সূরা ইব্রাহীম; আয়াত ৪-৬
সূরা ইব্রাহীমের ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
“আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, (আল্লাহর বাণী) তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎ পথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাময়।" (১৪:৪)
এর আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যারা এই নশ্বর জগতকে চিরস্থায়ী জগতের ওপর প্রধান্য দেয় এবং পার্থিব ভোগ-বিলাসিতাই যাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য তারা কখনোই আল্লাহর দ্বীনকে গ্রহণ করবে না। নবী রাসূলদের আহ্বান তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারবে না। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রত্যেক জাতির নিকট একই ভাষাভাষীর নবী বা রাসূল পাঠিয়েছেন। নবী রাসূলগণও তাদের জাতির শিক্ষা ও সামর্থের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে অত্যন্ত বোধগম্য করে তাদের সাথে কথা বলেছেন, সত্যের বাণী তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তা'লা স্বজাতি বা স্বভাষী নবী এজন্য পাঠিয়েছেন যাতে কেউ এটা বলতে না পারে যে আমরা নবীর ভাষা বুঝতে পারিনি।
এরপরও মানুষ যখন তার চোখ ও কান বন্ধ করে রাখে এবং সত্য উপলব্ধির জন্য নিজের বিচার-বুদ্ধিকে কাজে লাগাবার মোটেও তাগিদ অনুভব করে না তখন সে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়। এর পরিণতিতে তার ওপর নেমে আসে নানা আপদ-বিপদ। ঐশী শাস্তি হিসেবেই এই সব আপদ-বিপদ বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ঠ মানুষকে গ্রাস করে নেয়। অপর দিকে সত্য সন্ধানীরা নবী-রাসূলদের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের আত্মাকে হেদায়েতের নূরে আলোকিত করে এবং পার্থিব জীবনকে তারা সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে নেয় ফলে তাদের পরিণতি হয় অত্যন্ত শুভ ও স্বাচ্ছন্দময়। এটাই ইহকালে মুমিনদের প্রতি ঐশী পুরস্কার।
কাজেই এই আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে বিভ্রান্ত করেন'-এর অর্থ হচ্ছে, কিছু মানুষ হঠকারিতা ঔদ্ধত্যের কারণে আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে এবং জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে আল্লাহ তা'লা অত্যাচারী ও অপব্যয়ী ব্যতিত অন্য কাউকে বিভ্রান্ত করেন না। এই আয়াত থেকে বুঝা যায় পাপাচারী এবং জালিম হেদায়েতের নূর লাভের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে যদি শাব্দিক অর্থে বিভ্রান্তই করতে চাইতেন তাহলে নবী-রাসূল এবং ঐশী গ্রন্থ মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রেরণ করতেন না। কিন্তু আমরা দেখতে পাই মহান আল্লাহ মানুষকে সুপথে আনার জন্য যুগে যুগে তার প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন, ঐশী গ্রন্থ পাঠিয়েছেন। কিন্তু কিছু মানুষ সত্য বাণীর প্রতি উদাসীন থেকেছে এবং সঠিক পথ বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই আয়াত থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, নবী-রাসূলরা অত্যন্ত সহজ ভাষায় দ্বীনের দাওয়াত দিতেন এবং তাদের ভাষা ও বক্তব্য সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের জন্যই বোধগম্য ছিল। এই আয়াতের আরেকটি দিক হচ্ছে, মানুষ পাপাচারীই হোক কিংবা সৎকর্মশীলই হোক মহান আল্লাহ সকলের ব্যাপারে তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী আচরণ করেন। মানুষের পরিণতি তার কৃতকর্মের ভিত্তিতেই সাব্যস্ত হয়ে থাকে ।
এই সূরার ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآَيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ اللَّهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ
"মূসাকে আমি আমার নিদর্শনাবলীসহ প্রেরণ করেছিলাম। (এবং বলেছিলাম) তোমার সম্প্রদায়কে অন্ধকার হতে আলোতে আনয়ন কর এবং তাদেরকে আল্লাহর দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দাও। পরম ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে।" (১৪:৫)
নবী- রাসূলগণ অত্যন্ত বোধগম্য ও সাবলীলভাবে মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী উপস্থাপন করতেন, আগের আয়াতে এ সম্পর্কে আলোচনার পর এই আয়াতে ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে হযরত মুসা (আ) এর ভূমিকা ও পদ্ধতি সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে ।
এখানে বলা হয়েছে, তিনি মানুষকে ফেরাউনের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য এবং মানুষকে প্রতিমা পুজার গ্লানি থেকে রেহাই দেয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন, তার দাবি যে সত্য তা প্রমাণ করার জন্য তিনি মানুষের সামনে অনেক অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করেছেন, তারপরও তার সম্প্রদায়ের মানুষ কখনো তার কথা মান্য করেছে আবার কখনো তার উপদেশ মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। কাজেই হযরত মুসা (আ.) এর নব্যুয়ত কালের দিকে তাকালে দেখা যায়, কখনো মানুষ আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত ও কল্যাণের অধিকারী হয়েছে আবার কিছুকাল আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে বড় বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। এই আয়াতে এই দিনগুলোকে "আল্লাহর দিন" হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। মানুষ যাতে সতর্ক এবং অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সেজন্য সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
বনি ইসরাইল সম্প্রদায় একবার আল্লাহর অসিম মেহেরবাণীতে নীল নদ অতিক্রম করতে সক্ষম হয় আর তাদের শত্রুরা নদীতে নিমজ্জিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আরেকবার বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার কারণে চল্লিশ বছর মরু প্রান্তরে কঠিন জীবন যাপন করতে হয়। ওই দুই ঘটনায় মানুষের জন্য অনেক শিক্ষণীয় আছে- যা এই আয়াতে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মানুষের ধৈর্য শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের মনে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অনুগ্রহের নানা দিক ধরা দেয়। ফলে তার মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নেয়।
এই সূরার ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ أَنْجَاكُمْ مِنْ آَلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ وَيُذَبِّحُونَ أَبْنَاءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ نِسَاءَكُمْ وَفِي ذَلِكُمْ بَلَاءٌ مِنْ رَبِّكُمْ عَظِيمٌ
"(স্মরণ কর) মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলেন ফেরাউনী সম্প্রদায়ের কবল থেকে, যারা তোমাদেরকে মর্মান্তিক শাস্তি দিত, তোমাদের পুত্রদেরকে খুন করতো এবং তোমাদের নারীদেরকে জীবিত রাখতো এবং এতে ছিল তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক মহা পরীক্ষা।" (১৪:৬)
এই আয়াতে ইয়াহুদ সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, জ্যোতিষদের কাছ থেকে জানার পর হযরত মুসার জন্ম ঠেকানোর জন্য ফেরাউন নির্দেশ দিয়েছিল বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ে কোন ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে যেন হত্যা করা হয় । ফেরাউন বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের পুরুষদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করতো, তাদেরকে সামান্য কারণে হত্যা করতো। মেয়েদেরকে দাসী বানাতো, এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য বড় পরীক্ষা।