সূরা হুদ; (১৯তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা হুদ; (১৯তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 5:37:15 2-10-1403

সূরা হুদ; আয়াত ৭৯-৮৩

সূরা হুদের ৭৯ ও ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قَالُوا لَقَدْ عَلِمْتَ مَا لَنَا فِي بَنَاتِكَ مِنْ حَقٍّ وَإِنَّكَ لَتَعْلَمُ مَا نُرِيدُ (79) قَالَ لَوْ أَنَّ لِي بِكُمْ قُوَّةً أَوْ آَوِي إِلَى رُكْنٍ شَدِيدٍ

"(লুত সম্প্রদায়) বললো, তুমি নিশ্চয়ই জান, তোমার কন্যাদের প্রতি আমাদের কোন আগ্রহ নাই, আমরা কি চাই তা তুমি ভালোভাবেই জান।” (১১:৭৯)

“হযরত লুত (আ.) বললেন, হায়! তোমাদের ওপর যদি আমার শক্তি থাকতো অথবা আমি কোন সুদৃঢ় আশ্রয় গ্রহণ করতে সক্ষম হতাম।" (১১:৮০)

গত পর্বে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই আয়াতেও লুত (আ.) এর সম্প্রদায়ের বিকৃত মানসিকতার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের পরিণতির কথাও   ব্যক্ত করা হবে। ঘটনাটি ছিল, কয়েকজন ফেরেশতা মানব আকৃতিতে হযরত লুত (আ.)এর বাড়ীতে আসেন। হযরত লুত (আ.) প্রথমে বুঝতে পারেননি যে তারা ফেরেশতা। হযরত লুত (আ.)এর বাড়ীতে কয়েকজন সুন্দর লাবণ্যময় চেহারার যুবক অবস্থান করছে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে কওমে লুতের লোকেরা তাদের অবৈধ ও বিকৃত যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য পয়গম্বরের বাড়ীর চারদিকে ভীড় জমায়। আল্লাহর নবী হযরত লুত (আ.) অনন্যোপায় হয়ে তাদেরকে বললেন, আমি আমার কন্যাদেরকে তোমাদের সাথে বিয়ে দিতে পারি। কিন্তু এই যুবকদেরকে তোমাদের কাছে কখনও সোপর্দ করবো না। হযরত লুত (আ.)এর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে কওমে লুতের লোকেরা বলেছিল, তুমি তো ভালো করেই জানো যে, তোমার কন্যাদের প্রতি আমাদের কোন আগ্রহ নেই। আমরা চাই তোমার মেহমান যুবকদেরকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হোক। এই অবস্থায় হযরত লুত (আ.) আক্ষেপ করে বলেছিলেন, হায়! আমার যদি শক্তি থাকতো বা মুমিন সহচর থাকতো তাহলে এই পাপাচারী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতাম।

পবিত্র কুরআন কয়েক হাজার বছর আগের এই ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছে এবং লুত সম্প্রদায়ের পরিণতি সম্পর্কে মানব জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যে বিকৃত মানসিকতার জন্য কওমে লুত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, বর্তমান সভ্য যুগে বিশ্বের অনেক জায়গায় তা অবাধে চলতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি সভ্যতার দাবিদার অনেক পশ্চিমা দেশ সমকামীতার মত নিকৃষ্ট পাপাচারকে বৈধতা দিয়েছে। পাপ মানুষকে অন্ধ করে ফেলে, অতিরিক্ত পাপের ফলে মানুষের বিবেক ও বোধশক্তি লোপ পায়। পরিণতিতে মানুষ ভালোকে খারাপ ও খারাপকে ভালো মনে করতে থাকে।

