সূরা রা’দ; (২য় পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা রা’দ; (২য় পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 5:36:15 2-10-1403

সূরা রা’দ; আয়াত ৪-৬

সূরা রা’দের ৪ নম্বর ‌আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَفِي الْأَرْضِ قِطَعٌ مُتَجَاوِرَاتٌ وَجَنَّاتٌ مِنْ أَعْنَابٍ وَزَرْعٌ وَنَخِيلٌ صِنْوَانٌ وَغَيْرُ صِنْوَانٍ يُسْقَى بِمَاءٍ وَاحِدٍ وَنُفَضِّلُ بَعْضَهَا عَلَى بَعْضٍ فِي الْأُكُلِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ

"ভূমিতে বিভিন্ন শস্যক্ষেত্র রয়েছে যা একটি অপরটির সাথে সংলগ্ন, এতে রয়েছে আঙ্গুরের বাগান, শস্য ও খেজুর বৃক্ষ। একই বা ভিন্ন জাতের ফলের জন্য একই পানি দেয়া হয়। আমি ফল অনুপাতে কোনটাকে কোনটার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি। অবশ্যই বোধ শক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।" (১৩:৪)

এর আগের কয়েকটি আয়াতে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ক্ষমতা, আকাশ, ভূপৃষ্ঠ, পর্বতমালা এবং সাগর, মহাসাগর সৃষ্টির নানা দিক বর্ণনার পর এই আয়াতে ভূমিতে উৎপন্ন শস্য ও ফল-মূল সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এখানে মানব জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে, ভূমিতে উৎপন্ন শস্য ও ফলমূল সব এক জাতের হয় না. বরং তা ভিন্ন ভিন্ন জাতের এবং বৈচিত্রময় হলেও তা একই ভূমি থেকে একই পানি সিঞ্চনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। একটি বাগানে যে শুধু একই ধরনের ফল জন্মায় তা কিন্তু নয় বরং একটি বাগানে মাটি ও রস একই হলেও দশ ধরনের ফল জন্মাতে পারে। এবং প্রত্যেক ফলের স্বাদ ও গন্ধও আলাদা হয়ে থাকে। এসবই মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তাঁর অসীম ক্ষমতা ও কুদরতেরই প্রমাণ।

সত্যিই সৃষ্টি জগতে বিদ্যমান প্রতিটি বিষয়েই চিন্তাশীল মানুষের জন্য খোরাক রয়েছে। এজন্য পবিত্র কুরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তা-গবেষণার প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মানুষ যদি সৃষ্টি জগতের অতি ক্ষুদ্র বিষয়টিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাহলে তাতে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও তাঁর অসীম ক্ষমতার প্রমাণ পাবে।

কাজেই যে সব মানুষ জগতে বিরাজমান আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত শুধু ভোগ করছে কিন্তু তার মেধা, মনন ও বিবেককে কাজে লাগাচ্ছে না পবিত্র কুরআন তাদেরকে তিরস্কার করেছে।

এই সূরার পঞ্চম আয়াতটিতে বলা হয়েছে-

وَإِنْ تَعْجَبْ فَعَجَبٌ قَوْلُهُمْ أَئِذَا كُنَّا تُرَابًا أَئِنَّا لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ الْأَغْلَالُ فِي أَعْنَاقِهِمْ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

“হে নবী! আপনি যদি বিস্মিত হন, তাহলে তাদের কথাই তো বিস্ময়কর, (যারা বলে) মাটিতে পরিণত হওয়ার পরও কি আমরা নতুন জীবন লাভ করব? তারাই তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে এবং তাদেরই গলদেশে থাকবে লৌহ-শৃংখল। তারাই নরকবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।" (১৩:৫)

