সূরা ইউসুফ; আয়াত ৩৪-৩৬
সূরা ইউসুফের ৩৪ নম্বর এ আয়াতে বলা হয়েছে,
فَاسْتَجَابَ لَهُ رَبُّهُ فَصَرَفَ عَنْهُ كَيْدَهُنَّ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
“অতঃপর তার প্রতিপালক তার আহ্বানে সাড়া দিলেন এবং তাকে (নারীদের) ছলনা থেকে রক্ষা করলেন, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।” (১২:৩৪)
জুলেখা হযরত ইউসুফকে কারাগারে নিক্ষেপ করার হুমকি দিয়েছিল। হযরত ইউসুফও জুলেখার কুপ্রস্তাব এবং মহিলাদের কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য কিছু দিনের জন্য হলেও কারাবাসকে প্রাধান্য দিচ্ছিলেন।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বাহ্যতঃ জুলেখার নির্দেশে হযরত ইউসুফকে কারান্তরিত করা হয় কিন্তু এই আয়াতে বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে হযরত ইউসুফ নিজেকে পবিত্র রাখার জন্য কারাজীবনকে প্রাধান্য দিয়ে যে দোয়া করেছিলেন, সেই দোয়া আল্লাহতালা গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ কুরআন এখানে বলতে চাচ্ছে, আল্লাহ না চাইলে জুলেখার পক্ষে ইউসুফকে কারারুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। এখানে বিশ্বাসী মুমেনদের জন্য শিক্ষার বিষয় হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ কারো অনিষ্ট করার ক্ষমতা রাখে না। কাজেই সব ব্যাপারে মহান আল্লাহর ওপর আস্থা ও তাওয়াক্কুল থাকা উচিত। জুলেখা শাস্তি স্বরূপ হযরত ইউসুফকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল তা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কারাজীবন হযরত ইউসুফের জন্য ছিল রহমত স্বরূপ, এর ফলে তিনি নিজেকে পাপাচার থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
এই সূরার ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
ثُمَّ بَدَا لَهُمْ مِنْ بَعْدِ مَا رَأَوُا الْآَيَاتِ لَيَسْجُنُنَّهُ حَتَّى حِينٍ
"অতঃপর (ইউসুফের পবিত্রতা ও সততার) নিদর্শন দেখার পর তারা তাকে কিছু দিন কারাগারে রাখা সমীচীন মনে করল।" (১২:৩৫)
স্বৈরাচারী এবং তাগুতি শাসনের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, এখানে মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হয় না। তাগুতি শাসন ব্যবস্থায় জনগণের স্বার্থের চেয়ে রাজা ও রাজ দরবারের স্বার্থই বড় বিবেচিত হয়। এ ক্ষেত্রে বৈধ-অবৈধ বিবেচনায় আনা হয় না। ইউসুফ-জুলেখার ঘটনায় এই বাস্তবতাই লক্ষ্য করা যায়। রাজা ও রাজ দরবারে হযরত ইউসুফ নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন। এমনকি জুলেখা নিজেও অভিজাত মহিলাদের এক অনুষ্ঠানে হযরত ইউসুফের পবিত্রতার সাক্ষ্য দিয়েছে। তারপরও মিশরের রাজ দরবার রাণীর অপরাধ ঢাকা দেয়ার জন্য হযরত ইউসুফকে কারান্তরীন করার সিদ্ধান্ত নেয়। আসলে কলুষিত সমাজে পাপাচারী মানুষের দৌরাত্ম্যই বেশী। এমন সমাজে সৎ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ যাপন করেন এক ধরনের বন্দিত্ব জীবন। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, এই পৃথিবীতে ঈমানদারদের জন্য জিন্দান স্বরূপ আর অবিশ্বাসীদের জন্য তা স্বর্গরাজ্য।
এবার এই সূরার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَدَخَلَ مَعَهُ السِّجْنَ فَتَيَانِ قَالَ أَحَدُهُمَا إِنِّي أَرَانِي أَعْصِرُ خَمْرًا وَقَالَ الْآَخَرُ إِنِّي أَرَانِي أَحْمِلُ فَوْقَ رَأْسِي خُبْزًا تَأْكُلُ الطَّيْرُ مِنْهُ نَبِّئْنَا بِتَأْوِيلِهِ إِنَّا نَرَاكَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ
"ইউসুফের সঙ্গে আরো দুই যুবক কারাগারে প্রবেশ করল। তাদের একজন বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম আঙ্গুর নিঙড়ে রস বের করছি এবং অপরজন বলল, আমি দেখলাম আমার মাথায় রুটি বহন করছি এবং পাখী তা থেকে খাচ্ছে। তুমি আমাদেরকে এই স্বপ্নের তাতপর্য জানিয়ে দাও, আমরা তোমাকে সৎকর্মশীল দেখতে পাচ্ছি।" (১২:৩৬)
শেষ পর্যন্ত মিশরের রাজ দরবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হযরত ইউসুফকে কারাগারে পাঠানো হলো। তার সঙ্গে রাজ দরবারের অন্য দুই কর্মচারীকেও ভিন্ন অপরাধে কারাবন্দী করা হলো। এ দুই যুবক হযরত ইউসুফের পবিত্রতা ও সততার বিষয়টি জানতো। তাই একজন সৎ ও পরহেজগার ব্যক্তি হিসেবে হযরত ইউসুফকে খুব সম্মান করতো। একদিন ঐ দুই যুবক ঘুমের মধ্যে দু’টি স্বপ্ন দেখে হযরত ইউসুফের কাছে স্বপ্নের তাতপর্য জানতে চাইল। স্বপ্ন দু’টি ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর ও তাতপর্যপূর্ণ। একজন দেখলো আঙ্গুর চিপে মদ তৈরি করছে আর অপর জন দেখলো মাথায় করে রুটি নিয়ে যাচ্ছে আর পাখী তা ঠুকরে খাচ্ছে। ফলে দুই যুবক স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য হযরত ইউসুফের স্মরণাপন্ন হয়। হযরত ইউসুফ (আ.) কারাগারে অন্যান্য কয়েদীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তার উন্নত আচরণ প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এটাই একজন মুমেন মুসলমানের বৈশিষ্ট্য।