সূরা আ'রাফ; আয়াত ৬-১০
সূরা আ'রাফের ৬ ও ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ (6) فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِمْ بِعِلْمٍ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ (7(
'কাজেই যাদের কাছে আমি রাসূল পাঠিয়েছি তাদেরকে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করবোএবং রাসূলদেরকেও জিজ্ঞেস করবো। ' (৭:৬)
'অতঃপর আমি স্বজ্ঞানে তাদের কাছে অবস্থা বর্ণনা করবো। আমি তো আর সেখানে অনুপস্থিত ছিলাম না।' (৭:৭)
ইহকালেও জালিমদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসতে পারে বলে ঘোষণা দেয়ার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, মানুষের চূড়ান্ত বিচার হবে পুণরুত্থান দিবসে। সেদিন নবী-রাসূলসহ সব মানুষকে তার কাজের বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। যদিও আল্লাহ সব কিছুই জানেন এবং সবার কাজের হিসেব তার কাছে রয়েছে। কিন্তু তারপরও সেদিন আল্লাহতায়ালা মানুষের ভালো ও মন্দ কাজের প্রমাণ তুলে ধরে শাস্তি ও পুরস্কার নির্ধারণ করতে আদালত বসাবেন। বিভিন্ন হাদিসে এসেছে, আল্লাহ মানুষকে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক যেসব নেয়ামত দিয়েছেন, পুণরুত্থান দিবসে তার সব কিছু সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। মানুষকে তার অধীন অর্থ-সম্পদ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও আয়ুসহ সব কিছুর বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ মানুষকে যতটুকু নেয়ামত দিয়েছেন ঠিক ততটুকু সম্পর্কেই প্রশ্ন করবেন এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন। বিচারের সময় মানুষের শক্তি ও সামর্থ্যের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. বিচার দিবসে সবাই প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। নবী-রাসূলসহ সমাজের নেতাদের প্রশ্ন করা হবে, তারা মানুষকে সৎ পথে পরিচালনার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন কিনা। আর সাধারণ মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হবে, নবী-রাসূলদের দিকনির্দেশনা তারা সঠিকভাবে পালন করেছেন কিনা।
দুই. কিয়ামতের দিন মানুষের সামনে এমন সব প্রমাণ তুলে ধরা হবে যে, কেউই তা অস্বীকার করতে পারবে না।
সূরা আ'রাফের ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
'আর সেদিন সঠিকভাবেই পরিমাপ করা হবে। যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম হবে।' (৭:৮)
কিয়ামতের দিন যে আদালত বসবে তার বিচারক হবেন স্বয়ং আল্লাহ। আল্লাহতায়ালা ন্যায়ের ভিত্তিতে বিচার করবেন এবং তিনি বিনা কারণে হিসেব-নিকেশ ছাড়াই কাউকে শাস্তি বা পুরস্কার দেবেন না। কেউ কেউ বলে থাকেন, যেহেতু আল্লাহ-ই সর্বময় ক্ষমতার মালিক, সেহেতু তিনি যেভাবে খুশি সেভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এমনকি তা যদি অন্যায় সিদ্ধান্তও হয়ে থাকে। কিন্তু মহান আল্লাহ নিজেই এ আয়াতে বলেছেন, তিনি ন্যায় ও সততা এবং মানুষের কৃতকর্মের ভিত্তিতে বিচার করে থাকেন। বিচার দিবসে মানুষের কাজের মূল্যায়নের জন্য নবী-রাসূলদের মতো পরিপূর্ণ মানুষদের আ'মলকে সর্বোত্তম মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. আল্লাহ ন্যায়পরায়ন এবং বিচার দিবসেও ন্যায়ের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
দুই. সৎ কাজ না করে বিচার দিবসে ছাড় পাওয়ার আশা করা বোকামী।
সূরা আ'রাফের ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ بِمَا كَانُوا بِآَيَاتِنَا يَظْلِمُونَ
"যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি সাধন করেছে। কারণ তারা আমার আয়াতের সাথে জালেমসুলভ আচরণ করতো।" (৭:৯)
এ আয়াত এবং আগের আয়াতে মানুষের কাজের পরিমাণ ও এসব কাজের ভালো-মন্দ দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ তার জীবদ্দশায় খারাপ কাজ করার মাধ্যমে তার আত্মার ক্ষতিসাধন করে থাকে। মানুষের জন্য আত্মিক ক্ষতির চেয়ে বড় আর কোন ক্ষতি নেই। মানুষের আয়ু ঠিক বরফ খণ্ডের মতো। বরফ খণ্ডকে কাজে লাগানো হোক আর না হোক, তা গলে শেষ হয়ে যাবে। যারা কাজে লাগাবে, তারা সফলকাম হবে এবং যারা কাজে লাগাবে না, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. পৃথিবীতে ভালো কাজের পরিমাণ যার যতো কম হবে,পরকালে সে তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দুই. পৃথিবী হচ্ছে এমন এক ব্যবসা ক্ষেত্রের মতো, যেখানকার পুঁজি হচ্ছে আয়ু এবং ব্যবসার লাভ হচ্ছে সৎ কাজ। ভালো কাজ করার ক্ষেত্রে গাফিলতিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ক্ষতি।
সূরা আ 'রাফের ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِي الْأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ
"তোমাদেরকে আমি ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তোমাদের জন্য এখানে জীবন ধারণের উপকরণ সরবরাহ করেছি। কিন্তু তোমরা খুব কমই শোকর গুজারি করে থাকো।" (৭:১০)
বিচার দিবসে মানুষের কৃতকর্মের শাস্তি ও পুরস্কারের কথা উল্লেখ করার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে মানুষকে নানা সুযোগ-সুবিধা ও সামর্থ্য দেয়া হয়েছে। কাজেই মানুষকে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। পৃথিবীর সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে সুখী, সমৃদ্ধ ও পবিত্র জীবন গড়ে তুলতে হবে। এতো নেয়ামত দেয়ার পরও খুব কম সংখ্যক মানুষ আল্লাহর শোকরিয়া করেন। তবে আল্লাহর শোকরিয়া বা প্রশংসা শুধু মুখে করলেই চলবে না। কাজের মাধ্যমেও তার প্রমাণ দিতে হবে। আল্লাহর নেয়ামতগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। যেমন আল্লাহর অগণিত নেয়ামতের একটি হলো-আঙ্গুর। ফলটি মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারি। এটা সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সমতুল্য। কিন্তু কেউ যদি এই আঙ্গুর ব্যবহার করে মদ তৈরি করে,তাহলে তা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা হিসেবে গণ্য হবে।
এ ছাড়া, মানুষের দৈহিক শক্তি ও জ্ঞান-বুদ্ধি তা নিজের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি অন্যের উপকার করার জন্য আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন। কিন্তু কেউ যদি তা অন্যের ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করে, তাহলে তা অবশ্যই আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. আল্লাহ মানুষকে অফুরন্ত নেয়ামত দিয়েছেন এবং এসব নেয়ামতের ওপর প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার রয়েছে।
দুই. আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ব্যবহার করে মানুষ যদি সেই আল্লাহকেই ভুলে যায়, তাহলে তা হবে বড় বেঈমানি। পৃথিবীর সুখ-শান্তি ও আরাম-আয়েশের কারণে অনেকে আল্লাহকে ভুলে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আল্লাহ না চাইলে কেউ সুখি হতে পারবে না।