সূরা হিজর; আয়াত ২১-২৫
সূরা হিজরের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا عِنْدَنَا خَزَائِنُهُ وَمَا نُنَزِّلُهُ إِلَّا بِقَدَرٍ مَعْلُومٍ (21(
“প্রত্যেক বস্তুর ভাণ্ডার আমার কাছে আছে এবং আমি তা প্রয়োজনীয় পরিমাণেই অবতরণ করি।" (১৫:২১)
বিশ্বের সকল কিছুর স্রষ্টা মহান আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টিকে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং এসবের ভিত্তিতে তার রুজি নির্ধারণ করেছেন। এটি খোদায়ী বিধানের অংশ। প্রতিটি সৃষ্টির জন্য আল্লাহর করুণা নির্ধারিত রয়েছে এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই করুণাকে তাক্বদির বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তাক্বদির নির্ধারিত রয়েছে বলে মানুষের চেষ্টা ও পরিশ্রমের যে কোন দাম নেই, তা নয়। বরং, বলা হয়েছে, কঠোর প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্তির যোগ্য হতে পারবে। হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে আল্লাহর কোন করুণাই মানুষের হাতে পৌঁছবে না।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি সৃষ্টির যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য কী হবে তা আল্লাহই নির্ধারণ করেন এবং তিনি তার প্রজ্ঞা ও বিবেচনা অনুযায়ী তার সকল সৃষ্টির চাহিদা পুরণ করে থাকেন। এ কারণে আমাদেরকে যে কোন ধরনের সমস্যা ও চাহিদার কথা একমাত্র আল্লাহর কাছে জানাতে হবে, তার কাছে চাইতে হবে। আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা যাবে না।
সূরা হিজরের ২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন-
وَأَرْسَلْنَا الرِّيَاحَ لَوَاقِحَ فَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَسْقَيْنَاكُمُوهُ وَمَا أَنْتُمْ لَهُ بِخَازِنِينَ (22(
“আমি বৃষ্টিসমৃদ্ধ বাতাস প্রেরণ করি, অতঃপর আকাশ থেকে বৃষ্টিবর্ষণ করে এবং তা তোমাদের পান করতে দেই। এর ভাণ্ডার তোমাদের কাছে নেই।” (১৫:২২)
আগের আয়াতে আল্লাহ তার সৃষ্ট জীবদের জন্য অসংখ্য করুণার কথা উল্লেখ করেছেন। এই আয়াতে সেসব করুণার একটি বর্ণনা করে তিনি বলছেন: তোমাদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি। এই পানি সৃষ্টি করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু মহান আল্লাহ বাতাসের শক্তিতে মেঘমালাকে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে উড়িয়ে নিয়ে যান এবং মেঘে মেঘে ঘর্ষণের মাধ্যমে বৃষ্টিধারা নেমে আসে। এই পানি পান করে মানুষ তার তৃষ্ণা নিবারণ করে। এ আয়াত থেকে বোঝা যায়- মেঘ, বাতাস ও বৃষ্টি আল্লাহর এমন কিছু নিয়ামত যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়া, এই জগত-প্রকৃতি মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে এবং একে ইচ্ছেমতো ছেড়ে দেয়া হয়নি। প্রকৃতি নিজের ইচ্ছায় পরিচালিত হয় বলে নাস্তিকরা যে দাবি করে তা সত্য নয়।
সূরা হিজরের ২৩, ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِنَّا لَنَحْنُ نُحْيِي وَنُمِيتُ وَنَحْنُ الْوَارِثُونَ (23) وَلَقَدْ عَلِمْنَا الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنْكُمْ وَلَقَدْ عَلِمْنَا الْمُسْتَأْخِرِينَ (24) وَإِنَّ رَبَّكَ هُوَ يَحْشُرُهُمْ إِنَّهُ حَكِيمٌ عَلِيمٌ (25
"আমিই জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই এবং আমিই চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী।” (১৫:২৩)
“তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে আমি তাদের জানি এবং তোমাদের পরে যারা আসবে তাদেরও জানি।” (১৫:২৪)
“তোমাদের প্রতিপালকই ওদের একত্রে সমবেত করবেন, নিশ্চয়ই তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।" (১৫:২৫)
এই আয়াতগুলোতে মানুষের জীবন ও মৃত্যুর প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে :
তোমাদের জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে, তোমাদের নিজেদের বা অন্য কারো হাতে নয়। পৃথিবীর সব কিছু একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু মহান আল্লাহ অনাদি ও অনন্ত, তার কোন ক্ষয় বা বিনাশ হবে না। মৃত্যুর পরে কিয়ামতের দিন সকল মানুষ আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে এবং সেদিন দয়াময় আল্লাহ তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রত্যেকের বিচার করবেন। আয়াতগুলোতে আরো বলা হচ্ছে, কিয়ামতের দিনের বিচারে তোমাদের সাথে অতীত ও ভবিষ্যতের লোকদের কোন পার্থক্য করা হবে না। কারণ, আল্লাহর কাছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। তাঁর কাছে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছুই স্পষ্ট ও পরিস্কার এবং তিনি সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবহিত। তিনি অতীতের কোন কিছু ভুলে যাননি এবং ভবিষ্যতের কোন ঘটনাও তাঁর অজানা নয়।
অবশ্য এখানে ‘মুস্তাক্বদেমিন’ শব্দটি দ্বারা যেমন অতীতের জাতিগুলোকে বোঝানো হয়েছে, তেমনি এই শব্দের আরো কিছু অর্থ রয়েছে। যেমন ভালো ও সৎ কাজে যারা অগ্রগামী তাদেরকে মুস্তাক্বদেমিন বলা হয়, একইভাবে সত্য বিরোধীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকারীগণও মুস্তাক্বদেমিনের অন্তর্ভূক্ত।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আল্লাহর জ্ঞানের কোন পরিবর্তন হয় না। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে তাঁর জ্ঞান একই থাকবে।
দুই. আল্লাহর সুচিন্তিত ও বুদ্ধিদীপ্ত নিয়মের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরায় তার কৃতকর্মের হিসাব দেয়ার জন্য জীবিত করা হবে। কারণ, মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে যদি তার কর্মফল শেষ হয়ে যায় এবং তাকে তার কৃতকর্মের জন্য জবাবদীহি না করতে হয়, তবে এই এই জগত সৃষ্টির কোন অর্থ হয় না।