সূরা রা’দ; আয়াত ৩৬-৩৮
সূরা রা’দের ৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَالَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَفْرَحُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمِنَ الْأَحْزَابِ مَنْ يُنْكِرُ بَعْضَهُ قُلْ إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ وَلَا أُشْرِكَ بِهِ إِلَيْهِ أَدْعُو وَإِلَيْهِ مَآَبِ
"যাদেরকে আমি গ্রন্থ দিয়েছি তারা আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার জন্য আনন্দিত হয় কিন্তু কোন কোন দল এর কিছু অংশ অস্বীকার করে। বলুন! আমি তো আল্লাহর উপাসনা করতে এবং তাঁর কোন অংশী না করতে আদিষ্ট হয়েছি। আমি তাঁরই প্রতি (সকলকে) আহ্বান করি এবং তাঁরই নিকট আমার প্রত্যাবর্তন।" (১৩:৩৬)
এই আয়াতে নবী করিম (সা.)কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে, আপনি এটা আশা করবেন না যে, সব মানুষই আপনার কথা মেনে নেবে এবং ঐশী ফরমানের অনুগত হয়ে যাবে। কিছু লোক সত্যকে গ্রহণ করবে আবার অনেকেই সত্যকে প্রত্যাখ্যান করবে। এজন্য হতাশ হওয়ার কিছু নেই। যদি এমন হয় যে একটি মানুষও আপনার কথা গ্রহণ করছে না, তারপরও হতাশা যেন আপনাকে গ্রাস না করে, আপনি আপনার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করুন এবং স্বগৌরবে ঘোষণা করুন-আমি একমাত্র আল্লাহরই উপাসনা করি এবং আমি তাঁরই বান্দা। আমি মানব জাতিকে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি, এর পেছনে আমার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ নেই।
রাসূলে খোদা (সা.)এর এই দ্ব্যর্থহীন আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই একত্ববাদীদের অর্থাৎ পুরানো ঐশী ধর্মগ্রন্থগুলোর অনুসারীদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে নেয়, আবার তাদের মধ্যে অনেকেই নবী করিম (সা.) এর বাণী উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় ফলে সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থের উপর বিশ্বাস স্থাপনের সৌভাগ্য থেকে তারা বঞ্চিত হয়।
এই আয়াতে লক্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে, দ্বীনের প্রতিটি বিধানের উপর ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য। এর কিছু অংশ গ্রহণ না করার অর্থ পুরাপুরি ইসলামকে অমান্য করা।
এ সূরার ৩৭ নম্বর আয়াতে আয়াতে বলা হয়েছে-
وَكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ حُكْمًا عَرَبِيًّا وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ بَعْدَمَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا وَاقٍ
"এমনিভাবে আমি এ কুরআনকে আরবী ভাষায় নির্দেশরূপে অবতরণ করেছি। জ্ঞান প্রাপ্তির পর আপনি যদি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেন তাহলে আল্লাহর বিরুদ্ধে আপনার কোন অভিভাবক ও রক্ষক থাকবে না।" (১৩:৩৭)
কুরআন শরীফের ব্যাপারে অবিশ্বাসীদের নানা কথার পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতেও রাসূলে খোদা (সা.) এবং ঈমানদারদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসীদের বিরূপ মন্তব্যের কারণে কুরআন শরীফের সত্যতার ব্যাপারে মুমিন মুসলমানদের মনে যেন সামান্য সন্দেহও উদ্রেক না হয়। এই গ্রন্থ সুস্পষ্ট ভাষায় সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছে এবং ঐশী নির্দেশাবলী মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে।
কাজেই অবিশ্বাসীদের মন জয় করার জন্য কিংবা তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য যদি আপনি কুরআনের বিধানের ব্যাপারে সামান্য ছাড় দেন তাহলে আপনি ঐশী শাস্তির যোগ্য বিবেচিত হবেন। আর যদি এ ধরনের শাস্তি নিশ্চিত হয়ে যায় তাহলে যাদের মন আকৃষ্ট করার জন্য আপনি এ কাজ করবেন তারা আপনাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
এই সূরার ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِنْ قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآَيَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ لِكُلِّ أَجَلٍ كِتَابٌ
"(হে রাসূল) আপনার পূর্বে আমি অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দিয়েছি। কোন রাসূলের এমন সাধ্য ছিল না যে, আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কোন মুজিজা বা নিদর্শন উপস্থিত করে। নির্ধারিতকালের জন্য গ্রন্থ থাকে।" (১৩:৩৮)
অবিশ্বাসী কাফেররা মনে করতো যারা আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বা নবী-রাসূল তাদের জীবন যাপনের পদ্ধতি সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন। এবং তারা এমন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী যে মানুষ যখন যা বলবে, যা করতে বলবে তারা তৎক্ষনাৎ তাই করে দেখাতে পারবে। তাদের এই ধারণার জবাবে এই আয়াতে বলা হয়েছে, সকল পয়গম্বরগণই মানুষ। তারা মানব প্রজাতির ভিন্ন কিছু নয়। তারাও মা-বাবার মাধ্যমে এই জগতে আগমন করেন এবং স্ত্রী গ্রহনের মাধ্যমে সন্তান লাভ করেন। তাদের মাধ্যমে যে সব অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হয় তা আল্লাহর ইচ্ছায় এবং তারই নির্দেশে হয়ে থাকে। মানুষ চাইলেই পয়গম্বররা মুজিজা বা অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করতে পারেন না।
আসলে মানুষের চাওয়া পাওয়ার কোন শেষ নেই। কাজেই মানুষের সকল চাহিদা পূরণ করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ এবং এটা অস্বাভাবিক। যদি কেউ সত্য সন্ধানি হয় তাহলে তার সামনে সত্য প্রতিভাত হওয়ার সাথে সাথে সে তা গ্রহণ করে নেয়। কিন্তু আসলে সত্যকে পাওয়া বা গ্রহণ করা যার উদ্দেশ্য নয় তার সামনে হাজারো মুজিজা বা অলৌকিক নিদর্শন উপস্থাপন করা হলেও সে তা গ্রহণ করবে না।
এই আয়াতের শেষ ভাগে আরেকটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে,বলা হয়েছে প্রত্যেক যুগের জন্যই খোদায়ী বিধান পাঠানো হয়েছে এবং নতুন পয়গম্বর আসার পর পূর্ববর্তী পয়গম্বরের শরীয়ত বাতিল হয়েছে। এটাই প্রকৃতিতে আল্লাহর বিধান।