সূরা আ'রাফ; আয়াত ৪৪-৪৮
সূরা আ'রাফের ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَنَادَى أَصْحَابُ الْجَنَّةِ أَصْحَابَ النَّارِ أَنْ قَدْ وَجَدْنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا فَهَلْ وَجَدْتُمْ مَا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا قَالُوا نَعَمْ فَأَذَّنَ مُؤَذِّنٌ بَيْنَهُمْ أَنْ لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ (44)
"জান্নাতিরা জাহান্নামিদের ডেকে বলবে : আমাদেরকে আমাদের প্রতিপালক যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমরা তার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। তোমরাও কি তোমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতির সত্যতার প্রমাণ পেয়েছো? তারা বলবে : হ্যাঁ। এরপর একজন ঘোষক উভয়ের মাঝখানে ঘোষণা করবে : জালিমদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক।" (৪৪)
আগের পর্বে আমরা জাহান্নামবাসীদের নিজেদের মধ্যে এবং জান্নাতবাসীদের পরস্পরের সঙ্গে কথোপকথনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এ আয়াতে জাহান্নামবাসীদের সঙ্গে জান্নাতবাসীদের আলোচনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য পবিত্র কোরানে এ বিষয়টির অবতারণা করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, উত্তম কাজের পুরস্কার এবং মন্দ কাজের শাস্তির বিষয়টি সত্য। পরকালে জাহান্নামবাসীরা তাদের কৃতকর্মের বিষয়টি স্বীকার করলেও সেদিন তা তাদের কোন কাজে আসবে না। সেদিন তাদের ধিক্কার জানানো হবে এবং আল্লাহর কোন অনুকম্পা তারা পাবে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. জান্নাত ও জাহান্নামের অবস্থান এমন হবে যে এক স্থানের অধিবাসীরা অপর স্থানের অধিবাসীদের দেখতে এবং পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।
দুই. জালিম ব্যক্তি জাহান্নামি হয়। নিজের প্রতি বা পরিবারের প্রতি কিংবা সমাজের প্রতি জুলুমকারী ব্যক্তি কেয়ামতের দিন আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না।
সূরা আ'রাফের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا وَهُمْ بِالْآَخِرَةِ كَافِرُونَ ((45
"যারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং তাতে বক্রতা অন্বেষণ করে, তারা পরকালে অবিশ্বাসী।" (৪৫)
আগের আয়াতে আমরা বলেছি, কিয়ামত বা বিচার দিবসে জালিম ব্যক্তি আল্লাহর আদালত থেকে পাওয়া শাস্তি মাথায় নিয়ে জাহান্নামে যাবে। তারই সূত্র ধরে এ আয়াতে বলা হচ্ছে, ধর্মের প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই শুধু তারাই জালিম নয় সেইসঙ্গে যারা অন্যকে ধর্মচ্যুত করার চেষ্টা করে তারাও জালিম। এ ধরনের মানুষ যে কোন উপায়ে ধর্মের বিকৃত রূপ তুলে ধরে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। যারা মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়া, বেদআত, কুসংস্কার ও ধর্মকে মূল অবস্থান থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে, মহান আল্লাহ তাদেরকে জালিম হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. ধর্মের শত্রুরা সামর্থ্য থাকলে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আর সামর্থ্য না থাকলে কৌশলে ধার্মিক ব্যক্তিকে লক্ষ্যচ্যুত করার চেষ্টা চালায়।
দুই. সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানার মতো বড় জুলুম আর নেই। কাজেই এর শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।
সূরা আ'রাফের ৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَبَيْنَهُمَا حِجَابٌ وَعَلَى الْأَعْرَافِ رِجَالٌ يَعْرِفُونَ كُلًّا بِسِيمَاهُمْ وَنَادَوْا أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَمْ يَدْخُلُوهَا وَهُمْ يَطْمَعُونَ ((46
