সূরা নাহল; আয়াত ৫৮-৬১
সূরা নাহলের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ (58) يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ (59)
“যখন কোন মুশরিককে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়।” (১৬:৫৮)
“তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবতে থাকে,অপমান সহ্য করে তাকে (কন্যা সন্তানটিকে) রেখে দেবে, না কি তাকে মাটির নীচে পুঁতে ফেলবে। শুনে রাখ,তারা যে সিদ্ধান্ত নেয় তা খুবই নিকৃষ্ট।” (১৬:৫৯)
মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা মনে করত। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, কাফের-মুশরিকরা আল্লাহ ও ফেরেশতা সম্পর্কে অদ্ভুত ধারণা পোষণ করত অথচ এরাই নিজেদের ক্ষেত্রে কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়াকে অপমানজনক মনে করত। তাদের কারো স্ত্রী যদি কন্যা সন্তান জন্ম দিত তাহলে লজ্জায় অপমানে তারা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে যেতো এবং অপমান বোধের কারণে তারা সমাজ থেকে পালিয়ে বেড়াত এমনকি তারা নবজাতক শিশুকে জীবন্ত কবর দিতেও দ্বিধা করত না।
আরবের বেদুইন বা অন্যান্য যাযাবর গোত্র কন্যা সন্তানকে খুবই লজ্জা ও অপমানের কারণ বলে মনে করত। এসব যাযাবর গোত্র প্রায় সব সময় যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকতো, মেয়েরা যেহেতু যুদ্ধ করতে পারত না বরং, যুদ্ধে পরাজিত হলে মেয়েদেরকে প্রতিপক্ষের হাতে বন্দি হয়ে দাসত্ব বরণ করতে হতো সেজন্য আরব যাযাবরদের মধ্যে কন্যা সন্তানকে মান-সম্মানের জন্য ক্ষতিকর মনে করা হতো।
তবে ওই বরাবর সমাজে ইসলাম এসে নারীকে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। নারীর সম্মান-মর্যাদা এবং নারীর সাথে সদাচরণের বিষয়ে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) তাঁর কন্যা হযরত ফাতিমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন তা চিরকালের জন্য মানব জাতির সামনে আদর্শ হয়ে আছে।
শুধু আরব যাযাবরদের মধ্যে কেন এই আধুনিক যুগেও অনেক সমাজে পুত্র সন্তানকে কন্যা সন্তানের ওপর প্রধান্য দেয়া হয়, ফলে বুঝা যায় সেই বরবর যুগের ধ্যান ধারণা এখনো কোন কোন সমাজে প্রচলিত রয়েছে। ঐশী ধর্মগুলো বিশেষ করে ইসলাম এ ধরনের মানসিকতা বা সমাজিক কুসংস্কারকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে।
এই সূরার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন,
لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآَخِرَةِ مَثَلُ السَّوْءِ وَلِلَّهِ الْمَثَلُ الْأَعْلَى وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
“যারা পরকাল বিশ্বাস করে না,তাদের উদাহরণ নিকৃষ্ট এবং আল্লাহর উদাহরণই মহান, তিনি পরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাময়।” (১৬:৬০)
মুশরিক সমাজে বিদ্যমান কুসংস্কারের বর্ণনা দেয়ার পর এ আয়াতে বলা হয়েছে, এ ধরনের ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাসের মূলে রয়েছে পরকালের প্রতি অবিশ্বাস। কোন ঈমানদার মানুষ কখনোই হত্যা তো দূরের কথা আল্লাহর কোন সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করতে পারে না।
আমরা যদি সমাজের দিকে তাকাই তাহলে সন্দেহাতীতভাবে এটা প্রতিভাত হবে যে, সকল মন্দ কাজের মূলে রয়েছে শিরক এবং কুফর। তেমনি দেখা যাবে ঈমান বা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ভালো ও সৎ কাজের প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া শক্তি,পরাক্রম,মর্যাদা ও সকল পরিপূর্ণতার অধিকারী হচ্ছেন মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। কাজেই মানুষ যদি পরিপূর্ণতা অর্জন করতে চায় তাহলে ঐশী গুণাবলী তাকে অর্জন করতে হবে।
এই সূরার ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِمْ مَا تَرَكَ عَلَيْهَا مِنْ دَابَّةٍ وَلَكِنْ يُؤَخِّرُهُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
“আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের সীমালঙ্ঘনের জন্য শাস্তি দিতেন তবে ভূপৃষ্ঠে কোন জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না। কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর নির্ধারিত সময়ে যখন তাদের মৃত্যু এসে যাবে, তখন এক মুহূর্তও বিলম্বিত কিংবা ত্বরাম্বিত করতে পারবে না।” (১৬:৬১)
এ আয়াতে ঐশী নিয়মের দু'টি দিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে-
প্রথমতঃ বলা হয়েছে, পাপাচারী মানুষকে আল্লাহ তায়ালা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুযোগ দেন। কারণ পাপের শাস্তি যদি আল্লাহ তায়ালা সাথে সাথেই দিতেন তাহলে পৃথিবীতে কোন মানুষ জীবিত থাকতে পারত না।
দ্বিতীয়তঃ বলা হচ্ছে, এই অবকাশ বা সুযোগের সময় নির্দিষ্ট করা থাকে। ফলে ঐশী শাস্তি বা মৃত্যুর সময় যখন নির্ধারিত হয়ে যায় তখন তা আর বিলম্বিত বা ত্বরান্বিত করা হয় না। এ থেকে পালিয়ে যাওয়ারও কারো সাধ্য নেই।