সূরা ইউনুস; আয়াত ১-৪
সূরা ইউনুস হচ্ছে মক্কী সূরা। এই সূরায় মোট ১০৯টি আয়াত রয়েছে। এই সূরার বেশিরভাগ আয়াতে মানুষের কৃতকর্মের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। মানুষ যাতে সজাগ হয়, পাপ পংকিলতার দিকে পা না বাড়ায় সে জন্য এই সূরায় বার বার সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তাই এই পবিত্র সূরা নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে অধ্যায়ন করলে মন থেকে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয় এবং সঠিকভাবে এই সূরার বিধি-বিধানগুলো মেনে চললে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সহজ হয়ে যায়।
ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, কেউ যদি দুই বা তিন মাস সূরা ইউনুস অধ্যায়ন করে তাহলে অজ্ঞ ও অসচেতন হওয়ার কোন ভয় তার থাকে না এবং কেয়ামতের দিন সে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এই সূরার ১ ও ২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
الر تِلْكَ آَيَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيمِ (1) أَكَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا أَنْ أَوْحَيْنَا إِلَى رَجُلٍ مِنْهُمْ أَنْ أَنْذِرِ النَّاسَ وَبَشِّرِ الَّذِينَ آَمَنُوا أَنَّ لَهُمْ قَدَمَ صِدْقٍ عِنْدَ رَبِّهِمْ قَالَ الْكَافِرُونَ إِنَّ هَذَا لَسَاحِرٌ مُبِينٌ
"আলিফ, লাম, রা- এগুলো জ্ঞানগর্ভ হেকমতপূর্ণ গ্রন্থের আয়াত।” (১০:১)
“মানুষের জন্য এটা কি আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি তাদেরই একজনের নিকট ওহী বা প্রত্যাদেশবাণী পাঠিয়েছি, যাতে তিনি মানুষকে সতর্ক করেন এবং মুমিনদেরকে এই সুসংবাদ দেন যে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে উচ্চ মর্যাদা। তবে অবিশ্বাসী কাফেররা বলে থাকে এই লোকতো সুস্পষ্ট যাদুকর।" (১০:২)
পাঠক! আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, এই সূরাটিও তিনটি অক্ষর আলিফ, লাম ও রা দিয়ে শুরু হয়েছে। পবিত্র কুরআনের পরিভাষায় এগুলোকে বলা হয় হরূফে মুকাত্তাআত। পবিত্র কুরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে ২৯টি সূরার শুরুতে এ ধরনের ‘হরূফে মুকাত্তায়াত’ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-সূরা বাকারার শুরুতে অবশ্য আমরা ‘হরূফে মুকাত্তাআত’ সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা করেছি।
অধিকাংশ মুফাসসিরগণ মনে করেন, ‘হরূফে মুকাত্তাআত’ এমনি রহস্যপূর্ণ যে এর মর্ম ও মাহাত্ম একমাত্র আল্লাহ ও তার রাসূলই জানেন। এসব বিষয়ে অন্য কাউকে জ্ঞান দান করা হয়নি।
এই আয়াতে পবিত্র কুরআনের জন্য প্রশংসাসূচক ও গুণবাচক শব্দ ‘হাকীম’ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘হাকীম’ অর্থ হচ্ছে জ্ঞানগর্ভ ও হেকমতপূর্ণ। পবিত্র কুরআনের সব বিধি-বিধান প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
দ্বিতীয় আয়াতে একটি সন্দেহ ও প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে। অবিশ্বাসী কাফেররা মনে করতো, কোন মানুষ নবী বা রাসূল হতে পারে না। কাজেই আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো নবী বা রাসূল আসলে তিনি মানুষ না হয়ে ফেরেশতা হবেন। এই ধারণার জবাবে এই আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন যাতে তারা মানুষকে পাপ ও মন্দ কাজের ব্যাপারে সতর্ক করতে পারেন এবং ভালো ও সত মানুষকে তাদের উত্তম প্রতিদানের সুসংবাদ দিতে পারেন। কাজেই মানুষের কাছে মানুষকেই রাসূল হিসেবে পাঠানো সমীচীন হয়েছে। আশ্চর্যের কারণ তখনই হতো যখন মানুষের কাছে মানুষ না পাঠিয়ে ফেরেশতা পাঠানো হতো।
এখানে আরেকটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে- নবী-রাসূলরা সত্যের বাণী প্রচারের সময় তাদের দ্বারা অনেক অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অবিশ্বাসী কাফেররা এসব মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনাকে ‘যাদুমন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করতো।
এই আয়াত দিয়ে বোঝানো হয়েছে, পবিত্র কুরআন বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞাময় একটি ঐশীগ্রন্থ। এই গ্রন্থের বিধান শ্বাশত, চিরন্তন ও সার্বজনীন। আর নবী রাসূলদের আগমনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার প্রকৃত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা এবং তার ব্যক্তিত্ব ও অবস্থানের উতকর্ষ সাধন করা
