সূরা হিজর;(৩য় পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা হিজর;(৩য় পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 6:30:54 2-10-1403

সূরা হিজর; আয়াত ১২-২০

সূরা হিজরের ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :

كَذَلِكَ نَسْلُكُهُ فِي قُلُوبِ الْمُجْرِمِينَ (12) لَا يُؤْمِنُونَ بِهِ وَقَدْ خَلَتْ سُنَّةُ الْأَوَّلِينَ (13(

"এভাবে আমরা অপরাধীদের অন্তরে কুরআন সঞ্চার করি।” (১৫:১২)

“কিন্তু ওরা কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে না এবং অতীতে পূর্ববর্তীগণের আচরণও এরূপ ছিল।"(১৫:১৩)

আগের পর্বে পবিত্র কুরআন নাযিল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে কুরআনের আয়াতকে যিকরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, অতীতের জাতিগুলোর অনেকে আল্লাহর বাণী শুনে উপলব্ধি করলেও তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেনি। পবিত্র কুরআনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বহু মানুষ এই মহাগ্রন্থের বাণী শুনে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরও তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এই দুই আয়াতে দু'টি ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে। একটি হচ্ছে মহান আল্লাহ নিজ দায়িত্বে সকল মানুষের কাছে সত্যবাণী পৌছে দেন যাতে কোন কাফের কিয়ামত বা শেষ বিচারের দিন বলতে না পারে যে, আমরা আল্লাহর কথা শুনিনি। দ্বিতীয়তঃ সত্য যত স্পষ্টই হোক না কেন অপরাধী ও অবিশ্বাসী কাফেররা তা গ্রহণ করে না। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় এ ধরনের মানুষ ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। অপরাধ করতে করতে এসব মানুষের অন্তর এতটা কলুষিত হয়ে যায় যে, সত্য উপলব্ধি করলেও তা গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা আর তার থাকে না।

এই সূরার ১৪ ও ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَوْ فَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَابًا مِنَ السَّمَاءِ فَظَلُّوا فِيهِ يَعْرُجُونَ (14) لَقَالُوا إِنَّمَا سُكِّرَتْ أَبْصَارُنَا بَلْ نَحْنُ قَوْمٌ مَسْحُورُونَ (15(

"যদি ওদের জন্য আকাশের একটি দ্বার খুলে দেই এবং ওরা তাতে আরোহণ করে।”(১৫:১৪)

“তবুও ওরা বলবে : আমাদের দৃষ্টি মোহাবিষ্ট হয়েছে, নতুবা আমাদের জাদু করা হয়েছে।" (১৫:১৫)

সূরা হিজরের শুরুতে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসী কাফেররা বিশ্বনবী (সা.)'র কাছে দাবি করেছিল, তিনি যেন তাঁর কাছে ফেরেশতা আসার বিষয়টিকে কাফেরদের দেখান। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, মহান আল্লাহ যদি আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন এবং ফেরেশতাদের বসবাসের স্থানকে তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষও করে, তবুও তারা ঈমান আনবে না। কারণ, সেক্ষেত্রে তারা বলবে তাদের চোখকে জাদুমন্ত্রের মাধ্যমে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। তারা বলবে, তারা যা দেখছে তা অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-

এক. সত্য গ্রহণ করার জন্য তা জানা ও উপলব্ধি করেই যথেষ্ট নয়। কারণ, গোয়ার্তুমি ও হঠকারিতার কারণে বহু মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেনি।

দুই. যে সত্যকে গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সামনে সবচেয়ে বড় মোজেযা বা অলৌকিক ঘটনা তুলে ধরা হলেও সে তাকে জাদুমন্ত্র বলে উড়িয়ে দেবে।

সূরা হিজরের ১৬ থেকে ১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন –

وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ (16) وَحَفِظْنَاهَا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ رَجِيمٍ (17) إِلَّا مَنِ اسْتَرَقَ السَّمْعَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ مُبِينٌ (18(

"নিশ্চয়ই আমরা আকাশে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছি এবং দর্শকদের জন্য তাকে করেছি সুশোভিত।” (১৫:১৬)

