবে না।
এ থেকে স্পষ্ট, ধর্মে নতুনত্ব সৃষ্টি করা বা বিদআত চালু করা হারাম। যারাই কুরআন হাদিসের দলিল ছাড়া কোনো কিছু হালাল বা হারাম ঘোষণা করে কিংবা নতুন ইবাদতের রীতি চালু করে তা হবে বিদআত। এমনকি কেউ যদি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে বলে দাবি নাও করে তবুও ধর্মের মধ্যে নতুন বিষয় চালু করার কারণে তা আল্লাহর ওপরই মিথ্যা আরোপের শামিল। তাই এটাও বলা যাবে না অমুক বিষয় উত্তম বিদআত বা "বিদআতে হাসনা" বলে গ্রহণযোগ্য, বরং সব বিদআতই হারাম।
রাসূল (সা.) বলেছেন, সব বিদআতই হল বিভ্রান্তি এবং সব বিভ্রান্তির পরিণতি হল জাহান্নাম। কুরআনে বিদআত প্রবর্তনকারীর জন্য বেদনাদায়ক শাস্তির কথা বলা হয়েছে। বিদআতকারী নিজেও বিভ্রান্ত এবং অন্যদেরও বিভ্রান্ত করে। তাই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, বিদআত তথা ধর্মে নতুনত্ব বা পরিবর্তন সৃষ্টিকারীদের কাছেও বসো না। কারণ,সংসর্গের প্রভাব খুব বেশি হয়ে থাকে।
এ দুই আয়াতের দু'টি শিক্ষণীয় দিক হল:
এক. বৈধ ও নিষিদ্ধ বিষয় নির্ধারণ একমাত্র আল্লাহর হাতেই নিবদ্ধ। খোদায়ী নির্দেশের বিপরীত যে কোনো বক্তব্য বা কাজ বিদাআত।
দুই. খোদায়ী বিধান বলে চালিয়ে দেয়া বহু বিদআত ও কুসংস্কারের উতস হল পার্থিব স্বার্থ হাসিল ও ভোগ –লিপ্সা।
সূরা নাহলের ১১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَعَلَى الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا مَا قَصَصْنَا عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَمَا ظَلَمْنَاهُمْ وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
“ইহুদিদের জন্যে আমি তো কেবল তাই হারাম করেছিলাম যা ইতোপূর্বে আপনার (মুহাম্মাদ-সা.) কাছে বলেছি। আমি তাদের প্রতি কোন জুলুম করিনি কিন্তু তারাই নিজেদের ওপর জুলুম করত।” (১৬:১১৮)
নিষিদ্ধ খাদ্য সম্পর্কে আগের কয়েকটি আয়াত ছাড়াও সূরা আনআমের ১৪৬ নম্বর আয়াতে ইহুদিদের জন্য আরও কিছু নিষিদ্ধ খাদ্যের কথা এসেছে। এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, ইহুদিদের জন্য নিষিদ্ধ খাদ্যের তালিকা বড় করার কারণ হল তাদের অবাধ্যতার শাস্তি। কিন্তু আমি অন্যদের জন্য সেই বিশেষ কিছু খাদ্য নিষিদ্ধ করিনি। অর্থাত ইহুদিদের জন্য বিশেষভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত খাদ্যগুলো প্রকৃতিগতভাবেই নিষিদ্ধ ছিল না ও এখনও তা নয়, বরং ইহুদিদের কিছু অপরাধের শাস্তি হিসেবেই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাই ইহুদিদের পরে অন্য জাতিগুলোর জন্য সেইসব খাদ্য হারাম করা হয়নি।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. খোদায়ি শাস্তি বান্দাদের ওপর জুলুম নয়,বরং তাদের অপরাধেরই ফসল মাত্র।
দুই. খোদায়ি নিষেধাজ্ঞা দুই ধরনের, স্থায়ী ও অস্থায়ী। স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সব যুগের সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য। আর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বিশেষ সময়ে বিশেষ গোষ্ঠী বা গ্রুপের জন্য সীমিত।
সূরা নাহলের ১১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ عَمِلُوا السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا إِنَّ رَبَّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
“অনন্তর যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর তওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, আপনার পালনকর্তা এসবের পরে তাদের জন্যে অবশ্যই ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (১৬:১১৯)
তওবা ও ক্ষমা সংক্রান্ত এ আয়াত বেশ তাতপর্যপূর্ণ। এ আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী যে কোনো মানুষ অজ্ঞতাবশত পাপ করে ফেললে বা নফসের ধোঁকার শিকার হয়ে নোংরা কোনো কজ করার পরও যদি আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হয়ে সেইসব নোংরা কাজের ক্ষতি পূরণের বা সংশোধনের চেষ্টা করে তথা সতকর্ম ও পাপমোচনের উপযুক্ত কাজ করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে সে অবশ্যই আল্লাহর রহমত ও করুণা পাবে।
এখানে এবং কুরআনের আরো দুই আয়াতে 'অজ্ঞতাবশত' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ পাপের কদর্যতা সম্পর্কে অজ্ঞতা নয়। বরং এর অর্থ হল কাজটি যে নোংরা কাজ তা জানা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ কুপ্রবৃত্তি বা শয়তানের কুমন্ত্রণার শিকার হয়ে ওই পাপ কাজ করা। তাই এরপরই তার মধ্যে জেগে ওঠে তীব্র অনুশোচনা বা বিবেকের দহন। কিন্তু যারা পাপ কাজ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর এবং এ জন্য কোনো দুঃখ বা অনুশোচনাও করে না, তারা এই আয়াতে উল্লেখিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এই শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর রহমত থেকে দূরেই থাকবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি দিক হল :
এক. ইসলামে কোনো অচলাবস্থা নেই। মহান আল্লাহ তওবার পথ সবার জন্যই খোলা রেখেছেন।
দুই. প্রকৃত তওবা হল অতীতের সংশোধন করা ও ক্ষতিপূরণ করা। কেবল চোখের পানি ফেলা ও দুঃখিত হওয়া যথেষ্ট নয়।