"উভয়ের মাঝখানে একটি প্রাচীর থাকবে এবং আ'রাফের উপরে অনেক লোক থাকবে। তারা প্রত্যেককে তার চিহ্ন দ্বারা চিনে নেবে। তারা জান্নাতিদের ডেকে বলবে: তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তারা তখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না কিন্তু প্রবেশ করার ব্যাপারে আগ্রহী হবে।" (৪৬)
এ আয়াতে আ'রাফ নামক স্থানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এটি জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী একটি জায়গা। এ জায়গার উপরে বিশেষ কিছু লোক অবস্থান করবেন এবং তারা জান্নাত ও জাহান্নামবাসীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন। আ'রাফ শব্দটি পবিত্র কুরআনের একটিমাত্র সূরায় এসেছে এবং এ কারণে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে 'আ'রাফ'।
বিভিন্ন তাফসির ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, আ'রাফে আল্লাহর খাঁটি বান্দা ও প্রিয়পাত্রগণ অবস্থান নেবেন। এ কারণে তারা জাহান্নাম ও জান্নাতবাসীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের অনুমতি পাবেন। তারা মানুষের চেহারা দেখে বলে দিতে পারবেন কে জান্নাতি আর কে জাহান্নামের অধিবাসী। অবশ্য কোন কোন মুফাসসির দুর্বল ঈমানের সেইসব ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন আল্লাহর প্রতি যাদের ঈমান থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় সৎকাজ করে আসেননি। তাদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী স্থানে রাখা হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. মানুষের চেহারার ওপর তার আচরণের প্রভাব পড়ে। পুণ্যবান ব্যক্তিরা মানুষের চেহারা দেখে তার মনের কথা বলে দিতে পারেন।
দুই. আ'রাফ হচ্ছে মানবীয় মর্যাদার অতি উচ্চ স্থান। আমাদের উচিত এমন কাজ করা যাতে ওই মর্যাদায় আসীন হতে পারি।
সূরা আ'রাফের ৪৭ ও ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذَا صُرِفَتْ أَبْصَارُهُمْ تِلْقَاءَ أَصْحَابِ النَّارِ قَالُوا رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ (৪৭) وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ ((৪৮
"যখন তাদের দৃষ্টি জাহান্নামিদের উপর পড়বে, তখন বলবে : হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এ জালেমদের সাথী করো না।" (৪৭)
"আ'রাফবাসীরা যাদেরকে তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে তাদেরকে ডেকে বলবে : তোমাদের দলবল ও ঔদ্ধত্য তোমাদের কোন কাজে আসেনি।" (৪৮)
আগের আয়াতে আমরা জেনেছি যে, আ'রাফে তারাই স্থান পাবেন যারা সাধারণভাবে জান্নাতে যেতে চান। এ আয়াতে জাহান্নামবাসীদের সঙ্গে তাদের কথোপকথোনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে : আ'রাফের অধিবাসীরা সব সময় জান্নাতবাসীদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু যখন অন্যমনস্কতার কারণে তাদের চোখ জাহান্নামের দিকে পড়ে, তখন তারা আল্লাহর কাছে আবেদন জানাবেন, তাদেরকে যেন জাহান্নামে পাঠানো না হয়। আ'রাফবাসীরা আল্লাহর কাছে নিবেদন করবেন, তাদেরকে যেন জালিমদের অন্তর্ভূক্ত করা না হয়। এ থেকে বোঝা যায়, জালিমদের সঙ্গে বসবাস জাহান্নামের আগুন সহ্য করার চেয়েও ভয়ঙ্কর। আ'রাফবাসীরা জাহান্নামবাসীদের সঙ্গে আলাপের সময় তাদেরকে বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে যা কিছু নিয়ে গর্ব করতে তা আজ তোমাদের কোন কাজেই আসছে না। ক্ষমতা, ধন-সম্পদ কিংবা লোকবলের কোন মূল্যই এখানে নেই।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. কিয়ামতের দিন পুণ্যবানদের অবজ্ঞার পাত্র হওয়ার আগে এ পার্থিব জীবনেই আমাদেরকে সব ধরনের গর্ব ও অহংকার থেকে দূরে থাকতে হবে। পৃথিবীর ক্ষমতা কিংবা সম্পদের বড়াই পরকালে কোন কাজে আসবে না।
দুই. সম্পদ ও ক্ষমতা পৃথিবীতেই কেবল কাজে লাগে। কাজেই আমাদের উচিত পরকালের কাজে লাগে এমন সম্পদ আহরণ করে মৃত্যুবরণ করা।