“আমরা প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান থেকে আকাশকে নিরাপদ করে দিয়েছি।” (১৫:১৭)

“আর কেউ চুরি করে আকাশের সংবাদ জানাতে চাইলে প্রদীপ্ত উল্কাপিণ্ড তার পশ্চাদ্ধাবন করে।" (১৫:১৮)

আগের আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, কাফের ও বিরুদ্ধবাদীদের আকাশের দরজা খুলে দিয়ে ফেরেশতাদের কথাবার্তা শোনার সুযোগ দিলেও তারা ঈমান আনতো না। এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে, অবশ্য ফেরেশতাদের রাজ্যে প্রবেশ করা এত সহজ ব্যাপার নয়। কারণ, শয়তান সেখানে গিয়ে অদৃশ্য খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করলেও আল্লাহ সে অনুমতি তাকে দেননি। শয়তান আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয় এবং জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের আঘাতে আকাশ থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়। মহান আল্লাহ আকাশকে অনেক সুন্দর ও সুষমামণ্ডিত করে সৃষ্টি করেছেন। বিশেষ করে প্রতিটি দর্শকের চোখে রাতের আকাশ অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর হিসেবে বিবেচিত হয় যা অদ্বিতীয় পালনকর্তার অসংখ্য করুণার অন্যতম নিদর্শন।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে-

প্রথমতঃ মহাকাশের অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্র এবং নির্দিষ্ট কক্ষপথে তাদের ঘুর্ণন আল্লাহর একত্ববাদের অন্যতম নিদর্শন।

দ্বিতীয়তঃ কুচক্রি কোন ব্যক্তি জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আড়িপাতার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে সমাজ ও রাষ্ট্র গুপ্তচরবৃত্তির ভয়াল ছোবল থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

এই সূরার ১৯ ও ২০ নম্বর বলা হয়েছে-

وَالْأَرْضَ مَدَدْنَاهَا وَأَلْقَيْنَا فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْبَتْنَا فِيهَا مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَوْزُونٍ (19) وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ وَمَنْ لَسْتُمْ لَهُ بِرَازِقِينَ (20(

“পৃথিবীকে আমরা বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি এবং পৃথিবীতে প্রত্যেক বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি।” (১৫:১৯)

“তাতে তোমাদের এবং তোমরা যাদের জীবিকাদাতা নও তাদের প্রত্যেকের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি।" (১৫:২০)

সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অপরিসীম ক্ষমতা বর্ণনার পর এই আয়াতে মানুষের জন্য আল্লাহর অসংখ্য করুণা ও নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পাহাড়পর্বত থেকে শুরু করে বিশাল প্রান্তর, মরুভূমি ও সাগর-মহাসাগরসহ পৃথিবীর সমস্ত কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও অতি সূক্ষ্ম পরিকল্পনার ভিত্তিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। দৈবক্রমে বা কোনরকম চিন্তা-ভাবনা ছাড়া এগুলো সৃষ্টি করা হয়নি। আল্লাহ তার বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলছেন, তোমাদের জীবনের চাহিদাগুলো পূরণের লক্ষ্যে এসব সৃষ্টি করা হয়েছে। অবশ্য তোমরা ছাড়াও ভূপৃষ্ঠে আরো অনেক প্রাণী ও জীবজন্তু রয়েছে যাদের প্রত্যেকের আহার ও অন্যান্য চাহিদাও আমি মিটিয়ে থাকি।

এই দুই আয়াত থেকে বোঝা যায়, ভূপৃষ্ঠ থেকে উদ্ভিদের চারা গজিয়ে ওঠা আল্লাহর অন্যতম মহান করুণা। উদ্ভিদের অংকুরোদগম না হলে এই মাটির কোন মূল্যই থাকতো না। এছাড়া অফুরন্ত দয়ার আধার আল্লাহ মানুষ ও অন্য সকল সৃষ্টির ভরণপোষণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা প্রকৃতিতে দিয়ে রেখেছেন। যদি কোথাও কোন অন্যথা চোখে পড়ে, তা মানুষের ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়নের কারণে হয়।