সূরা আ'রাফ; (১৪তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (১৪তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 21:14:3 2-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৫৭-৬২

সূরা আ'রাফের ৫৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَهُوَ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ بُشْرًا بَيْنَ يَدَيْ رَحْمَتِهِ حَتَّى إِذَا أَقَلَّتْ سَحَابًا ثِقَالًا سُقْنَاهُ لِبَلَدٍ مَيِّتٍ فَأَنْزَلْنَا بِهِ الْمَاءَ فَأَخْرَجْنَا بِهِ مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ كَذَلِكَ نُخْرِجُ الْمَوْتَى لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ ((৫৭

"তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী বায়ু পাঠান। যখন তা ঘন মেঘ বহন করে আনে, আমি তখন এ মেঘমালাকে মৃত ভূখণ্ডের দিকে প্রেরণ করি, সেখানে বৃষ্টিপাত ঘটাই এবং এর মাধ্যমে সব ধরনের ফসল উৎপাদন করি। এভাবেই আমি মৃতকে জীবিত করি, সম্ভবতঃ তোমরা [আল্লাহ্‌কে] স্মরণ করবে।" (৫৭)

পানি হচ্ছে জীবনের উৎস। এ আয়াতে এ সম্পর্ক বলা হয়েছে, আল্লাহর নির্দেশেই সমুদ্রের পানি বাষ্পিত হয়ে ঘনকালো মেঘরূপে বায়ু তারিত হয়ে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হয়। বাতাসের আর্দ্রতাই আমাদের জানিয়ে দেয় বর্ষণের পূর্বাভাস। এই যে প্রাকৃতিক আইন, তা আল্লাহরই সৃষ্টি। আল্লাহ্‌র সৃষ্ট প্রাকৃতিক আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়েই মেঘমালা স্থলভাগে বারি বর্ষণ করে। ফলশ্রুতিতে সমস্ত শুষ্ক মৃত মাটি সজীব হয়ে ওঠে এবং শস্য ও ফল-ফুলে ধরীত্রি সুশোভিত হয়ে যায়। এটা আল্লাহরই মহিমা। এর মধ্যদিয়ে আল্লাহ যে এক ও অদ্বিতীয়, কেবল সে বিষয়টিই প্রমাণিত হয় না বরং মৃত্যুর পর মানুষকে যে আবার জীবিত করা হবে,তারও ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতিকে আবিস্কার করার মাধ্যমে ঈমানদাররা আল্লাহর প্রতি আরো বেশি কৃতজ্ঞচিত্ত হয়।

দুই. মৃত্যু মানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া নয়। তা কেবল অবস্থার পরিবর্তন।

সূরা আ'রাফের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَالْبَلَدُ الطَّيِّبُ يَخْرُجُ نَبَاتُهُ بِإِذْنِ رَبِّهِ وَالَّذِي خَبُثَ لَا يَخْرُجُ إِلَّا نَكِدًا كَذَلِكَ نُصَرِّفُ الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَشْكُرُونَ ((৫৮

"যে ভূখণ্ড পবিত্র (ও প্রস্তুত), প্রতিপালকের আদেশে তা ফসলে [সমৃদ্ধ] হয়। কিন্তু যে ভূখণ্ড নিকৃষ্ট, তাতে সামান্য ফসল ছাড়া আর কিছুই জন্মায় না। এভাবেই আমি কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ বিভিন্ন [প্রতীকের] মাধ্যমে বর্ণনা করি। (৭:৫৮)

আগের আয়াতে আল্লাহর রহমত হিসেবে বৃষ্টির কথা তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, যদিও বৃষ্টি হচ্ছে জীবনের উৎস, কিন্তু এই বৃষ্টিকে কাজে লাগানোর জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রয়োজন। এমন ভূখণ্ড প্রয়োজন,যা পানিকে ধারণ করে সবুজ ফসল ফলাতে পারে। কিন্তু লবনাক্ত জমির পানি ধারণ করার শক্তি নেই। এ কারণে বৃষ্টির ফলে এ ধরনের জমি উল্টো দুর্গন্ধময় স্থানে পরিণত হয়। সেই দুর্গন্ধে অন্যরা কষ্ট পায়।

স্বয়ং কুরআনের আয়াতগুলো হচ্ছে ঐশি রহমত। যদি কেউ পূর্ব প্রস্তুতি সহকারে ভালো মন নিয়ে কুরআন অধ্যয়ন করে তাহলে তা মানুষকে আধ্যাত্মিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু কুরআনের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে তা পাঠ করলে মানুষ সৎ পথের সন্ধান পাওয়ার পরিবর্তে আরো বেশি ঈর্ষাপরায়ন ও অহংকারী হয়ে উঠে। এই পৃথিবীতে বৃষ্টির পানি জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে একথা ঠিক, তবে সব জমির জন্য একথা প্রযোজ্য নয়। যে জমির গুণগত মান উন্নত এবং পলিমাটি সমৃদ্ধ, সেই মাটি বৃষ্টি দ্বারা বেশি উপকৃত হয়। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও যে আত্মা সৎ কাজে বেশি অভ্যস্ত সেই সৎ আত্মা আল্লাহ্‌র রহমতের বৃষ্টিতে পরিপূর্ণতা লাভ করে মুক্তি পায়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. সৎ পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য মানুষের ওপর আল্লাহর রহমত বিদ্যমান। কিন্তু সেই রহমত ধারণ করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনেকেই অর্জন করতে পারে না।

