সূরা আল আনফাল;(৭ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আল আনফাল;(৭ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:38:31 2-10-1403

সূরা আল আনফাল; আয়াত ৩০-৩৩

সূরা আনফালের ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّهُ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ

“স্মরণ কর সেই সময়ের কথা যখন অবিশ্বাসীগণ তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তোমাকে বন্দি করার জন্য, হত্যা অথবা নির্বাসিত করার জন্য এবং তারা ষড়যন্ত্র করেছিল এবং আল্লাহও কৌশল গ্রহণ করেছিলেন এবং কৌশল গ্রহণকারীদের মধ্যে আল্লাহই শ্রেষ্ঠ।” (৮:৩০)

এই পবিত্র আয়াতটি ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়, যে ঘটনার কারণে আল্লাহর রাসূল মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। রাসূল (সা.)এর নবুয়্যত প্রাপ্তির ১৩ বছর পর যখন ইসলামের আহ্বান মক্কায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, দলে দলে মানুষ বিশেষ করে যুবকরা মুসলমান হচ্ছিল তখন উদ্বিগ্ন আরব নেতারা ইসলাম এবং রাসূলে খোদাকে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করে। দারুন্‌ নদওয়া নামক একটি স্থানে তারা মিলিত হয়। ইসলামকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য মক্কার নেতাদের পক্ষ থেকে তিনটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। কেউ প্রস্তাব দেয় হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে বন্দী করে কারারুদ্ধ করা হোক, কেউ বলে না তাকে মক্কা থেকে অন্য কোথাও নির্বাসিত করা হোক, আবার কারো পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে মুহাম্মদকে হত্যা করা হোক যাতে তার ধর্ম বা মতাদর্শ চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত হত্যার প্রস্তাবটিই ওই বৈঠকে গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত হয় প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে এই পরিকল্পনায় অংশ নেবে যাতে মুহাম্মদ(সা.)এর আত্মীয়-স্বজন রক্তের বদলা নেয়ার জন্য উদ্যত হতে না পারে।

এদিকে, আল্লাহর রাসূল কাফেরদের এই চক্রান্ত হযরত জিব্রাইল (আ.) অর্থাত অহির ফেরেশতার মাধ্যমে পেয়ে যান এবং সেই রাতেই আল্লাহর হুকুমে তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। রাসূলে খোদা (সা.) হযরত আলীকে তার বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার নির্দেশ দিয়ে যান যাতে কাফেররা এটা মনে করে যে পয়গম্বর (দ.) ঘরে তার বিছানাতেই শুয়ে আছেন। এই আয়াতে মহান আল্লাহ কাফেরদের সেই ষড়যন্ত্র এবং তার বিপরীতে আল্লাহর কৌশল সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছেন। এখানে এটাই বোঝানো হচ্ছে যে, অবিশ্বাসীদের গর্ব ও অহংকার করার কিছু নেই। তারা যেন এটা মনে না করে  যে তাদের ষড়যন্ত্র বা কৌশল ব্যর্থ হবে না। আর মুমিনদেরও হতাশ হওয়া বা এটা মনে করা উচিত নয় যে আল্লাহ হয়ত তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন বা অপছন্দ করছেন।

সূরা আনফালের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آَيَاتُنَا قَالُوا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَذَا إِنْ هَذَا إِلَّا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ

“আর যখন তাদের নিকট আমার আয়াত পাঠ করা হয় তখন তারা বলে- আমরা তো শ্রবণ করলাম ইচ্ছা করলে আমরাও এর অনুরূপ বলতে পারি, এতো শুধু সেকালের লোকদের উপকথা।” (৮:৩১)

আগের আয়াতটিতে রাসূলে করিম (সা.)এর জীবনের ওপর আঘাত করার ব্যাপারে কাফেরদের পরিকল্পনা বা দুরভিসন্ধির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই আয়াতে আল্লাহর রাসূলের ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাত বা তার প্রচারিত বাণীর প্রতি কাফের মুশরিকদের তাচ্ছিল্য রসিকতা করার কথা বলা হয়েছে। কাফের মুশরিকরা এতদূর অগ্রসর হয়েছিল যে, তারা পবিত্র কুরআনকে রূপকথার বই বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতো। কাফের মুশরিকরা আল্লাহর কালাম বা ঐশি বাণী নিয়ে নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করলেও আজ পর্যন্ত কোনো মানুষের পক্ষে কুরআনের একটি আয়াতের অনুরূপ আয়াতও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বরং যারাই পবিত্র কুরআনের স্পর্শে এসেছে তারাই এই ঐশি বাণীর মাধুর্য্য এবং অর্থের গভীরতা উপলব্ধি করে মুসলমান হয়েছেন অথবা মুসলমান না হলেও কুরআনের প্রতি বিদ্বেষ পরিত্যাগ করেছেন।

