সূরা ইউনুস;(১০ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইউনুস;(১০ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 15:38:13 2-10-1403

সূরা ইউনুস; আয়াত ৪৫-৪৯

সূরা ইউনুসের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ كَأَنْ لَمْ يَلْبَثُوا إِلَّا سَاعَةً مِنَ النَّهَارِ يَتَعَارَفُونَ بَيْنَهُمْ قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِلِقَاءِ اللَّهِ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ

"প্রতিদান দিবসে তিনি যখন তাদেরকে একত্রিত করবেন, তাদের মনে হবে (পৃথিবী ও বারযাখে) তারা যেন দিনের এক ঘন্টাও কাটায়নি। তারা একে অপরকে চিনতে পারবে। আল্লাহর সাক্ষাত যারা অস্বীকার করেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তারা সত পথ প্রাপ্ত ছিল না।" (১০:৪৫)

অবিশ্বাসী কাফেররা হাশর বা প্রতিফল দিবস বিশ্বাস করে না, তারা মনে করে হাশর বা বিচারের দিন বলতে কিছু নেই। কিন্তু ইসলাম বলে, কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক মহাপ্রলয়ের পর একদিন সব মানুষকে একসঙ্গে সমবেত করা হবে এবং তাদের কৃতকর্মের নিখুঁত হিসাব নিকাশের পর উপযুক্ত প্রতিদান দেয়া হবে। সেদিন পরকালের অনন্ত জীবন সবার সামনে থাকবে তাই ভবিষ্যতের তুলনায় অতীত জীবনকে অত্যন্ত নগণ্য মনে হবে। ইহকাল এবং কবরের জীবনকে মনে হবে এক মুহূর্ত সময়। অপূর্ণ ঘুম থেকে জেগে উঠলে যে অনুভূতি হয় হাশরের ময়দানে সমবেত সবার কাছে সে রকম অনুভূতিই হবে। কাজেই ইহকালীন জীবনের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি পদক্ষেপের কথা মনে পড়বে, প্রত্যেকে তার পরিচিত জনকে চিনতে পারবে। কাজেই আজ যারা কেয়ামত এবং প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করছে, সেদিন তারা তাদের এই ভুলের বিষয়টি ভালো করেই উপলব্ধি করবে এবং খালি হাতে উপস্থিত হওয়ার জন্য মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা দাবানলের মত তাদের হৃদয়কে গ্রাস করবে। তবে সেদিন এ থেকে রেহাই পাওয়া বা পেছনে ফিরে যাওয়ার কোন রাস্তাই থাকবে না।

দুনিয়ার জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, চোখের পলকেই তা শেষ হয়ে যায়। এ বিষয়টি পরকালে আরো বেশি প্রতিভাত হবে। তাই এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে যারা পাথেয় সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হবে, সেদিন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সত্যিই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনকে অনন্ত জীবনের ওপর প্রাধান্য দেয়ার চেয়ে মানুষের জন্য বড় ক্ষতি আর কি হতে পারে?

সূরা ইউনুসের ৫৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-

وَإِمَّا نُرِيَنَّكَ بَعْضَ الَّذِي نَعِدُهُمْ أَوْ نَتَوَفَّيَنَّكَ فَإِلَيْنَا مَرْجِعُهُمْ ثُمَّ اللَّهُ شَهِيدٌ عَلَى مَا يَفْعَلُونَ

"(হে রাসূল) আমরা কাফেরদের ভয়াবহ পরিণতির যে অঙ্গীকার করেছি তার কিছু আপনার জীবদ্দশায়ই প্রদর্শন করব কিংবা আপনার জীবনাবসানের পর তাদেরকে তা দেয়া হবে, তাদেরকে আমার কাছেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং তারা যা করে আল্লাহ তার সাক্ষী।" (১০:৪৬)

এই আয়াতে আল্লাহ তার নবী ও বিশ্বাসী মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য বলেছেন, অনেক সময় অবিশ্বাসী কাফেররা এই পার্থিব জগতেই তাদের পূর্ণ প্রতিফল লাভ করে না। এর কারণ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা তাদের পূর্ণ প্রতিফল প্রদান করবেন ইহকাল বা মৃত্যু পরবর্তী জীবনে। কারণ মানুষ যাই করুক মৃত্যু তার জন্য অবধারিত এবং আল্লাহর কাছে তাকে ফিরে যেতেই হবে। আর আল্লাহ মানুষের সব কাজ-কর্মের স্বাক্ষী হয়ে আছেন। তিনি ন্যায়বান এবং মানুষের কৃত-কর্মের পূর্ণ ও উপযুক্ত প্রতিদান প্রদান করবেন।

