সূরা আ'রাফ; আয়াত ৫৩-৫৬
সূরা আ’রাফের ৫৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا تَأْوِيلَهُ يَوْمَ يَأْتِي تَأْوِيلُهُ يَقُولُ الَّذِينَ نَسُوهُ مِنْ قَبْلُ قَدْ جَاءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ فَهَلْ لَنَا مِنْ شُفَعَاءَ فَيَشْفَعُوا لَنَا أَوْ نُرَدُّ فَنَعْمَلَ غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ قَدْ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ وَضَلَّ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ
“তারা (অর্থাত কাফেররা) কি এখন এ অপেক্ষায়ই আছে যে, এর বিষয়বস্তু প্রকাশিত হোক? যেদিন এর বিষয়বস্তু প্রকাশিত হবে, সেদিন আগে যারা একে ভুলে গিয়েছিল, তার বলবে : সত্যিই আমাদের প্রতিপালকের পয়গম্বরগণ সত্যসহ আগমন করেছিলেন। কাজেই, আমাদের জন্য কোন সুপারিশকারী আছে কি যে, সুপারিশ করবে অথবা আমাদের আবার (পৃথিবীতে) পাঠানো হলে আমরা আগে যা করতাম, তার বিপরীত কাজ করে আসতাম। নিশ্চয়ই তারা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তারা মনগড়া যা বলতো তা উধাও হয়ে গেছে।” (৭:৫৩)
আপনাদের হয়তো মনে আছে, গত কয়েকটি আসরে পবিত্র কুরআনে জান্নাত ও জাহান্নামবাসীদের মধ্যে কথোপকথোনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতে কেয়ামতের দিন অপরাধীদের অপরাধ স্বীকারের কথা বলা হয়েছে। এসব অপরাধী খামাখা কিয়ামত সম্পর্কে রাসূলের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করে। কেয়ামতের দিন তারা নিজেদের দোষ স্বীকার করে বলবে : মহান আল্লাহ আমাদের কাছে সঠিক পথ প্রদর্শনের সব ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও আমরা তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করিনি। আমরা রাসূলের কথা প্রত্যাখ্যান করেছি। তারা প্রশ্ন করবে, আমাদের এ স্বীকারেক্তির ফলে কি আমাদের অপরাধের মাত্রা কমিয়ে দেয়া হবে? আমাদের শাফায়াত করার মতো কেউ আছে কি? তারা আল্লাহর কাছে চাইবে তাদেরকে যেন পৃথিবীতে আবার ফেরত পাঠানো হয় যাতে তারা আবার পুন্যকাজ করার সুযোগ পায়। কিন্তু আল্লাহর প্রতিশ্রুত কঠিন শাস্তি দেখার পর এ ধরনের অনুশোচনা কোন ফল বয়ে আনবে না। সেদিন অপরাধীরা শুধু অনুতাপ ও দুঃখই করবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :
এক. পবিত্র কুরআনের দিক-নির্দেশনা এই পৃথিবীতেই মেনে চলতে হবে। কিয়ামতের দিন কান্নাকাটি করে কোন ফল পাওয়া যাবে না।
দুই. কিয়ামতের দিন নবী-রাসূলদের শাফায়াত বা সুপারিশ নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য নির্ধারিত থাকবে। কাজেই শাফায়াত পাওয়ার আশায় পৃথিবীতে গোনাহ বা অপরাধ করা যাবে না।
সূরা আ’রাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
“নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি আসমান ও জমিনকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। এরপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি রাতের উপর দিনকে এমন অবস্থায় পরিয়ে দেন যে, দিন দৌড়ে দৌড়ে রাতের পেছনে আসে। তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রকে এবং এগুলো তাঁর আদেশের অনুগামী।। শুনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা। আল্লাহ সেই বরকতময় সত্ত্বা যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।” (৫৪)
মহান আল্লাহ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার প্রত্যাখ্যান করে এ আয়াতে প্রকৃত আল্লাহর বর্ণনা দিয়ে বলা হচ্ছে : তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আসমান ও জমিনের মালিক। চন্দ্র, সূর্য এবং গ্রহ-নক্ষত্র তাঁরই সৃষ্টি। রাত ও দিনসহ অস্তিত্বসম্পন্ন সব কিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন। কাজেই এ সৃষ্টিজগত পরিচালনায় কর্তৃত্বও তাঁরই। একজন সৃষ্টি করেছেন অন্য একজন তা পরিচালনা করবেন- এমনটি হতে পারে না। কিংবা এটিও সম্ভব নয় যে, এক একটি জিনিসের সৃষ্টিকর্তা এক একজন। বরং এ বিশ্বজগতের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ। সবকিছুই তাঁর কাছে থেকে উতসারিত। অবশ্য আল্লাহ ইচ্ছে করলে এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে অত্যন্ত বিজ্ঞচিতভাবে ক্রমান্বয়ে সবকিছুকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। আকাশ ও ভূপৃষ্ঠ তিনি ছয়টি পর্যায়ে তৈরি করেছেন। এরপর এ জগত পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আরশ নামক স্থানকে বেছে নিয়েছেন তিনি।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. মহান আল্লাহ পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্ব চরাচর সৃষ্টি করেছেন। এ ছাড়া, এটি পরিচালনার জন্যও একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তিনি তৈরি করেছেন। যখন-তখন যা খুশি তাই করা আল্লাহর মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
