সূরা ইউসুফ; আয়াত ৪-৬
সূরা ইউসুফের ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
إِذْ قَالَ يُوسُفُ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ إِنِّي رَأَيْتُ أَحَدَ عَشَرَ كَوْكَبًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ رَأَيْتُهُمْ لِي سَاجِدِينَ
“ইউসুফ তার পিতাকে বলেছিল,হে আমার পিতা! আমি এগারটি নক্ষত্র,সূর্য ও চন্দ্রকে দেখেছি- দেখেছি ওরা আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায় রয়েছে।” (১২:৪)
পবিত্র কুরআনে হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা শুরু হয়েছে একটি স্বপ্নের ঘটনা বর্ণনার মধ্যদিয়ে। প্রকৃতপক্ষে স্বপ্ন ছিল হযরত ইউসুফের প্রতি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, স্বপ্ন তিন ধরনের। কোনো কোনো স্বপ্নে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে সুসংবাদ দেয়া হয়। অনেক সময় মানুষ শয়তানের পক্ষ থেকে স্বপ্ন দেখে যা হতাশা এবং দুঃখ-দুর্দশার পরিপূর্ণ থাকে। তৃতীয় ধরনের স্বপ্ন হচ্ছে যা মানুষের দৈনন্দিন আচার -আচরণ, সমস্যা ইত্যাদি তার স্বপ্নে প্রতিফলিত হয়। তবে ওলি-আউলিয়া এবং পবিত্র ব্যক্তিরা যে স্বপ্ন দেখেন তা সত্য; যেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী বা এলহামের মত। যেমন হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখেছিলেন, তিনি নিজ পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানী করছেন। এসব স্বপ্নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ঘটবে এমন কিছুর পূর্বাভাস দেয়া হয়। হযরত ইউসুফ (আ.)-এর স্বপ্নও ছিল একই রকম তাতপর্যমণ্ডিত যা আমরা আরো পরে আলোচনা করব। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, অনেক সময় স্বপ্নের মাধ্যমেও সঠিক দিক-নির্দেশনা লাভ করা যায়। পবিত্র মনের অধিকারী পরহেজগার ব্যক্তিরা এ ধরনের দিক-নির্দেশনা লাভ করে থাকেন। এবারে সূরা ইউসুফের ৫ নম্বর আয়াতের ওপর আলোচনা করব। এ আয়াতে বলা হয়েছে:
قَالَ يَا بُنَيَّ لَا تَقْصُصْ رُؤْيَاكَ عَلَى إِخْوَتِكَ فَيَكِيدُوا لَكَ كَيْدًا إِنَّ الشَّيْطَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوٌّ مُبِينٌ
“তিনি (অর্থাত হযরত ইয়াকুব আ.) বললেন, হে আমার পুত্র, তোমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত তোমার ভাইদের সামনে বর্ণনা করো না,করলে (তারা) তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” (১২:৫)
হযরত ইউসুফ (আ.)-এর পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.)ও আল্লাহর নবী ছিলেন, তাই তিনি স্বপ্নের বর্ণনা শুনে বুঝতে পারলেন যে, এটা সাধারণ কোনো স্বপ্ন নয় বরং ভবিষ্যতে হযরত ইউসুফ (আ.) একজন আদর্শ ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন। কাজেই তিনি ভাইদের কাছে এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত না বলার জন্য ইউসুফকে সাবধান করে দিলেন। কারণ স্বপ্নের তাতপর্য অনুধাবন করে ভাইয়েরা হযরত ইউসুফের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ক্ষতি করতে পারে। পরিবারে একাধিক সন্তান থাকলে বিভিন্ন কারণে নিজেদের মধ্যে জেদ বা বিদ্বেষের জন্ম হতে পারে। কাজেই পিতা-মাতা এবং সন্তান সবারই দায়িত্ব হচ্ছে, একজনের প্রশংসা অন্যদের সামনে বর্ণনা না করা। এ জন্যই হযরত ইউসুফ (আ.) অন্য ভাইদের আড়ালে পিতা ইয়াকুব (আ.) কে তার স্বপ্নের কথা জানান এবং হযরত ইয়াকুব (আ.)ও স্বপ্ন বৃত্তান্ত অন্যদেরকে বলতে নিষেধ করেন।
সূরা ইউসুফের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَكَذَلِكَ يَجْتَبِيكَ رَبُّكَ وَيُعَلِّمُكَ مِنْ تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ وَيُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَعَلَى آَلِ يَعْقُوبَ كَمَا أَتَمَّهَا عَلَى أَبَوَيْكَ مِنْ قَبْلُ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ إِنَّ رَبَّكَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
“এভাবে তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করবেন এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবেন এবং তোমার প্রতি ও ইয়াকুবের পরিবার পরিজনের প্রতি তার অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন যেভাবে তিনি তোমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম ইসহাকের প্রতি তা পূর্ণ করেছিলেন। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।” (১২:৬)
এই আয়াতে বলা হচ্ছে, হযরত ইয়াকুব (আ.) তার পুত্র ইউসুফকে বললেন, হে পুত্র, মহান আল্লাহ ভবিষ্যতে তোমাকে পয়গম্বর হিসেবে মনোনীত করবেন এবং আমাদের বংশের প্রতি তার বিশেষ অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন। তিনি তোমাকে স্বপ্নের তাতপর্য ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবেন। হযরত ইয়াকুব (আ.) নবী হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ঐশী জ্ঞান বা “এলমে গাইব” লাভ করেছিলেন তারই ভিত্তিতে তিনি হযরত ইউসুফকে তার ভবিষ্যত সম্পর্কে অবহিত করেন। এছাড়া হযরত ইউসুফের স্বপ্নেও এ সম্পর্কে ইঙ্গিত ছিল। আল্লাহ রাব্বুল-আলামিন যাদেরকে নবী হিসেবে মনোনীত করেন তাদেরকে তিনি পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেন, যাতে তারা মানব জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারেন।