সূরা ইউসুফ; আয়াত ৪১-৪৩
সূরা ইউসুফের ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَمَّا أَحَدُكُمَا فَيَسْقِي رَبَّهُ خَمْرًا وَأَمَّا الْآَخَرُ فَيُصْلَبُ فَتَأْكُلُ الطَّيْرُ مِنْ رَأْسِهِ قُضِيَ الْأَمْرُ الَّذِي فِيهِ تَسْتَفْتِيَانِ
“(হযরত ইউসুফ বললেন,) হে সহবন্দী বন্ধুগণ! তোমাদের দু’জনের একজন (মুক্তি পাবে এবং) আপন মনিবকে মদ্যপান করাবে এবং দ্বিতীয় জনকে শূলে চড়ানো হবে, অতঃপর তার মস্তক থেকে পাখী আহার করবে৷ তোমরা যে বিষয়ে জানতে আগ্রহী তার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।” (১২:৪১)
এর আগে বলা হয়েছে, হযরত ইউসুফ (আ.)এর কারাবন্দী দুই সঙ্গী বিস্ময়কর যে স্বপ্ন দেখেছিল তাতে তারা স্বপ্নের ব্যাপারে মহাভাবনায় পড়ে গিয়েছিল৷ হযরত ইউসুফের পরহেজগারী এবং অন্তর্দৃষ্টির বিষয়টি তাদের অজানা ছিল না৷ তাই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলার জন্য তারা দু’জনেই হযরত ইউসুফ (আ.)কে অনুরোধ করল ৷ হযরত ইউসুফ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলার আগে এই সময় বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন ৷ তিনি তাদের সামনে শেরক্ বা অংশীবাদী বিশ্বাসের অসারতা তুলে ধরে একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়ার আহ্বান জানালেন ৷ এরপর স্বপ্নের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে গিয়ে বললেন, যে স্বপ্ন দেখেছে মদ তৈরি করছে সে কারাগার থেকে মুক্তি পাবে এবং এই পেশায় নিয়োজিত হবে ৷ আর যে স্বপ্ন দেখেছে যে, মাথার উপর রুটি রেখে পাখি তা খাচ্ছে তাকে শূলে চড়ানো হবে এবং শূলবিদ্ধ অবস্থায় তার মরদেহ এত বেশী সময় পড়ে থাকবে যে তার মাথার উপর বসে পাখী আহার গ্রহণ করবে ৷ এই দু’টি ঘটনা অবশ্যই ঘটবে এবং এত কোনোই সন্দেহ নেই৷
এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, অবিশ্বাসী কাফেরও স্বপ্নের মাধ্যমে বার্তা পেতে পারে৷ অনেক স্বপ্ন আছে যা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে৷ যারা স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারঙ্গম তারাই এসব ইঙ্গিত অনুধাবন করতে পারেন৷ আল্লাহতালা পরহেজগার ও তার মনোনীত ব্যক্তিদের এই ক্ষমতা দিয়ে থাকেন ৷
এই সূরার ৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقَالَ لِلَّذِي ظَنَّ أَنَّهُ نَاجٍ مِنْهُمَا اذْكُرْنِي عِنْدَ رَبِّكَ فَأَنْسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ فَلَبِثَ فِي السِّجْنِ بِضْعَ سِنِينَ
“হযরত ইউসুফ যাকে মুক্তি পাবে বলে মনে করলেন তাকে বললেন, তোমার মনিবের নিকট আমার কথা বলো, কিন্তু শয়তান তাকে তার মনিবের নিকট এ বিষয়ে বলার কথা ভুলিয়ে দিল৷ সুতরাং ইউসুফকে কয়েক বছর কারাগারে থাকতে হলো।” (১২:৪২)
হযরত ইউসুফকে অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক করা হয়েছিল ৷ জুলেখার সঙ্গে ঘটনার পর ইতিমধ্যে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে৷ কাজেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হযরত ইউসুফ যে বন্দীকে মুক্তি পাওয়ার সুসংবাদ দিয়েছিলেন তাকে তিনি মুক্তি পাওয়ার পর রাজার সঙ্গে তার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে বলেছিলেন৷ হযরত ইউসুফ ভেবেছিলেন, নিরপরাধ হয়েও অনেক দিনইতো তিনি কারাগারে কাটালেন৷ কাজেই রাজা বন্দীর কাছ থেকে হযরত ইউসুফ সম্পর্কে সব জানার পর হয়ত তাকে মুক্ত করে দিবেন ৷ কিন্তু কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঐ ব্যক্তি হযরত ইউসুফ (আ.)এর কথা ভুলে গিয়েছিল ৷ ফলে ইউসুফ (আ.)কে সাত বছর কারাগারে থাকতে হয়েছিল ৷
অন্যায় ও অবিচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে কেউ অন্যের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করতে পারে, এটা স্বাভাবিক৷ তবে আল্লাহর বিশেষ বান্দারা যে কোনো কিছুর চেয়ে আল্লাহর শক্তির উপর নির্ভর করেন৷
এই সূরার ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقَالَ الْمَلِكُ إِنِّي أَرَى سَبْعَ بَقَرَاتٍ سِمَانٍ يَأْكُلُهُنَّ سَبْعٌ عِجَافٌ وَسَبْعَ سُنْبُلَاتٍ خُضْرٍ وَأُخَرَ يَابِسَاتٍ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ أَفْتُونِي فِي رُؤْيَايَ إِنْ كُنْتُمْ لِلرُّؤْيَا تَعْبُرُونَ
"রাজা বলল,আমি স্বপ্নে দেখলাম সাতটি মোটাতাজা গাভী শীর্ণ গাভীকে খেয়ে যাচ্ছে এবং দেখলাম সাতটি সবুজ শীষ ও অপর সাতটি শুস্ক৷ হে পরিষদবর্গ! যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পার তবে আমার স্বপ্নের ব্যাপারে ব্যাখ্যা দাও।"(১২:৪৩)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,এই সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত চারটির স্বপ্নের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে৷ প্রথমে বাল্যকালে দেখা হযরত ইউসুফের একটি স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে৷ তবে ঐ স্বপ্নের ব্যাখ্যার বিষয়টি এখনো বলা হয়নি৷ এরপর হযরত ইউসুফের দুই কারা সঙ্গীর পৃথক পৃথক স্বপ্ন সম্পর্কে বলা হয়েছে যার সম্পর্কে হযরত ইউসুফ নিজেই বর্ণনা করেছেন, চতুর্থ স্বপ্ন যা মিশরের রাজা দেখেছেন, ৪৩ নম্বর আয়াতে সে সম্পর্কেই বলা হচ্ছে৷ মিশরের রাজা স্বপ্নে সাতটি মোটা তাজা গাভীর পাশাপাশি সাতটি সবুজ সতেজ শীষ এবং সাতটি শীর্ণ গাভীর পাশাপাশি সাতটি শুষ্ক শীষ দেখেছিল৷ কিন্তু রাজা বা রাজার সভাসদ কেউ স্বপ্নের তাতপর্য অনুধাবন করতে পারলো না৷ ফলে উদ্বেগ ও ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক তাদেরকে গ্রাস করেছিল ৷ আমরা একটু আগেও বলেছি, অর্থপূর্ণ স্বপ্নের ব্যাখ্যা যে কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়৷ কারণ এই ক্ষমতা আল্লাহ পাকের বিশেষ অনুগ্রহের ফল৷ তিনি তার বিশেষ বান্দাদেরকেই এই নেয়ামত দান থাকেন৷