সূরা রা’দ; আয়াত ৪২-৪৩
সূরা রা’দের ৪২ নং আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقَدْ مَكَرَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلِلَّهِ الْمَكْرُ جَمِيعًا يَعْلَمُ مَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ وَسَيَعْلَمُ الْكُفَّارُ لِمَنْ عُقْبَى الدَّارِ
"তাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তারাও চক্রান্ত করেছিল কিন্তু সমস্ত চক্রান্ত আল্লাহর অধীন। প্রত্যেক ব্যক্তি যা করে তিনি তা জানেন এবং পরকালের আবাস কাদের জন্য তা অবিশ্বাসী কাফেররা অচিরেই জানতে পারবে।" (১৩:৪২)
এর আগের আয়াতে আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, মক্কার কাফের-মুশরিকরা আপনার বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হলে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ আপনার পূর্ববর্তী নবী-রাসূলরাও প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখোমুখী হয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালা ইহকাল ও পরকালে তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত প্রতিদান প্রদান করবেন।
এই আয়াতে বলা হচ্ছে, অবিশ্বাসী কাফেররা ঐশী শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য নানা রকম ফন্দি-ফিকিরে লিপ্ত হয়। তারা আল্লাহকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে! অথচ তারা একবারও ভাবে না সব কিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের অধীনে। তারা আল্লাহকে ফাঁকি দিতে চায়, অথচ তাদের মাথায় এটা নেই যে আল্লাহ মানুষের মনের খবরও জানেন।
আল্লাহ তায়ালা কাফের অবিশ্বাসীদেরকে কৃতকর্মের অনুশোচনা এবং সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য সুযোগ দেন। অনেকেই এই সুযোগের অপব্যবহার করে এবং মনে করে আমাদের উপর আল্লাহর গজব না আসার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ আমাদের কাজকর্মে সন্তুষ্ট। কি অদ্ভুত! মানুষ তার এত অপূর্ণতা এবং দুর্বলতা নিয়ে মহাপরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়। অথচ মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই হলেন শক্তি,ক্ষমতা এবং সম্মান দেয়ার প্রকৃত মালিক। ফলে যারা তাঁর বিরুদ্ধে এবং তাঁর দেয়া বিধানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তাদের জন্য ঐশী শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়।
অনেক মানুষ মনে করে আল্লাহকে বুঝি ফাঁকি দেয়া সম্ভব। তারা এটা ভাবে না যে ফাঁকি তাকেই দেয়া সম্ভব যার জ্ঞান সীমিত। আল্লাহ যে সর্বজ্ঞানী এবং তাঁর জ্ঞনের যে কোন সীমা নেই তা তারা ভাবতেও পারে না।
এই আয়াতের আরেকটি শিক্ষা হচ্ছে, অবিশ্বাসী কাফেরদেরকে অনুসরণ করা উচিত নয়। নিজের বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করা উচিত এবং যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কাফেরদের পরিণতির বিষয়টিও বিবেচনায় আনা দরকার।
সূরা রা’দের ৪৩ নম্বর বলা হয়েছে,
وَيَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَسْتَ مُرْسَلًا قُلْ كَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَمَنْ عِنْدَهُ عِلْمُ الْكِتَابِ
“কাফের অবিশ্বাসীরা বলে আপনি আল্লাহর প্রেরিত ব্যক্তি নন, বলুন আল্লাহ এবং যাদের কাছে ঐশী গ্রন্থের জ্ঞান আছে তারা আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসাবে যথেষ্ট।” (১৩:৪৩)
কাফের মুশরিকরা যে নবী করিম (দ.) এর তীব্র বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হয়েছিল এবং কিছুতেই যে তারা হযরত মুহাম্মদ (দ.) কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে মেনে নিচ্ছিল না। সূরা রা’দের শেষ এই আয়াতটিতে তারই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। এই সূরার শুরুতেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল এবং ঈমানদারদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, রাসূলের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা পরম সত্য। তবে বহু মানুষই তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে না। কাজেই অবিশ্বাসীদের কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজেদের ঈমানের ব্যাপারে কেউ যেন সন্দিহান হয়ে না পড়ে।
এই আয়াতে আল্লাহ পাক তার রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,হে রাসূল! আপনি কাফেরদেরকে বলে দিন আমি তো তোমাদের অনুমোদন নিয়ে রাসূল হইনি যে তোমাদের বিরুদ্ধাচরণের কারণে আমি আমার দায়িত্ব পালনে বিরত থাকব! আল্লাহ তায়ালা আমাকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন, ঐশী গ্রন্থের ব্যাপারে যার জ্ঞান আছে সে অবশ্যই আমার আহ্বানে সাড়া দেবে, এমন ব্যাক্তি একজন হলেও তা আমার জন্য যথেষ্ট।
বিভিন্ন হাদিসের ভাষ্য থেকে বুঝা যায় যে ঐশী গ্রন্থের ব্যাপারে জ্ঞানের অধিকারী বলতে এখানে হযরত আলী (আ.)কে বুঝানো হয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায় হযরত আলীই প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। আলীর মত একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির ঈমান যে হাজারও মুশরিক বা মুনাফিকের ঈমানের চেয়ে উত্তম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আলী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আবেগ কিংবা কারো প্রভাবের বশবর্তী হয়ে নয়,তিনি রাসূল (দ.) এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে।
(সূরা রা’দ সমাপ্ত)