সূরা আ'রাফ; আয়াত ৭৭-৮২
সূরা আ'রাফের ৭৭ ও ৭৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَعَقَرُوا النَّاقَةَ وَعَتَوْا عَنْ أَمْرِ رَبِّهِمْ وَقَالُوا يَا صَالِحُ ائْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الْمُرْسَلِينَ (77) فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ (78(
"তারপর তারা সেই উটটিকে মেরে ফেললো। পূর্ণ দাম্ভিকতাসহ নিজেদের রবের আদেশ অমান্য করলো এবং সালেহ'কে বললো : যদি সত্যিই তুমি নবী হয়ে থাকো তাহলে নিয়ে এসো সেই আজাব, যার হুমকি তুমি আমাদের দিয়ে থাকো।" (৭:৭৭)
"অবশেষে ভূমিকম্প তাদের গ্রাস করলো এবং তারা নিজেদের ঘরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল। (৭:৭৮)
আগের পর্বে আমরা বলেছিলাম হযরত সালেহ (আ.) সামুদ জাতির সামনে মোজেযা হিসেবে এমন একটি উটকে হাজির করেছিলেন যেটি পাহাড় ফেটে বেরিয়ে এসেছিল। এটি স্বাভাবিক উটের চেয়ে বেশি পানি পান করতো এবং দুধও দিত সাধারণ উটের চেয়ে অনেক বেশি। আল্লাহ সামুদ জাতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন ওই উটটির কোন ক্ষতি না করে। কিন্তু ওই জাতির নেতৃস্থানীয় লোকজন দেখলো, অলৌকিক উটটির কারণে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করে হযরত সালেহ (আ.)-এর উম্মতে পরিণত হচ্ছে। এসব নেতা তাদের নেতৃত্বকে বিপদাপন্ন হতে দেখলো। তারা উটটিকে হত্যা করার জন্য ঘাতক বাহিনী নিয়োগ দিল যাতে আল্লাহর নবীর অলৌকিক নিদর্শনটি উধাও হয়ে যায়।
তাদের ধারণা ছিল, উটটিকে হত্যা করতে পারলে হযরত সালেহ জনগণকে কোন নিদর্শন দেখাতে পারবেন না। এ কারণে তারা চরম ধৃষ্ঠতা দেখিয়ে উটটিকে হত্যা করে। এরপর তারা হযরত সালেহ (আ.) কে ঠাট্টা করে বলতে থাকে, তুমি এতদিন যে আজাব বা শাস্তির কথা বলছিলে এখন পারলে তোমার সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে তা নাজিল করো। যদিও সাধারণ মানুষ উট হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল না এবং এক বিশেষ ঘাতক এ কাজ করেছিল কিন্তু এ মহা অপরাধের ব্যাপারে তাদের নীরবতা তাদেরকে ওই পাপকাজের অংশীদার করে দিয়েছিল এবং আল্লাহর নির্দেশে তারা সবাই ধ্বংস হয়ে গেলা।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. গর্ব ও অহঙ্কার মানুষকে আল্লাহর নাফরমানি করতে উদ্বুদ্ধ করে।
দুই. পাপকাজের ব্যাপারে নীরবতা মানুষকে ওই পাপকাজের ভাগীদার করে। এটি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার শামিল।
তিন. ভূমিকম্পসহ এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের পাপকাজের ফল হতে পারে। কাজেই সব সময় আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা উচিত।
সূরা আ'রাফের ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَتَوَلَّى عَنْهُمْ وَقَالَ يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَةَ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ وَلَكِنْ لَا تُحِبُّونَ النَّاصِحِينَ (79(
"আর সালেহ তাদের এ কথা বলতে বলতে সে জনপদ থেকে বেরিয়ে গেল : হে আমার সম্প্রদায়! আমার রবের বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি এবং আমি তোমাদের জন্য যথেষ্ট কল্যাণ কামনা করেছি। কিন্তু তোমরা যদি নিজেদের হিতাকাঙ্ক্ষীকে পছন্দ না করো, তাহলে আমি কি করতে পারি?" (৭:৭৯)
হযরত সালেহ (আ.) এ বক্তব্যটি ঠিক কখন দিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। হতে পারে তিনি তার সম্প্রদায়ের ওপর আল্লাহ আজাব নাজিল হওয়ার আগ মুহূর্তে নিজের শেষ দায়িত্ব পালনের জন্য এ কথাগুলো বলেছিলেন। অথবা এও হতে পারে, তিনি তার অন্ধ ও গোঁড়া সম্প্রদায়ের সব মানুষ নিহত হওয়ার পর তাদের লাশের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় এ বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি এখানে বলছেন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। তোমাদের উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে আমি কোন কার্পণ্য করিনি। কিন্তু তোমরা তোমাদের অন্যায় আচরণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছো, উপদেশ শোনার পাত্র তোমরা নও। ভালো কথা শোনার মতো অবস্থা তোমাদের নেই।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. নবী-রাসূলগণ মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতেন। তারা কখনোই দায়সারাভাবে বার্তা পৌঁছে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি।