দুই. পবিত্রতা কল্যাণের পথ প্রশস্ত করে। কিন্তু অপবিত্রতা মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করে।

 

সূরা আ'রাফের ৫৯ ও ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ (৫৯) قَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِهِ إِنَّا لَنَرَاكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ ((৬০

"আমি নূহ্‌কে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিলো, "হে আমার সম্প্রদায় ! আল্লাহ্‌র ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন উপাস্য নাই। আমি তোমাদের জন্য এক ভয়াবহ দিনের শাস্তির ভয় করছি।" (৭:৫৯)

"তাঁর সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলেছিলো, "আমরা তো তোমাকে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখছি।" (৭:৬০)

আগের আয়াতে মৃত ও অনুর্বর জমির কথা তুলে ধরার পর এ আয়াতে নূহ (আ.) ও তার সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের অন্য কয়েকটি আয়াতের তথ্য থেকে জানা যায়, নূহ্‌ (আ.) সাড়ে নয়শ' বছর ধরে তার সম্প্রদায়কে পরকালের শাস্তির ভয় দেখিয়ে সৎপথে আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা তাতে কান দেয়নি বরং নূহ (আ.)কে উপহাস করেছে এবং কষ্ট দিয়েছে। ফলে তাদের ওপর আল্লাহ্‌র শাস্তি  নেমে এসেছিল। এ আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত নূহ (আ.) সব সময় মানুষকে একত্ববাদের দাওয়াত দিতেন। কিন্তু ওই সম্প্রদায়ের প্রধানরা নবীকে অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত বলে অভিহিত করতো। এ কারণে তাদের অনুসারীরাও নবীকে মানতো না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. আল্লাহর সব নবী-রাসূলই মানুষকে একত্ববাদের দাওয়াত দিয়েছেন। তারা মানুষকে মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

দুই. ইতিহাসের সব যুগেই নবী-রাসূলদের প্রধান বিরোধী ছিলো অর্থবান ও ক্ষমতাধররা। কারণ পার্থিব জীবনের বাহ্যিক চাকচিক্যের কারণে তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এমনকি তাদের ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করে।

সূরা আ'রাফের ৬১ ও ৬২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي ضَلَالَةٌ وَلَكِنِّي رَسُولٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (৬১) أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنْصَحُ لَكُمْ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ((৬২

"সে বলেছিলো, হে আমার সম্প্রদায় ! আমার [মনে] কোন বিভ্রান্তি নাই। বরং আমি জগত সমূহের প্রতিপালক প্রভুর রাসূল।" (৭:৬১)

"তোমাদের প্রতি আমার প্রভুর মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাজ আমি সম্পাদন করেছি। তোমাদের প্রতি আমার উপদেশ আন্তরিক এবং আমি আল্লাহ্‌র নিকট থেকে এমন কিছু জানি, যা তোমরা জান না।" (৭:৬২)

নূহ (আ.)এর সম্প্রদায়ের প্রধানদের অসম্মানজনক বক্তব্য অর্থাত তাকে বিভ্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করার জবাবে নূহ (আ.) পাল্টা গালিগালাজ বা অবমাননাকর কথা বলেননি। তিনি নিজের বিরুদ্ধে বিপথগামিতার অপবাদকেই কেবল প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি যা বলছি তা কোন ধরনের বিভ্রান্ত হয়ে বলছি না বরং এটা হচ্ছে আল্লাহরই বাণী। আমার দায়িত্ব হচ্ছে আপনাদের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেয়া যে, আল্লাহ শুধু আমাদের প্রতিপালক নয় বরং তিনি গোটা বিশ্বের প্রতিপালক। আমিও আপনাদের মঙ্গল চাই। কাজেই যা বলছি সহানুভুতি থেকে বলছি। আমি আমার জন্য কিছুই চাই না।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. অজ্ঞদের অবমাননার মোকাবেলায় ধৈর্য্যশীল হতে হবে। তাদের মতোই আচরণ করা যাবে না।

দুই. প্রচারক ও প্রশিক্ষককে কল্যাণকামী ও সহানুভূতিশীল হতে হবে। পাশাপাশি জ্ঞানী ও বিজ্ঞ হতে হবে, যাতে তাদের মাধ্যমে মানুষ বিভ্রান্ত না হয়।

তিন.নবী-রাসূলরা এমন অনেক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, যা সাধারণ মানুষের নেই।