সূরা ইউসুফ; (৩য় পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইউসুফ; (৩য় পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 6:26:23 2-10-1403

সূরা ইউসুফ; আয়াত ৭-১০

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা ইউসুফের ৭ ও ৮ নং আয়াতে বলেছেন:

لَقَدْ كَانَ فِي يُوسُفَ وَإِخْوَتِهِ آَيَاتٌ لِلسَّائِلِينَ (7) إِذْ قَالُوا لَيُوسُفُ وَأَخُوهُ أَحَبُّ إِلَى أَبِينَا مِنَّا وَنَحْنُ عُصْبَةٌ إِنَّ أَبَانَا لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ

“অবশ্যই ইউসুফ ও তাঁর ভাইদের কাহিনীতে (সত্য) অনুসন্ধিৎসুদের জন্যে নির্দেশনাবলী রয়েছে।” (১২:৭)

“যখন তারা বলল,অবশ্যই ইউসুফ ও তার ভাই (বেনইয়ামিন) আমাদের পিতার কাছে আমাদের চেয়ে অধিক প্রিয়,যদিও আমরা তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। নিশ্চয়ই আমাদের পিতা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছেন।” (১২:৮)

আগের পর্বে আমরা বলেছি, হযরত ইউসুফ (আ.) এর কাহিনী শুরু হয়েছে একটি স্বপ্নের ঘটনা বর্ণনার মধ্য দিয়ে। হযরত ইউসুফ (আ.) যে ভবিষ্যতে একজন মহান ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন ঐ স্বপ্নে তারই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঐ অবস্থানে পৌঁছা হযরত ইউসুফ (আ.) এর জন্য খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। অনেক প্রতিবন্ধকতা ও বিপত্তির মধ্যদিয়ে হযরত ইউসুফকে অগ্রসর হতে হয়েছিল। সত্য অনুসন্ধানীদের জন্য এখানেই অনেক শেখার বিষয় রয়েছে।

এর আগের আয়াতে হযরত ইউসুফ (আ.) এর স্বপ্নের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তবে বাস্তব যে ঘটনা এই আয়াতে বলা হয়েছে,তা হলো হযরত ইউসুফ (আ.) এর ভাইদের মধ্যে বেনইয়ামিন ছাড়া বাকিরা ছিল বৈমাত্রেয় ভাই। পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) ছোট হিসেবে হযরত ইউসুফ ও বেনইয়ামিনকে খুব স্নেহ করতেন,এটা বৈমাত্রেয় ভাইদের ভালো লাগতো না। তারা ত্রুমেই হযরত ইউসুফ (আ.) এর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো,আমরা সামর্থ্যবান যুবক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বাবা শুধু ওদের দুই জনকেই বেশি স্নেহ করে। নিশ্চয়ই আমাদের বাবা বড় ভুল করছেন। এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,পিতা-মাতার কোনো আচরণের কারণে সন্তানদের মধ্যে যাতে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি না হয় সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।

এবার সূরা ইউসুফের ৯ নম্বর আয়াতের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক:

اقْتُلُوا يُوسُفَ أَوِ اطْرَحُوهُ أَرْضًا يَخْلُ لَكُمْ وَجْهُ أَبِيكُمْ وَتَكُونُوا مِنْ بَعْدِهِ قَوْمًا صَالِحِينَ

“(বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা একে অপরকে বলল) ইউসুফকে হত্যা কর অথবা তাকে কোনো স্থানে নির্বাসন দাও,তাহলেই পিতার দৃষ্টি কেবল তোমাদের প্রতিই নিবিষ্ট হবে,তারপর তোমরা (তওবা)  করে ভালো লোক হয়ে যাবে।” (১২:৯)