দুই. যে কোন কাজে তাড়াহুড়া করা শয়তানের কাজ। আর ধীরস্থিরভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করা আল্লাহর রীতি।
তিন. সৃষ্টিজগত ধীরে ধীরে পূর্ণতার দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং এ কাজ পরিচালনা করছেন স্বয়ং আল্লাহ। বিশ্ব চরাচরের টিকে থাকা নির্ভর করছে মহান আল্লাহর ইচ্ছার ওপর।
সূরা আ’রাফের ৫৫ ও ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ (৫৫) وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا وَادْعُوهُ خَوْفًا وَطَمَعًا إِنَّ رَحْمَةَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِنَ الْمُحْسِنِينَ ((৫৬
“তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাকো কাকুতি-মিনতি করে এবং সঙ্গোপনে। তিনি সীমা লঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।" (৫৫)
"পৃথিবীকে কুসংস্কারমুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। তাঁকে আহ্বান করো ভয় ও আশা সহকারে। নিশ্চয়ই আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।” (৫৬)
আগের আয়াতে মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরার পর এ আয়াতে তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দোয়া এবং কাকুতি-মিনতির মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকো। অন্য মানুষ বা মুর্তির কাছে কোন কিছু চাওয়ার পরিবর্তে আল্লাহর কাছে সবকিছু কামনা করো। তার দরবারে দু’হাত তুলে চাও। তবে এ চাওয়া হতে হবে অন্তরের অন্তস্থল থেকে। লোক দেখানো দোয়া বা মুনাজাত করা কিংবা উচ্চস্বরে আল্লাহকে ডাকার প্রয়োজন নেই। নীচুস্বরে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। তাঁর করুণার ব্যাপারে যেমন সব সময় আশাবাদী থাকতে হবে তেমনি তাঁর ক্রোধকেও ভয় পেতে হবে। আল্লাহর ক্রোধের বিষয়টি সব সময় মনে থাকলে আমরা আত্মম্ভরিতা ও অহংকার থেকে দূরে থাকতে পারবো। কখনো কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় পাপকাজ করে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কারণ, আল্লাহ অসীম দয়াময়।
পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর করুণা লাভের জন্য তার দরবারে মোনাজাত করার পাশাপাশি সতকাজ করতে হবে। শুধু আল্লাহর কাছে চাইলেই হবে না, সেইসঙ্গে যে কোন জিনিস পাওয়ার জন্য চেষ্টাও করতে হবে। সৎকাজ বা অন্য মানুষের উপকার করলে তার প্রতিদান আল্লাহ বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন। এ ছাড়া, আল্লাহর কাছে সেই ভিখারির মতো হাত তুলতে হবে যে বাদশার সামনে হাঁটু গেড়ে দু’হাত তুলে কোন কিছু চায়। অন্যায়কারী ও জালিমের সঙ্গ ত্যাগের পাশাপাশি নবী-রাসূলদের পথ অনুসরণ করতে হবে। নবী-রাসূলগণ সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে সমাজকে বিশুদ্ধ করার কাজে সারাটি জীবন চেষ্টা করে গেছেন। তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা মুখে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে কিন্তু কাজে আল্লাহর নির্দেশিত পথের উল্টো চলে। আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘনকারী এবং আল্লাহতা’লা সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. দোয়া হচ্ছে মহান আল্লাহর দরবারে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরার মাধ্যম। যে ব্যক্তি দোয়া করে না তার অহংকারী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
দুই. আল্লাহকে চেনাই যথেষ্ট নয় তার উপাসনা করা জরুরী। দোয়া ছাড়া আল্লাহর ইবাদত সম্পূর্ণ হয় না।
তিন. যে সমাজের সব মানুষ সংশোধিত হয়ে গেছে সে সমাজও পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যে থাকে। কাজেই সব অবস্থায় আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে হবে।
চার. আল্লাহর রহমতের আশা এবং তাকে ভয় করা একই মূদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। জীবনে সাফল্য পেতে হলে এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলতে হবে।