সূরা আনফালের ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ قَالُوا اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ

“স্মরণ কর যখন তারা বলেছিল, হে আল্লাহ! (মুহাম্মদ যেসব কথা বলে) সেগুলো যদি সত্য হয়, তবে আমাদের ওপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ কর কিংবা আমাদেরকে কঠিন শাস্তি দাও।” (৮:৩২)

এ আয়াতে রাসূলে খোদার প্রতি অবিশ্বাসী কাফেরদের শত্রুতা ও বিদ্বেষের গভীরতা ফুটে উঠেছে। কাফেররা নবীজির কথা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। এজন্য তারা নবীজিকে বলে, স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং খোদার শাস্তি সম্পর্কে তোমার দাবি যদি সত্যিই হয় তাহলে তোমার স্রষ্টাকে বলো আমাদের ওপর কঠিন শাস্তি নাজিল করার জন্য। তিনি যেন আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করে আমাদের শাস্তি দেন।

অনেক মুফাসসিরদের মতে, কাফেররা সাধারণ মানুষের সৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আসলে খোদার বিরুদ্ধাচরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের কঠোর ভাষা এবং বাচনভঙ্গি ব্যবহার করেছে। সাধারণ মানুষ তাদের কথা বলার ধরন দেখে ভাবতে পারে, এরা নিশ্চয়ই সত্যের পথে রয়েছে না হলে তারা এতো দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি কামনা করতে পারতো না। এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি কখনও কখনও অন্যের প্রতি শত্রুতা, বিদ্বেষ এবং পরশ্রীকাতরতা মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। অন্যের প্রতি বিদ্বেষ বা পরশ্রীকাতরতা মনের মধ্যে এত তীব্র জ্বালার সৃষ্টি করে যে, এরজন্য মানুষ মৃত্যুকে বরণ করতেও দ্বিধা করে না। এ আয়াত থেকে এটাও বোঝা যায় যে, রাসূলে খোদার বিরুদ্ধাচরণকারীদের অনেকেই ছিল আহলে কিতাবের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাত তারা আল্লাহ এবং ঐশি গ্রন্থে বিশ্বাস করতো কিন্তু তারপরও তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি হয়নি।

সূরা আনফালের ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ

“আল্লাহ এমন নন যে, তুমি তাদের মধ্যে থাকবে অথচ তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন এবং আল্লাহ এমনও নন যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে অথচ তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন।” (৮:৩৩)

এ আয়াতে রাসূলের খোদার উপস্থিতিকে আল্লাহর রহমত এবং অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে-রাসূলে খোদার উপস্থিতির কারণেই আল্লাহ মুসলমানদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন এবং তাদেরকে শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন। যেমনিভাবে, লুত সম্প্রদায়ের ওপর শাস্তি আরোপের আগে মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে ওই শহর থেকে চলে যাবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন হাদিসেও এসেছে, মহান আল্লাহ তার সতকর্মশীল এবং পবিত্র বান্দাদের কারণে বিভিন্ন জনপদকে শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকেন। অবশ্য রাসূলে খোদার জীবন এবং তাঁর উপস্থিতি নির্দিষ্ট একটা সময় এবং কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু সর্বকালে এবং সর্বযুগে আল্লাহর শাস্তি এবং অভিশাপ থেকে নিজেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে তওবা বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর এ আয়াতে এ বিষয়ের উপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

নবীজির ইন্তেকালের পর হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন, আমাদের দু’টি রক্ষাকবচের মধ্যে একটা আমাদের কাছ থেকে চলে গেছে। কাজেই অপর রক্ষা কবচটি অর্থাত ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগকে কোনোভাবেই হাতছাড়া কর না। এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, আল্লাহর সতকর্মশীল বান্দা এবং অলী-আওলিয়াদের উপস্থিতি আল্লাহর শাস্তি থেকে মানুষকে রেহাই দিতে পারে। কাজেই সমাজে তাদের উপস্থিতিকে আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে দেখা উচিত এবং তাদেরকে যথাযথ সম্মান করা উচিত। আর আরেকটা বিষয়ের প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত আর সেটা হচ্ছে তওবা এবং প্রার্থনা কেবল আখেরাতে মুক্তি লাভের মাধ্যম নয়-পার্থিবো জীবনেও এর মাধ্যমে নানা রকম বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।