এর অর্থ এই নয় যে, তিনি অসত মানুষের শাস্তি বা প্রতিদান কেবল পরকালের জন্যই নির্ধারণ করে রেখেছেন। তিনি অবাধ্য ও অসত মানুষকে এই জগতেও কিছু শাস্তি দিয়ে থাকেন যা বিশ্বাসী সত ব্যক্তিরা জীবদ্দশায়ই দেখে যেতে পারে।

অবিশ্বাসী কাফের এবং জালেম ও অসত মানুষের শাস্তি বিলম্বিত হতে থাকলে –সেজন্য মুমিন মুসলমানদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়। কারণ শাস্তি বা প্রতিদান দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর আর তিনি তা উপযুক্ত সময়েই দিয়ে থাকেন।

সূরা ইউনুসের ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَلِكُلِّ أُمَّةٍ رَسُولٌ فَإِذَا جَاءَ رَسُولُهُمْ قُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ

"প্রত্যেক জাতির জন্যেই রয়েছে একজন রাসূল এবং যখন তাদের রাসূল এসেছে তখন ন্যায় বিচারের সাথে তাদের মীমাংসা হয়েছে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হয়নি।" (১০:৪৭)

নবী রাসূলদের মধ্যে অনেকেই নতুন শরীয়ত এবং নতুন ঐশীগ্রন্থ লাভ করেছেন এবং তা মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। আবার অনেকেই নতুন ঐশীগ্রন্থ লাভ করেননি বরং পূর্ববর্তী শরীয়তের প্রচার ও প্রসারের কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। পবিত্র কুরআন থেকে বুঝা যায়, মানবজাতির মধ্যে এমন একজন সব সময়ই ছিলেন যিনি ঐশীগ্রন্থ এবং পয়গম্বরদের আদর্শ প্রচার করেছেন।

নবী-রাসূলদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং সমাজে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। পরকালেও প্রত্যেক জাতি তাদের নবীদের সাথে উপস্থিত হবে এবং সেদিন নিজ নিজ পয়গম্বরের উপস্থিতিতে মানুষের বিচার করা হবে।

আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্যই পয়গম্বর পাঠিয়েছেন। তিনি কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে পথ প্রদর্শন থেকে বঞ্চিত করেননি। যেসব জাতি পয়গম্বরদের পথ অনুসরণ করেছে তারা সফলতা লাভ করেছে, কারণ শুধুমাত্র নবী রাসূলদের প্রদর্শিত পথেই সফলতা লাভ করা বা সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

সূরা ইউনুসের ৪৮ ও ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَيَقُولُونَ مَتَى هَذَا الْوَعْدُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (48) قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي ضَرًّا وَلَا نَفْعًا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ لِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ إِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ فَلَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ

"(অবিশ্বাসী কাফেরা) বলে, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে বল (কেয়ামতের) প্রতিশ্রুতি কবে নাগাদ বাস্তবায়িত হবে? (১০:৪৮)

“(হে পয়গম্বর!) আপনি বলুন! আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমি আমার নিজের ভালো-মন্দ সাধনেরও ক্ষমতা রাখি না। প্রত্যেক জাতির জন্য এক নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, যখন তাদের সময় ঘনিয়ে আসবে, তখন তারা মুহূর্তকালের জন্যও দেরি করতে পারবে না বা এগিয়েও আনতে পারবে না।"(১০:৪৯)

অবিশ্বাসী কাফেররা যেহেতু কেয়ামত অস্বীকার করতো তাই তারা এ নিয়ে নানা প্রশ্নের অবতারণা করতো, তারা বলতো যদি কেয়ামত সত্যি হয়ে থাকে তাহলে কখন তা সংঘটিত হবে?

এই আয়াতে এটাই বলা হয়েছে যে, পয়গম্বররা প্রত্যাদেশ বাণী অনুযায়ী কথা বলেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অবহিত করেছেন যে, কেয়ামতের মাধ্যমে এই জগতের অবসান ঘটবে। তিনি পয়গম্বরদেরকে এটা বলেননি যে কেয়ামত কবে সংঘটিত হবে।

আসলে মৃত্যু যেমন অবধারিত একটি বাস্তবতা তেমনি কেয়ামতও একটি বাস্তবতা। মৃত্যু কবে আসবে এটা কেউ না জানলেও যেমন এটি বাস্তব সত্য তেমনি কেয়ামতের সময় বা দিনক্ষণ না জানা থাকলেও তা বাস্তব এবং সত্য।