সূরা আত তাওবা; আয়াত ১২৩-১২৬
সূরা তাওবার ১২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
"হে ঈমানদারগণ! কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো এবং তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখুক। আর জেনে রাখো, আল্লাহ মুত্তাকিদের সাথে রয়েছেন।" (৯:১২৩)
এই আয়াতে জিহাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখানে ঈমানদার মুসলমানদেরকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, দূরের শক্রদের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়ার কারণে কাছের শক্রদের ব্যাপারে উদাসীন হলে চলবে না। কারণ যারা নিকট ও প্রতিবেশী-তাদের ক্ষেত্রেই ভয় বেশি। এ ব্যাপারে মনোযোগী না হলে কাছের শক্ররা মুসলমানদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া কাছের শক্রকে দূরে অবস্থিত শক্রদের চেয়ে সহজে নিয়ন্ত্রণ বা পরাভূত করা সম্ভব।
এই আয়াতে غلظه (গেলযা) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ কঠিন বা কঠোরতা হলেও এ শব্দ দিয়ে কাফের বা শক্রপক্ষের সঙ্গে সহিংসতা বা দুর্ব্যবহার করার কথা কিন্তু বলা হয়নি। কারণ এটা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থী। ইসলাম যেখানে যুদ্ধের ময়দানেও সীমা লংঘন না করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে এবং আগ্রাসন বা আগে হামলা না করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে, সেখানে কাফেরদের সঙ্গে সহিংস বা কঠোর আচরণের নির্দেশ দিতে পারে না। মুফাসসিরগণ মনে করেন غلظه (গেলযা) শব্দ দিয়ে শক্তি ও দৃঢ়তা বোঝানো হয়েছে। অর্থাত মুসলমানদের আচরণ থেকে কাফেররা যেন তাদের শক্তি, মনোবল ও দৃঢ়তা অনুধাবন করতে পারে।
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি,
এক. যিনি আল্লাহর বিধান পালনের ব্যাপারে যত্নবান তিনিই প্রকৃত ঈমানদার। তাকওয়া ও পরহেজগারী হচ্ছে ঈমানদারদের ভূষণ। তবে ইসলামের শক্রদের ব্যাপারে ঈমানদারদের মনোভাব অত্যন্ত দৃঢ়। এ ব্যাপারে তারা আপোষহীন ও অবিচল।
দুই. ভয়ভীতি এবং আপোষকামীতা ঈমানদারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
সূরা তওবার ১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذَا مَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَذِهِ إِيمَانًا فَأَمَّا الَّذِينَ آَمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
"যখনই কোন সূরা অবতীর্ণ হয়, তখন মুনাফিকদের অনেকেই বলে, এই সূরা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান বৃদ্ধি করলো? যারা মুমিন এটা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে।" (৯:১২৪)
মুনাফিকরা সব সময় আল্লাহর নবীর কাছে আসা আয়াত বা ঐশি বাণীকে তুচ্ছ এবং মূল্যহীন দেখানোর চেষ্টা করতো। অনেক সময় তারা বলেই ফেলতো, এই আয়াত নাযিল হওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? এতে মুসলমানদের কি লাভ হয়েছে? আসলে মুনাফিকরা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করা এবং আল্লাহর বাণীর মর্যাদাকে ম্লান করার জন্য এসব কথা বলতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, মুনাফিকরা ঈমানদার মুসলমানদের বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়নি। প্রত্যেকটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুমিনদের ঈমান আরো বেশি মজবুত হয়েছে। ঐশিবাণী ঈমানদারদের নূরানী অন্তরকে আরো দীপ্তিতে ভরে তুলেছে এবং পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি ও আনন্দ বয়ে এনেছে।
পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াত মানুষের মনে প্রশান্তি বয়ে আনে। অনেক মানসিক চিকিতসকও বিষন্নতা দূর করার জন্য রোগীকে পবিত্র কুরআন পাঠ করার উপদেশ দিয়ে থাকেন। ঐশি বাণীর তেলাওয়াত উদাস ও উচ্ছন্ন হৃদয়কে প্রশান্ত ও উতফুল্ল করে। এ ছাড়া, এর ফলে মহান আল্লাহর প্রতি মানুষের ঈমান আরো সুদৃঢ় হয়।
সূরা তাওবার ১২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَى رِجْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ كَافِرُونَ
"যাদের অন্তরে (কপটতার) ব্যাধি আছে (আল্লাহর বাণী অবতরণের ফলে) তাদের কলুষের সঙ্গে আরো কলুষ যুক্ত হয় এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।” (৯:১২৫)
আগের আয়াতে বলা হয়েছে, পবিত্র কুরআনের বাণী বা আয়াতগুলো ঈমানদারদের বিশ্বাসকে আরো সংহত ও মজবুত করে এবং তারা এসব ঐশিবাণী পাঠ করে মনেও শান্তি অনুভব করেন। কিন্তু যারা কপটতার ব্যাধিতে আক্রান্ত তারা এর ব্যতিক্রম। এতে তাদের অন্তরের ব্যাধি আরো বৃদ্ধি পায়।
কুরআনের আয়াত বা বাণীগুলো যেন অফুরন্ত কল্যাণের বারিধারা। বৃষ্টি যদি মাটিতে বর্ষিত হয়, মাটি তাতে প্রাণ লাভ করে সতেজ ও সবুজ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বৃষ্টিই যদি কোন গন্ধময় জলাশয়ে বর্ষিত হয় তাহলে কদর্যতার কারণে সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। তেমনি লোভ-লালসা এবং অহংকার হচ্ছে মানসিক কদর্যতা, যদি এসব কারো অন্তরে বাসা বাঁধে তাহলে সে পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে বিদ্বেষ ও শক্রতা পোষণ করবে- এটাই স্বাভাবিক।
সত্যের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া, অকৃতজ্ঞতা এবং কুফরী ও মুনাফেকি হচ্ছে কঠিন মানসিক ব্যাধি। এ ব্যাপারে মনোযোগী না হলে কঠিন শারীরিক ব্যাধির মত তা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। পবিত্র কুরআন এসব মানসিক রোগের ব্যাপারে মানবজাতিকে বারবার সতর্ক করে দিয়েছে।
সূরা তাওবার ১২৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন :
أَوَلَا يَرَوْنَ أَنَّهُمْ يُفْتَنُونَ فِي كُلِّ عَامٍ مَرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ لَا يَتُوبُونَ وَلَا هُمْ يَذَّكَّرُونَ
"তারা কি লক্ষ্য করে না, প্রতি বছর তারা দু'একবার বিপর্যস্ত হচ্ছে, অথচ এরপরও তারা তাওবা করে না কিংবা উপদেশ গ্রহণ করে না।" (৯:১২৬)
আল্লাহতায়ালা মানুষকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখও এই পরীক্ষার অর্ন্তভুক্ত। মানুষ যখন চরম সুখে থাকে তখন আচরণ কেমন হয় আর দুঃখ বা বিপদের সময় সে কি ধৈর্য্য ধারণ করতে পারে কিনা-আল্লাহর পরীক্ষায় এ সবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই আয়াতে বলা হচ্ছে, মুনাফিকরা বারবার ঐশি পরীক্ষার সম্মুখীন হলেও তারা এ ব্যাপারে সতর্ক হয় না। ফলে কপটতা ত্যাগ করে সত্যের পথে ফিরে আসার সে সৌভাগ্যও তাদের হয় না।
এজন্য এটা বলা যায় যে, বিপদাপদ বা অন্য কোনো ঐশি পরীক্ষার মধ্যেও যদি কেউ সতর্ক না হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, তার আত্মা অসংখ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।