সূরা নাহল; আয়াত ৩৫-৩৭
সূরা নাহলের ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেছেন,
وَقَالَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا عَبَدْنَا مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ نَحْنُ وَلَا آَبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ فَعَلَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
“মুশরিকরা বলল, যদি আল্লাহ চাইতেন,তবে আমরা এবং আমাদের পিতৃপুরুষেরা তাঁকে ছাড়া কারও এবাদত করতাম না এবং তাঁর নির্দেশ ছাড়া কোন বস্তুই আমরা হারাম বা নিষিদ্ধ করতাম না। তাদের পূর্ববর্তীরা এমনই করেছে। রাসূলের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া।" (১৬:৩৫)
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে মুশরিক বা অংশবাদীরা বলতে চেয়েছে, আল্লাহর ইচ্ছায়ই আমরা মুর্তি পুজা করি, তা না হলে আমরা কেবল তারই উপাসনা করতাম। মুশরিকদের এ জাতীয় কথার প্রতি পবিত্র কুরআনের আরো কয়েক জায়গায় ইঙ্গিত করা হয়েছে।
তাদের এসব কথা যুক্তিপূর্ণ নয় বরং গোঁয়ার্তুমি এবং হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে তারা এসব কথা বলে থাকে। কারণ প্রকৃতির দিকে মনোনিবেশ করলে এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হবে না যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সত্য এবং মিথ্যা বুঝার জন্য তিনি মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি দান করেছেন, মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। তিনি মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি এবং চিন্তার স্বাধীনতা এজন্যে দিয়েছেন যাতে মানুষ স্বাধীনভাবে সত্য পথ বেছে নিতে পারে। এজন্য আল্লাহ তায়ালা কোন মানুষকে সত্য পথ গ্রহণের জন্য বাধ্য করেন না তেমনি কাউকে তিনি নিজ থেকে বিভ্রান্তও করেন না। ঈমানের পথ কিংবা শিরকের পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবে, আল্লাহ তায়ালা যেহেতু মানুষের হেদায়েতের জন্য যাবতীয় বন্দোবস্ত করেছেন, তাই তিনি চান না মানুষ বিভ্রান্তিতে নিপতিত হোক।
এই আয়াত থেকে এটাই সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কারো ওপর জোর করে ধর্ম বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, নবী-রাসূলদের দয়িত্ব হচ্ছে সত্যের বাণী মানুষের কাছে পৌছে দেয়া, তা গ্রহণ করার জন্য চাপ দেয়া বা বাধ্য করা তাদের দায়িত্ব নয়।
এই সূরার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ فَمِنْهُمْ مَنْ هَدَى اللَّهُ وَمِنْهُمْ مَنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلَالَةُ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ
“আমি প্রত্যেক জাতির জন্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি যাতে তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক আল্লাহর হেদায়েতের অন্তর্ভুক্ত হলো এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেল। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ মিথ্যারোপকারীদের কি পরিণতি হয়েছে।" (১৬:৩৬)
শিরক বা অংশীবাদের ব্যাপারে মুশরিকদের সাফাই প্রত্যাখ্যান করে এই আয়াতে বলা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের হেদায়েতের জন্য এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য তুলে ধরার জন্য প্রত্যেক জাতির কাছেই পয়গম্বর পাঠিয়েছেন। তিনি এক্ষেত্রে বিন্দু মাত্র কমতি রাখেন নি। সত্য ও সঠিক পথ হচ্ছে একমাত্র প্রভূ আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করা এবং অত্যাচারী ও তাগুতের অনুসারী শাসকদের আনুগত্য না করা। কাজেই যারা নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে স্বাধীনভাবে নবী-রাসূলদের পথ অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেবে স্বাভাবিকভাবেই তারা ঐশী হেদায়েত লাভের যোগ্যতা অর্জন করবে আর যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে তারা বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হবে। এক্ষেত্রে আল্লাহর কোন হস্তক্ষেপ নেই।
এই আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাগুত এবং খোদাদ্রোহী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা নবী-রাসূলদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। কারণ ধর্ম থেকে রাজনীতি পৃথক নয়, বরং প্রকৃত ঈমানই মানুষকে তাগুতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অনুপ্রাণিত করে।
এই সূরার ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
إِنْ تَحْرِصْ عَلَى هُدَاهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ يُضِلُّ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ
“(হে রাসূল!) আপনি তাদেরকে সুপথে আনতে আগ্রহী হলেও আল্লাহ যাদেরকে (কৃতকর্মের জন্য) বিপথগামী করেন তিনি তাদেরকে পথ দেখান না এবং তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই।" (১৬:৩৭)
এই আয়াতে নবী করিম (দ.)কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে, আপনি এমন আশা করবেন না যে,সব মানুষই ঈমানদার হয়ে যাবে,যারা গোঁয়ার্তুমি এবং হঠকারিতার কারণে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে তাদের জন্য অহেতুক আফসোস করা ঠিক হবে না।
যে সকল কাফের এবং মুশরিক সত্য ধর্মের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে,আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তর সীলমোহর করে দিয়েছেন,তারা কখনোই হেদায়েত পাবে না।
তবে কাফের মুশরিকদের অধিকাংশই এ ধরনের হঠকারীদের দলে অন্তর্ভুক্ত নয়, তারা অজ্ঞতা এবং পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে সত্য ধর্ম গ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়। কাজেই যারা ঈমান আনার সৌভাগ্য অর্জন করবে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে অন্যদের প্রতি এ বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।