সূরা আ'রাফ; আয়াত ২৮-৩০
সূরা আ'রাফের ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً قَالُوا وَجَدْنَا عَلَيْهَا آَبَاءَنَا وَاللَّهُ أَمَرَنَا بِهَا قُلْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ أَتَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ
"তারা যখন কোন অশ্লীল কাজ করে তখন বলে, আমাদের বাপ-দাদাদেরকে আমরা এভাবেই করতে দেখেছি এবং আল্লাহই আমাদের এমনটি করার নির্দেশ দিয়েছেন।তাদেরকে বলে দিন, আল্লাহ কখনো নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার নির্দেশ দেন না। তোমরা কি আল্লাহর নাম নিয়ে এমন কথা বলো, যেটাকে তোমরা আল্লাহর কথা বলে জানো না?" (৭:২৮)
আগের আয়াতে আমরা বলেছি, আদম-হাওয়াকে শয়তান ধোঁকা দিয়েছিল। এ কারণে তাদের শরীর অনাবৃত হয়ে পড়েছিল। আমরা সবাই আদম-হাওয়ার বংশধর। এ কারণে আল্লাহ আমাদের সবাইকে শয়তানের ধোঁকার বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। ২৮ নম্বর আয়াতে জাহিলিয়াতের যুগের একটি কুপ্রথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সে সময় মক্কার মুশরিকরা ইব্রাহিম (আ.)'এর রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর হজ্ব পালন করতো। তারা বিশ্বাস করতো, কাবা ঘর তাওয়াফ করার সময় শরীরের পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র ও হালাল হতে হবে। এ কারণে নিজের পোশাক-পরিচ্ছদের পবিত্রতা ও বৈধতার বিষয়ে কখনো সন্দেহ হলে তারা তা খুলে ফেলতো এবং উলঙ্গ হয়ে যেতো। আর উলঙ্গ অবস্থাতেই তাওয়াফ করতো। তারা এ কাজকে এবাদত বলে মনে করতো। পবিত্র কোরানে এ কাজকে অত্যন্ত ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
মুশরিকরা এ কাজের পেছনে যুক্তি তুলে ধরতে যেয়ে বলে, আমাদের বাপ-দাদারাও এমনটি করতেন। এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের রীতি। তারা এও দাবি করে যে, তারা যা করছে আল্লাহই তাদেরকে তা করতে বলেছেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. মানব সমাজের অনেক কুসংস্কারের উৎস হলো তাদের পূর্বপুরুষরা। কোন চিন্তাভাবনা না করেই পূর্বপুরুষদের কাজের অন্ধ অনুকরণের কারণে তারা কুসংস্করাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কাজেই মনে রাখতে হবে, নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে এবং অন্ধভাবে পূর্বপুরুষদের অনুকরণ করা উচিত নয়।
দুই. আল্লাহ যেভাবে বলেছেন ঠিক সেভাবেই তার এবাদত করতে হবে। অন্যথায় এতে কুসংস্কার ঢুকে পড়ার আশংকা থাকে।
সূরা আ'রাফের ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ أَمَرَ رَبِّي بِالْقِسْطِ وَأَقِيمُوا وُجُوهَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ كَمَا بَدَأَكُمْ تَعُودُونَ
"বলে দিন-আমার প্রভু ন্যায়পরায়ণতার আদেশ দিয়েছেন;প্রত্যেক সময়ে এবং স্থানে নামাজের সময়ে [আল্লাহ্র] কাছে [এমনভাবে] আত্মনিবেদন করবে যেনো তাঁর দৃষ্টিতে তোমার এবাদত হয় আন্তরিক। প্রথমে তিনি যেভাবে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, সেভাবে তোমরা [তাঁর কাছে] ফিরে আসবে।" (৭:২৯)
মুশরিকরা খারাপ কাজ করে সেগুলোকে আল্লাহর নির্দেশ বলে দাবি করতো এবং নিজেদেরকে নিরপরাধ বলে ঘোষণা দিতো। এ আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, আল্লাহতায়ালা সব সময় ন্যায়পরায়ণতা, পবিত্রতা ও সততার নির্দেশ দেন। তিনি চান- মানুষ যাতে মসজিদে এমনকি কাবায় নামাজ পড়া ও তাওয়াফ করার সময় কেবলি আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে এবং সব ধরনের কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকে। পাশাপাশি সব ধরনের শির্ক বা অংশীবাদ থেকে নিজেকে দূরে রাখে। সব মানুষকেই আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে এবং আল্লাহ মানুষকে পুণরায় সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন। কারণ তিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. আল্লাহতায়ালা মানুষকে সব ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ এ নির্দেশের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
দুই. নিজের গোটা অস্তিত্ব দিয়ে আল্লাহর এবাদত করতে হবে। আর এমন এবাদতের মধ্যদিয়েই সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি হয়।
সূরা আ'রাফের ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَرِيقًا هَدَى وَفَرِيقًا حَقَّ عَلَيْهِمُ الضَّلَالَةُ إِنَّهُمُ اتَّخَذُوا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ مُهْتَدُونَ
"(আল্লাহ) একদলকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন। অন্য দলের জন্য [তাদের নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী] ভ্রান্তপথ নির্ধারিত হয়েছে। যেহেতু তারা আল্লাহ্কে পছন্দ না করে শয়তানকে তাদের অভিভাবক করেছিলো এবং মনে করেছিলো যে তারা সৎ পথে পরিচালিত হয়েছে।" (৭:৩০)
আগের আয়াতে আল্লাহর এবাদত করার পদ্ধতি এবং ন্যায়ভিত্তিক জীবনের বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়ার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, একদল মানুষ আল্লাহর নির্দেশ মেনে সৎ পথে ফিরে আসে এবং অপর দলটি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে শয়তানের পথ বেছে নেয় ও বিভ্রান্ত হয়। যদিও বিভ্রান্ত ব্যক্তিরাও এটাই ভাবেন যে, তারাও সৎ ও কল্যাণের পথেই এগোচ্ছেন। ভুল ধারণার ভিত্তিতে পথ চললে মানুষ বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়ে। কারণ এমন অবস্থায় মানুষ মারাত্মক ভ্রান্তি ও বিপদের মধ্যে থেকেও ভাবতে থাকে যে, সে সঠিক পথেই রয়েছে। শয়তান মানুষকে এভাবেই ধোঁকা দেয়। এটা শয়তানের কৌশল। শয়তান প্রথমে মানুষের সামনে খারাপ কাজকেও ভালো বলে তুলে ধরে। এরপর তার ভ্রান্ত পথ অনুসরণের আহ্বান জানায়। যারা শয়তানের এ ধরনের ধোঁকায় পড়ে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পবিত্র কোরানের অন্য আয়াতেও এ প্রসঙ্গে বক্তব্য রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এ ধরনের লোকেরা খারাপ কাজকেও ভালো বলে মনে করে। এ কারণে এ পৃথিবীতে তারা যে আ'মল করেছে তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং তারা খালি হাতে পরকালে ফিরে যায়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথে চলার দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু আমরা নিজেরাই ভুল পথ বেছে নেই।
দুই. আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ, শয়তানের ফাঁদে পড়ে যায় এবং শয়তানকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে।
তিন. ভ্রান্ত পথে চলেও পুরস্কৃত হওয়ার আশা করা বোকামি।