সূরা হুদের ৮১ নম্বর এ আয়াতে বলা হয়েছে,

  قَالُوا يَا لُوطُ إِنَّا رُسُلُ رَبِّكَ لَنْ يَصِلُوا إِلَيْكَ فَأَسْرِ بِأَهْلِكَ بِقِطْعٍ مِنَ اللَّيْلِ وَلَا يَلْتَفِتْ مِنْكُمْ أَحَدٌ إِلَّا امْرَأَتَكَ إِنَّهُ مُصِيبُهَا مَا أَصَابَهُمْ إِنَّ مَوْعِدَهُمُ الصُّبْحُ أَلَيْسَ الصُّبْحُ بِقَرِيبٍ

 "ফেরেশতারা বললো, হে লুত ! আমরা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশতা। ওরা কখনই তোমার নিকট পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং তুমি রাতের কোন এক সময়ে তোমার পরিবারবর্গসহ বেরিয়ে পড় এবং তোমাদের মধ্যে কেউ যেন পেছন দিকে না তাকায়। কিন্তু তোমার স্ত্রী যাবে না। তাদের যা ঘটবে তারও তাই হবে। প্রভাব তাদের জন্য নির্ধারিত কাল, প্রভাব কি নিকটবর্তী নয় ?"(১১:৮১)

হযরত লুত (আ.) পাপাচারী জনগোষ্ঠীর চাপ ও হঠকারী আচরণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। ফেরেশতারা তখন নিজেদের পরিচয় ও আগমনের উদ্দেশ্য খুলে বললেন ও পয়গম্বরকে উদ্বেগ থেকে রক্ষা করলেন। তারা হযরত লুত (আ.) কে জানালেন খুব সকালেই আল্লাহর গজবে এই পাপাচারী সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তাই তারা রাতের মধ্যেই পয়গম্বরকে তার পরিবারবর্গসহ শহর ত্যাগ করতে বললেন। তবে ফেরেশতারা এটাও জানালেন যে, হযরত লুত (আ.)এর স্ত্রী আল্লাহর গজবের অন্তর্ভূক্ত হবে। কারণ তিনি পয়গম্বরকে সমর্থন না করে পাপিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পক্ষাবলম্বন করেছিলেন।

এই আয়াত থেকে এটা বোঝা যায় যে, পয়গম্বরের স্বজন বা পরিবারের সদস্য হওয়া মুক্তির মাপকাঠি নয়। ঈমান ও সৎকর্ম হচ্ছে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায়। হযরত লুত (আ.)এর স্ত্রী ঈমান না আনার কারণে পাপাচারী জনগোষ্ঠীর দলভুক্ত বিবেচিত হয়েছে।

এই সূরার ৮২ ও ৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

فَلَمَّا جَاءَ أَمْرُنَا جَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهَا حِجَارَةً مِنْ سِجِّيلٍ مَنْضُودٍ (82) مُسَوَّمَةً عِنْدَ رَبِّكَ وَمَا هِيَ مِنَ الظَّالِمِينَ بِبَعِيدٍ

"অতঃপর যখন আমার আদেশ এল, তখন আমি নগরগুলোকে উল্টিয়ে দিলাম এবং তাদের উপর ক্রমাগত কংকর বর্ষণ করলাম।” (১১:৮২)

“যা তোমার প্রতিপালকের নিকট চিহ্নিত ছিল। এই শাস্তি অন্যান্য সীমালঙ্ঘনকারীদের হতে দূরে নয়।" (১১:৮৩)

এই দুই আয়াতে কওমে লুতের শেষ পরিণতির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প এবং কংকর বর্ষণের ফলে লুত সম্প্রদায়ের গোটা জনপদ উলট-পালট হয়ে যায়। সব কিছুই ঐশী শাস্তিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। পবিত্র কুরআনে এই ঘটনার বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো মানবজাতিকে সতর্ক করে দেয়া। শুধু কওমে লুত নয়, যে কোন সম্প্রদায়, ব্যক্তি বা জাতি পাপের নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করবে, বিকৃতির তলানীতে গিয়ে ঠেকবে তাদেরও পরিণতি হবে কওমে লুতের অনুরূপ।