সূরা হুদ; আয়াত ৫৭-৬০
সূরা হুদের ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ مَا أُرْسِلْتُ بِهِ إِلَيْكُمْ وَيَسْتَخْلِفُ رَبِّي قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا تَضُرُّونَهُ شَيْئًا إِنَّ رَبِّي عَلَى كُلِّ شَيْءٍ حَفِيظٌ
"(হুদ বললেন)তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি যা নিয়ে তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি আমি তা তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি। আর আমার পালনকর্তা অন্য কোন সম্প্রদায়কে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন, আর তোমরা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক সমস্ত কিছুরই রক্ষণাবেক্ষণ করেন।" (১১:৫৭)
হযরত নূহ (আ.) এর সঙ্গে সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাক্য বিনিময়ের বিষয়ে এর আগে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরার ৫০ নম্বর আয়াত থেকে এ সম্পর্কিত ঘটনার বিবরণ দেয়া হয়েছে। ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,হযরত হুদ (আ.) তার সম্প্রদায়ের মাতব্বর বা সর্দার গুছের লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন,আমি তোমাদের কাছে একত্ববাদের বাণী পৌঁছানোর জন্য সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছি। ফলে আমি আমার দায়িত্ব সম্পাদন করেছি এবং এ ক্ষেত্রে আমি বিন্দুমাত্র অবহেলা করিনি। এখন তোমরা যদি তা অস্বীকার কর,অমান্য কর তাহলে জেনে রাখ এই জগতেই আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি তোমাদেরকে গ্রাস করবে। তোমরা ঐশী শাস্তিতে নিপতিত হয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ অন্য কোন জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। মহান আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সকল সৃষ্টির ওপর তার পূর্ণ আধিপত্য রয়েছে। আল্লাহর বাণী বাহক পয়গম্বরদের দায়িত্ব হচ্ছে,সত্যের ডাক মানুষের কানে পৌঁছে দেয়া। মানুষকে আল্লাহ জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়েছেন। তাই সত্যকে গ্রহণ করা বা না করার এখতিয়ার মানুষের। এর দায়ভার পয়গম্বরদের ওপর বর্তাবে না। ঈমান গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষ তার বিবেক ও বিচার-বুদ্ধিকে কাজে লাগাবে, জোর-জবরদস্তি বা প্ররোচনা এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
এই সূরার ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَلَمَّا جَاءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا هُودًا وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِنَّا وَنَجَّيْنَاهُمْ مِنْ عَذَابٍ غَلِيظٍ
"এবং যখন আমার নির্দেশ এলো, তখন আমি নিজ অনুগ্রহে হুদ এবং তার সঙ্গী ঈমানদারগণকে ক্ষমা করলাম এবং তাদেরকে কঠিন শাস্তি হতে রক্ষা করলাম।" (১১:৫৮)
হযরত হুদ (আ.) এর আহ্বান যখন তার সম্প্রদায় প্রত্যাখ্যান করলো এবং পয়গম্বরের যুক্তি প্রমাণকে উপহাস করে সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন আল্লাহর নবীকে নিয়ে পরিহাস করা শুরু করলো তখন গোটা জাতির উপর ঐশী শাস্তি নেমে এলো। সূরা ফুসসিলাতের ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, আদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার তো এই যে, তারা পৃথিবীতে অযথা দম্ভ করতো এবং বলতো আমাদের চেয়ে শক্তিশালী কে আছে? তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, যেই আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের চেয়েও শক্তিশালী? অথচ তারা আমার নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করতো। এরপর আমি তাদেরকে এই পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাবার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ঝঞ্ঝাবায়ু অশুভ দিনে প্রেরণ করে দিলাম। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু ন্যায়পরায়ন তাই তিনি হযরত হুদ ও তার ঈমানদার সহচরদেরকে ওই শাস্তি থেকে রক্ষা করেছিলেন।
এই আয়াত থেকে এটা উপলদ্ধি করা যায় যে,পাপাচারের কারণে আল্লাহর রোষে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে তখন আল্লাহ প্রিয় বান্দাদেরকে রক্ষা করেন। প্রকৃত মুমিন বিশ্বাসীরা সৃষ্টিকর্তার বিশেষ অনুগ্রহে দুর্যোগের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়।
সূরা হুদের ৫৯ ও ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَتِلْكَ عَادٌ جَحَدُوا بِآَيَاتِ رَبِّهِمْ وَعَصَوْا رُسُلَهُ وَاتَّبَعُوا أَمْرَ كُلِّ جَبَّارٍ عَنِيدٍ (59) وَأُتْبِعُوا فِي هَذِهِ الدُّنْيَا لَعْنَةً وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ أَلَا إِنَّ عَادًا كَفَرُوا رَبَّهُمْ أَلَا بُعْدًا لِعَادٍ قَوْمِ هُودٍ
"এই আদ জাতি তাদের প্রতিপালকের নিদর্শন অস্বীকার করেছিল এবং তাদের জন্য প্রেরিত রাসূলগণকে অমান্য করেছিল এবং তারা প্রত্যেকে ঔদ্ধত্য স্বৈরাচারীর নির্দেশ অনুসরণ করতো।” (১১:৫৯)
“এ পৃথিবীতে তাদেরকে অভিশাপগ্রস্ত করা হয়েছিল এবং তারা শেষ বিচারের দিনেও অভিশপ্ত হবে। জেনে রাখ, আদ জাতি তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করেছিল, ধ্বংসই ছিল হুদের সম্প্রদায় আদের পরিণাম।" (১১:৬০)
সূরা হুদের ৫০ থেকে ৬০ নম্বর আয়াতে হযরত হুদ (আ.) এর জাতি আদের আচরণ ও কার্যকলাপ বর্ণনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বক্তব্য হচ্ছে, হযরত হুদের শান্তি ও ন্যায়ের বাণী প্রত্যাখ্যান করে তার জাতি কার্যত: সমাজের ঔদ্ধত্য, উগ্র, মুনাফাখোর নেতাদের আনুগত্য করেছিল। ফলে আদ জাতি পৃথিবীতেও ঐশী শাস্তিতে নিস্পেষিত হয়েছে, পরকালেও তাদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে চির শাস্তির আবাসন জাহান্নাম। তারা তাদের সীমাহীন পাপ ও আল্লাহকে অস্বীকার করার জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে চিরকালের জন্য। আদ জাতির বসতি ছিল আরব ভূখণ্ডেরই এহকাফ অঞ্চলে। আদরা ছিল আরব এবং তারা খুব লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী ছিল। খ্রিস্টের জন্মের ৭০০ বছর আগে এই জাতি আরব ভূখণ্ডে উন্নত শহর ও জনপদ গড়ে তুলেছিল।
পবিত্র কুরআন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সময়কার আরবদেরকে আদ জাতির শক্তিমত্তা এবং তাদের ঔদ্ধত্যের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছ যে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণে লিপ্ত হলে তাদেরকেও একই পরিণতি বরণ করতে হবে।