এই আয়াতে আল্লাহর রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসী কাফেররা যদি আপনার নবুয়্যত বিশ্বাস করতে না চায় তাহলে আপনি বিস্মিত হবেন না,আসলে তাদের কথাই তো বিস্ময়ের ব্যাপার। তারা বলে মৃত্যুর পর মাটিতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর আবার কিভাবে আমাদেরকে জীবিত করা হবে? তাদের এতটুকু সম্বিত নেই যে, যে আল্লাহ মানুষকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন সেই আল্লাহ কি মৃত্যুর পর তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন না? সৃষ্টি করার চেয়ে পুনরুজ্জীবিত করা তো আরো সহজ ব্যাপার।

এই আয়াতে অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, সত্যবিমুতার কারণে আল্লাহর অস্তিত্বের উপরই তাদের বিশ্বাস নেই, ফলে আপনার নব্যুয়ত ও পরকালকে তো তারা অস্বীকার করবেই।

এই আয়াত থেকে আমরা এটা উপলব্ধি করতে পারি যে,আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী যে কোন মানুষ কুপ্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়,ফলে পরকালে তার জন্য নরক অবধারিত।

এছাড়া, আরেকটি বিষয় হচ্ছে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না তারা কখনো সৎ কাজ করলে তার উদ্দেশ্য হয় সম্পূর্ণ জাগতিক। ফলে আল্লাহ এ ধরনের মানুষকে এই জগতেই তার পুরুস্কার দিয়ে দিবেন,পরকালে তার জন্য কোন পুরস্কার থাকবে না, বরং কুফরীর কারণে পরকালে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এই সূরার ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَيَسْتَعْجِلُونَكَ بِالسَّيِّئَةِ قَبْلَ الْحَسَنَةِ وَقَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِمُ الْمَثُلَاتُ وَإِنَّ رَبَّكَ لَذُو مَغْفِرَةٍ لِلنَّاسِ عَلَى ظُلْمِهِمْ وَإِنَّ رَبَّكَ لَشَدِيدُ الْعِقَابِ

"তারা আপনার কাছে মঙ্গলের পরিবর্তে দ্রুত অমঙ্গল কামনা করে। যদিও তাদের পূর্বে এর বহু দৃষ্টান্ত গত হয়েছে। মানুষের সীমালঙ্ঘন সত্ত্বেও আপনার প্রতিপালক মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল এবং নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালক শাস্তিদানেও কঠোর।" (১৩:৬)

আল্লাহর রাসূল যখন হুমকির সূরে মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলতেন,যদি সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য কর এবং তাঁর অবাধ্য হও তাহলে জেনে রাখ, শুধু পরকালেই নয় ইহকালেও তোমরা তার শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না। তখন ঔদ্ধত্য কাফেররা বলত, তোমার বেহেশত আমাদের কোন প্রয়োজন নেই, যদি তোমার কথা সত্য হয়ে থাকে তাহলে এখনই ঐশী শাস্তি আনো দেখি। কাফেরদের এ ধরনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতে বলা হয়েছে, তারা শাস্তি বা অকল্যাণের জন্য খুব তাড়াহুড়া করেছিল। আল্লাহ তাদের জবাবে বললেন, তোমাদের পূর্বে অনেক জাতিই কঠিন শাস্তির মুখে ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমরা একবার তাদের পরিণতির কথা চিন্তা করে দেখ! বরং অতীত থেকে শিক্ষা নেবার চেষ্টা কর এবং শাস্তির জন্য তাড়াহুড়া করো না। তোমাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহ অত্যন্ত দয়াময়। তোমরা সুপথে ফিরে আসলে তিনি তোমাদের অতীত পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি পরম ক্ষমাশীল, মেহেরবান।

এই আয়াতে আমাদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, ঐশী শাস্তির ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং নিজেদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করা।

এখানে লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হলো, পাপাচার এবং ঔদ্ধত্যের কারণে মহান আল্লাহ সাথে সাথেই মানুষকে শাস্তি দেন না, তিনি মানুষকে সংশোধনের সুযোগ দেন। মানুষ তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।