আল্লাহতায়ালা এই সূরার তৃতীয় আয়াতে বলেছেন-
إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
"তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি আকাশ-মণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনি সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। তার অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। সুতরাং তাঁর এবাদত কর। তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?" (১০:৩)
মহান আল্লাহ এই বিশ্ব জগতকে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। এটাই মহান আল্লাহর নিয়ম ও সৃষ্টির প্রণালী। তিনি ইচ্ছে করলে সমগ্র জগতকে এক মুহূর্তে সৃষ্টি করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে আকাশ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন ধাপে ধাপে ছয় পর্যায়ে।
প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি দিলে একই নিয়ম দেখা যাবে। সৃষ্টি জগতের সব কিছুই ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায় এবং ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গতার দিকে এগিয়ে যায়। একটি শিশুও ৯ মাস মাতৃগর্ভে অবস্থান করার সময় পর্যায়ক্রমে পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে এবং পৃথিবীতে তার আগমনের পর একই নিয়মে সে বেড়ে ওঠে।
অংশীবাদী মুশরিকরা মহান আল্লাহর এই ক্ষমতায় বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বজগত পরিচালনায় যে আল্লাহর সঙ্গে অংশীস্থাপন করে, এই আয়াতে তাই বলা হয়েছে। অথচ একমাত্র মহান আল্লাহই বিশ্ব জগতের একমাত্র নিয়ন্তা, প্রকৃতির সব কিছু তার নির্দেশে এবং তাঁরই বেঁধে দেয়া নিয়মে পরিচালিত হয়। তার সমকক্ষ বা তাকে সহযোগিতা করতে পারে এমন কোন সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই।
তবে যে সব ফেরেশতা প্রকৃতিতে শৃঙ্ক্ষলা প্রতিষ্ঠা বা অন্য কোনো দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন তারাও আল্লাহর নির্দেশেই নিজ কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। তিনি যদি অনুমতি না দেন তাহলে তার কাছে সুপারিশ করারও সাধ্য কারো নেই।
এই বিশ্বজগত বিশেষ পরিকল্পনা ও নির্ধারিত সময়ের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা নিছক কোন দূর্ঘটনার ফল নয়। অত্যন্ত সুশৃংঙ্ক্ষলভাবে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে জগতের সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যায় একজন সৃষ্টিকর্তাই তা পরিচালনা করছেন।
সূরা ইউনুসের ৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا وَعْدَ اللَّهِ حَقًّا إِنَّهُ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ لِيَجْزِيَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ بِالْقِسْطِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا لَهُمْ شَرَابٌ مِنْ حَمِيمٍ وَعَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْفُرُونَ
"তাঁরই নিকট তোমাদের সবাইকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। সৃষ্টিকে তিনিই প্রথম অস্তিত্বে আনেন এরপর এর পুনরাবর্তন ঘটান যাতে মু'মিন ও সতকর্মপরায়ণদেরকে ন্যায্য কর্মফল প্রদান করা যায়। এবং যারা কাফের তাদের জন্য রয়েছে ফুটন্ত পানীয় ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। কারণ তারা কুফরী করেছিল।" (১০:৪)
আগের আয়াতটিতে সৃষ্টি জগতে মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ এবং আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির তত্ত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করার পর এই আয়াতে মৃত্যুর পর আবার জীবিত হওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখানে কেয়ামতের ব্যাপারে সব সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলা হয়েছে এটা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি, এর কোন ব্যতিক্রম নেই। যারা সতকর্মশীল ও মুমিন তারা সেদিন পুরস্কৃত হবে আর যারা অবিশ্বাস এবং কুফরী করবে তারাও সেদিন তাদের উপযুক্ত প্রতিদান পাবে। তবে সেদিন সব কিছু করা হবে পূর্ণ ইনসাফ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে।
এই পৃথিবীতে মানুষের কৃতকর্মের পূর্ণাঙ্গ প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়। তাই পরকালেই প্রত্যেকের ন্যায্য কর্মফল দেয়া হবে, আখেরাতের দর্শন এটাই।