সূরা হিজর; আয়াত ২৬-৩১
সূরা হিজরের ২৬ ও ২৭ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ (26) وَالْجَانَّ خَلَقْنَاهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ نَارِ السَّمُومِ (27(
“আমি মানুষকে পচা কর্দম থেকে তৈরি শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি।” (১৫:২৬)
“এর আগে জ্বিনকে আমি সৃষ্টি করেছি উত্তপ্ত আগুন থেকে।” (১৫:২৭)
আগের আয়াতগুলোতে আকাশ পৃথিবী বায়ু ও মেঘের সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে বলার পর এই আয়াতে মানুষ ও জ্বিন সৃষ্টি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সামগ্রীক ভাবে এই আয়াতে বলা হচ্ছে মানব সৃষ্টির উপকরণ হচ্ছে মাটি ও পানি আর জ্বিনের উৎস হচ্ছে আগুন। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে এটাই বুঝা যায় যে, মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী সৃষ্টি করা হয়েছে। কোন প্রাণীর বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে এই ধারণা পবিত্র কুরআন সমর্থন করে না। পবিত্র কুরআনের মতে প্রথম মানব অর্থাৎ হযরত আদমকে (আ.) সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করার পর তাতে প্রাণ সঞ্চার করা হয়েছে।
তবে মানব সৃষ্টির আগে আল্লাহতায়ালা জ্বিন সৃষ্টি করেছেন, জ্বিনরা অদৃশ্য, মানুষের চেয়ে তারা সংখ্যায়ও বেশি। পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতে জ্বিনদের সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে এমনকি জ্বিন সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র সূরাই নাজিল হয়েছে।
কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী জ্বিনরাও মানুষের মত ঐশী বিধি-বিধান পালন করতে বাধ্য। তাদের মধ্যেও নারী-পুরুষ রয়েছে এবং বিয়ে-শাদীর মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে। মানুষের মত তাদের মধ্যে অনেকে ঈমানদার আবার অনেকেই কাফের বা অবিশ্বাসী। হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়াকে যে ইবলিস প্রতারিত করেছিল সে ছিল জ্বিন। আল্লাহ তায়ালার অধিক এবাদত-বন্দেগীর কারণে ফেরেশতাদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। কিন্তু হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহতায়ালা তাকে সিজদা বা আভূমি প্রণত হয়ে আদমকে সম্মান করার নির্দেশ দেন, কিন্তু ইবলিস আল্লাহর সে আদেশ অমান্য করে কাফের বা শয়তানে পরিণত হয়।
এই আয়াতে এটাই বুঝানো হয়েছে যে, জ্বিন এবং ফেরেশতার মত অদৃশ্য সৃষ্টি সম্পর্কেও বিশ্বাস করতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মানুষের রূহ বা আত্মা হলো আসল। আর এই দেহের কোন মূল্য নেই। কেননা এই দেহ তৈরি হয়েছে পচা গন্ধময় কর্দম থেকে।
এরপর এই সূরার ২৮ ও ২৯ আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ (28) فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ (29(
“আপনার প্রতিপালক যখন ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি পচা গন্ধময় মৃত্তিকা থেকে মানুষ সৃষ্টি করব।” (১৫:২৮)
“অতঃপর যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হবে।” (১৫:২৯)
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, ফেরেশতারা মানুষের আগেই সৃষ্টি হয়েছে এবং আল্লাহ তায়ালা মানব সৃষ্টির আগে বিষয়টি ফেরেশতাদেরকে অবহিত করেছিলেন। এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষকে সিজদা করার নির্দেশ দেয়ার কারণ এটা নয় যে তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, বরং সিজদা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এজন্যে যে, তার মধ্যে খোদার রূহ সঞ্চার করা হয়েছে এবং মানুষকে বিশেষ ভাবে মর্যাদাবান করা হয়েছে।
মানুষের মধ্যে আল্লাহর রূহ সঞ্চার করার অর্থ এই নয় যে, তাকে প্রাণের অধিকারী করা হয়েছে। কারণ জীব-জন্তুও প্রাণের অধিকারী, এর অর্থ হচ্ছে মানুষকে বিশেষ যোগ্যতা ও প্রতিভা প্রদান করা হয়েছে যা দ্বারা মানব জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ চূড়া জয় করার মাধ্যমে পরিপূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হবে।
এখানে আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য, মানুষকে সিজদা করার অর্থ তাকে সম্মান জ্ঞাপন করা। কারণ ফেরেশতারা মানুষের খেদমতেই নিয়োজিত থাকবেন।
এই আয়াত থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে মানুষে মধ্যে দুটো দিক রয়েছে, একটি দৈহিক আরেকটি আত্মিক, ফলে তার যেমন বৈষয়িক প্রয়োজন রয়েছে তেমনি রয়েছে আধ্যাত্মিক প্রয়োজন।
আর মানুষ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার অনেক গুণাবলী প্রকাশের প্রতীক, সৃষ্টিকর্তা সেই যোগ্যতা ও সামর্থ মানুষকে দান করেছেন।
সূরা হিজরের ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ (30) إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ (31(
“যখন ফেরেশতাগণ সকলেই সিজদা করল।”(১৫:৩০)
“কিন্তু ইবলিস করল না, সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল।” (১৫:৩১)
আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের পর সকল ফেরেশতা কোন দ্বিধা না করেই নির্দেশ পালন করল। কারণ ফেরেশতারা আল্লাহর অবাধ্য হতে পারেন না। একটু আগেই বলা হয়েছে যে, ইবলিস ছিল জ্বিন প্রজাতির। ফলে অবাধ্যচারণ করার ক্ষমতা তার ছিল। সেই প্রবণতার কারণেই সে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করল। তার মধ্যে অহঙ্কার দেখা দিল। সে মনে করল মাটি থেকে সৃষ্ট আদম থেকে সে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে সে অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হলো।