সূরা আন'আম;(৩৮তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(৩৮তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 2:4:52 3-10-1403

 

সূরা আন'আম; আয়াত ১৬২-১৬৫

সূরা আন'আমের ১৬২ ও ১৬৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (১৬২) لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ ((১৬৩

 “(হে নবী!) আপনি (মুশরিকদের) বলুনঃ আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে।” (৬:১৬২)

“তাঁর কোন অংশীদার নেই এবং আমি এতেই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল মুসলমান।” (৬:১৬৩)

গত পর্বের আলোচনায় আমরা এটা উল্লেখ করেছি, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজেকে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র প্রচারিত ধর্মের অনুসারী বলে মনে করতেন। তিনি সরল পথে চলার ওপর জোর দিতেন। এই আয়াতে আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও আন্তরিক চিত্তে আত্মসমর্পণ করাকে সরল পথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এ আয়াতে মহানবী (সা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন মানুষের কাছে এ কথা ঘোষণা করতে যে, আমার জীবন, মৃত্যু, নামাজ ও সব ইবাদত আল্লাহর জন্যই নিবেদিত। আল্লাহ ছাড়া আমার অন্য কোনো লক্ষ্য নেই এবং তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেই না আমি। তোমরা মুশিরকরা আল্লাহর সঙ্গে যাদের শরিক কর আমি তা ঘৃণা করি এবং আমি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে অগ্রগামী। অর্থাৎ আমি যেদিকে মানুষকে ডাকছি অন্য সবার আগে আমি নিজেই সে পথে অগ্রসর হয়েছি তথা মহান আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করছি এবং অন্যদেরকেও এ পথে দাওয়াত দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি।

কেবল ইসলামের নবী (সা.)-ই নন যুগে যুগে সব নবী-রাসূলই আল্লাহর নির্দেশের নিঃশর্ত ও চরম আনুগত্য করেছেন। তাঁরা জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর চরম অনুগত দাস হওয়ার এবং এমনকি মৃত্যুর সময়ও আত্মসমর্পিত থাকার প্রার্থনা করেছেন।

এ আয়াতের শিক্ষা হল:

এক. প্রকৃত মুমিন শুধু নামাজ ও ইবাদতের সময়ই আল্লাহর বান্দা নন, বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে ও সব মুহূর্তে আল্লাহর নিবেদিত-প্রাণ দাস।

দুই. আমরা বেঁচে থাকলাম বা মরে গেলাম কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, বরং এ দুই আল্লাহর পথে ব্যবহৃত হল কিনা তাই জরুরি বিষয়।

সূরা আন’আমের ১৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 قُلْ أَغَيْرَ اللَّهِ أَبْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ وَلَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ إِلَّا عَلَيْهَا وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى ثُمَّ إِلَى رَبِّكُمْ مَرْجِعُكُمْ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ

 “(হে নবী!) আপনি (মুশরিকদের) বলুনঃ আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য প্রতিপালক খুঁজব, অথচ তিনিই সবকিছুর প্রতিপালক? যে ব্যক্তি কোন গোনাহ করে, তা তারই দায়িত্বে থাকে (অর্থাৎ সে নিজেরই ক্ষতি করে)। কেউ অপরের (গোনাহর) বোঝা বহন করবে না। অতঃপর তোমাদেরকে সবাইকে প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে বলে দিবেন, যেসব বিষয়ে তোমরা বিরোধ করতে।” (৬:১৬৪)

এ আয়াতে মহান আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে সবিস্ময়ে মুশরিকদের এসব প্রশ্ন করতে বলেছেন যে, কেন আমি এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বা মূর্তিগুলোকে প্রভু বা উপাস্য মনে করবে? অথচ আল্লাহই সব কিছুর প্রতিপালক। তোমাদের মূর্তিগুলো তো কোনো কাজই করতে সক্ষম নয়। তোমরা কেন আমাকে এই প্রাণহীন মূর্তিগুলোর দিকে আহ্বান করে বলছ যে, আমাদের অনুসরণ কর ও আমরা তোমাকে সমর্থন করব এবং যদিও আমাদের পথ ভুল পথ- আমরা তোমার গোনাহর বোঝা বহন করব! ? অথচ তোমরা কি জান না, কেউই অন্য কারো পাপের বোঝা বইবে না এবং যে কেউ পাপ ও পূণ্য যা করে তার প্রতিফল কেবল সে-ই ভোগ করবে। একজনের গোনাহর জন্য অন্য কাউকে দায়ী করা হবে না।

এ আয়াতের শিক্ষা হল:

এক. মানুষের ঈমান ও কুফুরিতে আল্লাহর কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই। বরং মানুষই তার ভাল ও মন্দ কাজের প্রতিফল ভোগ করবে।

দুই. আমরা সবাই নিজ কাজের জন্য দায়িত্বশীল। নিজের খারাপ বা অসৎ কাজের জন্য আমরা যেন পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও সমাজকে দায়ী না করি।

সূরা আন’আমের ১৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آَتَاكُمْ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ

“তিনিই (আল্লাহ) তোমাদেরকে পৃথিবীতে (অতীতের জাতিগুলোর) প্রতিনিধি বা উত্তরসূরি করেছেন এবং তোমাদের একদলকে অন্যদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন, যাতে তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে পরীক্ষা করা যায়। (যারা পরীক্ষায় সফল হবে না) আপনার প্রতিপালক (তাদের জন্য) দ্রুত শাস্তি দাতা এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (৬:১৬৫)

এই আয়াত সূরা আন’আমের সর্বশেষ আয়াত। এখানে পৃথিবীর বুকে মানুষের জীবন ও তাদেরকে দেয়া আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন, তোমাদের এখানে যা যা দিয়েছি তার সবই পরীক্ষার মাধ্যম। তোমাদের আগেও পৃথিবীতে বহু জাতি এসেছে ও বিদায় হয়েছে। তোমরা আজ তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছ। একদিন তোমরাও তাদের মতই বিদায় নেবে। অন্য মানুষেরা হবে তোমাদের উত্তরসূরি। তাই তোমাদের এখন যেসব সুযোগ দেয়া হয়েছে সেগুলো সবচেয়ে ভালভাবে ব্যবহার কর। খোদায়ী নেয়ামত, মর্যাদা বা সম্পদগুলো সবাইকে সমান মাত্রায় দেয়া হয়নি। আর এই যে পার্থক্য-এটাও পরীক্ষা করারই মাধ্যম।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিয়য়গুলো হল

এক. আল্লাহ পৃথিবীতে কাউকে কম ও কাউকে বেশি সম্পদ দিয়েছেন। এটা মানুষের জন্য হীনতা বা মর্যাদার বা একে-অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যম নয়, বরং এসবই পরীক্ষার মাধ্যম।

দুই. এ ধরনের পরীক্ষায় ফেল করা মানুষকে দ্রুত শাস্তি দেবেন আল্লাহ। আর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বান্দাদের প্রতি আল্লাহ করুণাময় ও ক্ষমাশীল।

তিন. আমাদের যা কিছু আছে তা আল্লাহরই সম্পদ। একথা মনে রাখলে আল্লাহর পথে তাঁরই দেয়া সম্পদ দান করা সহজ হবে।