সূরা ইব্রাহীম; আয়াত ১-৩
সূরা ইব্রাহীম পবিত্র কুরআনের ১৪তম সূরা। এই সূরায় মোট ৫২টি আয়াত রয়েছে। এই সূরার অধিকাংশ আয়াত হিজরতের আগে মক্কা শরীফে অবতীর্ণ হয়েছে। এতে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে বলে এর নামকরণ করা হয়েছে সূরা ইব্রাহীম।
এই সূরার এক নম্বর আয়াতের বলা হয়েছে,
الر كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ
"আলীফ লাম রা, এটি ঐশী গ্রন্থ যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশে অন্ধকার (অজ্ঞতা) থেকে আলোকে (ঈমান) বের করে আনেন। তাঁর পথে যিনি পরাক্রমশালী, প্রশংসারযোগ্য।" (১৪:১)
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে নবী-রাসূল এবং ঐশী গ্রন্থ পাঠানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে কুপ্রবৃত্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা এবং তাদেরকে খোদাদ্রোহী তাগুতি শাসকের হাত থেকে উদ্ধার করা। এছাড়া সমাজ থেকে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত প্রথা অপসারণ করাও নবী-রাসূলদের বড় একটি দায়িত্ব। এই বিষয়গুলো যে সমাজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে সেখানে একত্ববাদী বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে এবং মানুষ অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ধাবিত হবে।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পবিত্র কুরআনের সর্বত্র জুলুমাত অর্থাৎ অন্ধকার শব্দটি বহুবচন এবং নূর বা আলো শব্দটি একবচন ব্যবহৃত হয়েছে। এর দ্বারা হয়ত এটা বুঝানো হয়েছে যে, শিরক, কুফরি এবং কপটতার মত ভ্রান্ত পথ যা মানুষকে অন্ধকারের দিকে পরিচালিত করে তার সংখ্যা একাধিক কিন্তু সত্য বা আলোর পথ একটিই, যা নবী-রাসূলগণ প্রদর্শন করে গেছেন।
এই আয়াত থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, মানুষকে সুপথে পরিচালিত করার জন্য শুধু ঐশী গ্রন্থ যথেষ্ট নয়। এজন্য নবী-রাসূল বা ধর্মীয় নেতৃত্বেরও প্রয়োজন। যারা মানুষের জন্য বাস্তব আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবেন।
এছাড়া, ঐশী ধর্মগুলোর মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাপাচার,অজ্ঞতা ও অনৈক্যের অন্ধকার থেকে মানুষকে মুক্ত করে তাকওয়া, মৈত্রী এবং জ্ঞানের নূরের দিকে পরিচালিত করা।
সূরা ইব্রাহীমের দুই নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
اللَّهِ الَّذِي لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَوَيْلٌ لِلْكَافِرِينَ مِنْ عَذَابٍ شَدِيدٍ
"তিনিই আল্লাহ, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব কিছুই তাঁর। অবিশ্বাসীদের জন্য কঠিন শাস্তির দুর্ভোগ রয়েছে।" (১৪:২)
এই সূরার প্রথম আয়াতে মানুষের জন্য ঐশী গ্রন্থের অপরিহার্যতার কারণ ব্যাখ্যা দেয়ার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, তিনিই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে। তিনি প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান মানুষের জন্য প্রেরণ করেছেন। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে মানুষের মধ্যে অনেকেই স্বীয় স্রষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। এমনকি কেউ কেউ স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারেই সন্দিহান, তারা ঐশী বিধানকেও অস্বীকার করে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই শ্রেণীর মানুষের কথায় কোন যুক্তি নেই। তাদের কথা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তারা নফস বা কুপ্রবৃত্তির প্রভাব দ্বারা আচ্ছন্ন। কাজেই এটা সুস্পষ্ট যে কুপ্রবৃত্তি মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত করে যার পরিণতিতে ব্যাক্তি বা সমাজ জীবণে তারা নানা দূর্যোগে নিপতিত হয়।
এই আয়াতের শিক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের পরিবর্তে মানব রচিত বিধান উপস্থাপন করা কুফরির শামিল।
আল্লাহকে অস্বীকার করলে এতে আল্লাহর কোন ক্ষতি হয় না, যেমন সূর্যকে অস্বীকার করা হলে তাতে সূর্যে অস্তিত্ব বিপন্ন হয় না।
এই সূরার তিন নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
الَّذِينَ يَسْتَحِبُّونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآَخِرَةِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا أُولَئِكَ فِي ضَلَالٍ بَعِيدٍ
“যারা পার্থিব জীবনকে পরকালীন জীবণের উপর প্রাধান্য দেয়,(মানুষকে) আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করে এবং তাতে বক্রতা অন্বেষণ করে তারাই তো ঘোর বিভ্রান্তিতে রয়েছে।” (১৪:৩)
এই আয়াতে নবী-রাসূলদের সাথে কাফেরদের বিরুদ্ধাচরণের কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, প্রবৃত্তির দাসত্ব এবং দুনিয়ার জীবনের প্রতি প্রচণ্ড মোহের কারণে কাফের মুশরিকরা ঐশী গ্রন্থ বা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান মেনে নিতে পারে না। তাদের কাছে পার্থিব সুখ ও সচ্ছলতাই মূখ্য। ফলে তাদের কাছে দ্বীন বা ধর্মীয় অনুশাসন খুব কঠিন মনে হয়। দ্বীনি অনুশাসনকে তারা তাদের ভোগ বিলাসিতার জন্য অন্তরায় মনে করে। ধর্মীয় অনুশাসন লাগামহীন ভোগ বিলাসিতাকে প্রশ্রয় দেয় না। কাজেই আত্মকেন্দ্রীক স্বার্থপর ভোগবাদীরা যে ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধাচরণ করবে এটাই স্বাভাবিক।