ইউসুফের প্রতি পিতার বাৎসল্য বৈমাত্রেয় ভাইদের মনে এমন ভুল ধারনার জন্ম দেয় যে,তারা পিতার অধিক আনুকূল্য লাভের বাসনায় ইউসুফকে প্রয়োজনে হত্যা করার কথাও ভাবতে লাগল। তারা শলা-পরামর্শ করল,ইউসুফ হচ্ছে পথের কাঁটা তাকে অপসারণের পর আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবো। পাপের জন্য তাওবা করবো, আল্লাহও আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন,এরপর আমরা ভালো মানুষ হয়ে যাব। তারা আসলে তাওবার মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিল। যদি কেউ মনে করে যে, এখন না হয় পাপ কাজ করলাম,পরে তাওবা করে ক্ষমা চেয়ে নেব,আল্লাহ নিশ্চয়ই মাফ করে দেবেন। এ ধরনের মানসিকতা আত্ম-প্রবঞ্চনার শামিল। কারণ তাওবা হচ্ছে পাপ করে ফেলার পর অনুতাপ ও অনুশোচনার একটি পর্যায়,তাওবা পাপে লিপ্ত হওয়ার অজুহাত হতে পারে না। যাই হোক,হযরত ইউসুফ (আ.) কে হত্যা করা বা কোনো প্রান্তরে ফেলে আসার চিন্তা তৈরি হয়েছিল শয়তানের প্ররোচনার ফলেই, এর মাধ্যমে হযরত ইউসুফের প্রতি তার ভাইদের প্রচণ্ড হিংসা-বিদ্বেষেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

হিংসা-বিদ্বেষ এবং পরশ্রীকাতরতা অনেক সময় অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। হিংসার বশবর্তী হয়ে অনেক সময় মানুষ নিজ সহোদরকেও হত্যা করতে দ্বিধা করে না। হযরত ইউসুফ (আ.) ও তার ভাইদের ঘটনা ছাড়াও হযরত আদম (আ.) এর সন্তান হাবিল ও কাবিলের ঘটনা এর সাক্ষী হয়ে আছে। হিংসায় উন্মত্ত হয়ে কাবিলের হাত তার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল।

এবার এ সূরার ১০ নম্বর আয়াতের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছি:

قَالَ قَائِلٌ مِنْهُمْ لَا تَقْتُلُوا يُوسُفَ وَأَلْقُوهُ فِي غَيَابَةِ الْجُبِّ يَلْتَقِطْهُ بَعْضُ السَّيَّارَةِ إِنْ كُنْتُمْ فَاعِلِينَ

“তাদের মধ্যে একজন বলল,ইউসুফকে হত্যা করো না এবং তোমরা যদি কিছু করতেই চাও তাহলে তাকে কোনো গভীর কূপে ফেলে দাও,যাতে কোনো পথিক তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।” (১২:১০)

হযরত ইউসুফকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে তার বৈমাত্রেয় ভাইদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। কারণ সবার মনে বিদ্বেষের মাত্রা এক রকম ছিল না। একজন বলল, ইউসুফতো আমাদের ভাই,কাজেই তার রক্তে নিজেদেরকে কলূষিত না করে বরং তাকে কোনো গভীর কূপে ফেলে দেয়া হোক,কোন পথিক কূপ অতিত্রুম করার সময় নিশ্চয়ই তার সন্ধান পাবে এবং তাকে তারা সঙ্গে করে দূর কোনো দেশে নিয়ে যাবে।

এই প্রস্তাব অন্যদের মনপুত হলো ফলে হযরত ইউসুফ (আ.) মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেন। অনেক সময় একটি ছোট ঘটনাই ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ইউসুফ (আ.) কে হত্যার ব্যাপারে তার কোনো এক ভাইয়ের বিরোধিতার কারণে তিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর এক সময় হযরত ইউসুফ (আ.) মিশরের রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেন এবং নিজের আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে দেশের মানুষকে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। একই ধরনের আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া। তিনি আল্লাহর নবী হযরত মুসা (আ.)কে হত্যায় বাধা দেন,পরবর্তীতে হযরত মুসা (আ.) তার সম্প্রদায় বনি ইসরাইলকে অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের হাত থেকে উদ্ধার করেন।