দুই. আমাদের উচিত উপদেশ গ্রহণ করা এবং যারা সতপথের উপদেশ দেয় তাদের ভালোবাসা। তাদেরকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করলে আল্লাহর শাস্তি নেমে আসতে পারে।
সূরা আ'রাফের ৮০ ও ৮১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন-
وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِنَ الْعَالَمِينَ (80) إِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِنْ دُونِ النِّسَاءِ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ مُسْرِفُونَ (81(
"আর আমি লুতকে পয়গম্বর করে পাঠাই। তারপর স্মরণ করো, যখন সে নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের বললো : তোমরা কি এতই নির্লজ্জ হয়ে গেলে যে, দুনিয়ায় এর পূর্বে কেউ কখনো করেনি, এমন অশ্লীল কাজ করে চলেছো?" (৭:৮০)
"তোমরা মেয়েদের বাদ দিয়ে ছেলেদের দ্বারা কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করছো? প্রকৃতপক্ষে তোমরা একবারেই সীমা লঙ্ঘনকারী গোষ্ঠী।" (৭:৮১)
হযরত লুত (আ.) হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর যুগে জীবনযাপন করতেন। তাঁকে হযরত ইব্রাহিম (আ.) তার পাপাচারী সম্প্রদায়কে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই পাপিষ্ঠ সম্প্রদায় সমকামিতার মতো জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিলো। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলছেন, লুত সম্প্রদায়ের আগে অন্য কোন জাতি এত জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত হয়নি। বর্তমান আধুনিক যুগেও পশ্চিমা কোন কোন দেশে এ জঘন্য অনাচারকে আইনি বৈধতা দেয়া হয়েছে। আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এ সম্পর্কে বলেছেন : যেসব পুরুষ অন্য পুরুষের লালসা চরিতার্থ করার জন্য নিজেদেরকে নারীর আসনে বসায় তারা আল্লাহর চরম অভিশাপের শিকার। উভয়ের জন্য এ জঘন্য কাজের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. সমকামিতা স্বাভাবিক যৌন প্রক্রিয়ার সীমা লঙ্ঘন করে। এর ফলে সমাজে নারী ও পুরুষের স্বাভাবিক অধিকার লঙ্ঘিত হয় এবং সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
দুই. সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো- যদি কোন সমাজে চরম খারাপ ও পাপকাজ মানুষের চোখে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয় তাহলে ওই সমাজের ওপর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খোদায়ী বালা-মুসিবত নেমে আসে।
সূরা আ'রাফের ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَنْ قَالُوا أَخْرِجُوهُمْ مِنْ قَرْيَتِكُمْ إِنَّهُمْ أُنَاسٌ يَتَطَهَّرُونَ (82(
"কিন্তু তার সম্প্রদায়ের জবাব এ ছাড়া কিছু ছিল না যে, "এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা বড়ই পবিত্রতার ধ্বজাধারী হয়েছে।" (৭:৮২)
হযরত লুত (আ.)-এর কথা অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তার সম্প্রদায়ের পাপিষ্ঠ ব্যক্তিরা তাকে এবং তার অনুসারীদের ওই এলাকা থেকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নিজেদের সংশোধনের পরিবর্তে আল্লাহর নবী ও তার অনুসারীদের বলে : তোমরা আমাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে যাও, আমরাই এখানে বসবাস করবো।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. পাপকাজ ও ব্যাভিচারের কোন যুক্তি বা ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। পাপাচারীরা যুক্তিতে না পেরে উল্টোপাল্টা বলতে শুরু করে।
দুই. আমরা যদি সমাজে পাপকাজে বাধা না দেই তাহলে একসময় পাপিষ্ঠ ব্যক্তিরা আমাদেরকে ওই সমাজ থেকে বের করে দেবে অথবা আমাদেরকে বাধ্য হয়ে ওই সমাজ থেকে চলে যেতে হবে।