সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৬০-১৬২
সূরা আ'রাফের ১৬০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَقَطَّعْنَاهُمُ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ أَسْبَاطًا أُمَمًا وَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى إِذِ اسْتَسْقَاهُ قَوْمُهُ أَنِ اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْحَجَرَ فَانْبَجَسَتْ مِنْهُ اثْنَتَا عَشْرَةَ عَيْنًا قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَشْرَبَهُمْ وَظَلَّلْنَا عَلَيْهِمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْهِمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
“আমি মূসার জাতিকে ১২টি গোত্রে বিভক্ত করেছিলাম, যখন মূসার সম্প্রদায় তার কাছে পানি চেয়েছিল, তখন আমি তাঁর কাছে এ ওহী বা প্রত্যাদেশ নাজেল করেছিলাম যে, তুমি নিজ লাঠি দিয়ে পাথরে আঘাত কর, এর ফলে ওই পাথর থেকে ১২টি ঝর্ণা বের হলো এবং প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ পানি পানের স্থান চিনে নিল। আমি তাদের ওপর মেঘের ছায়া দিয়েছিলাম এবং তাদের কাছে মান্না ও সালওয়া নামের দু’ রকম খাবার পাঠিয়েছিলাম। তাদের বলেছিলাম, এ পবিত্র খাদ্যগুলো তোমাদের রিজিক, তোমরা তা খাও। কিন্তু ওরা তাদের অকৃতজ্ঞতার মাধ্যমে আমাদের ওপর নয়, বরং নিজেদের ওপরই জুলুম করেছিল।” (৭:১৬০)
হিব্রু ভাষায় ইসরাইল শব্দের অর্থ আল্লাহর দাস এবং এ শব্দ দিয়ে হযরত ইয়াকুব (আ.)কে বোঝানো হত । তাই বনী ইসরাইল শব্দের অর্থ হলো হযরত ইয়াকুবের বংশধর। ইয়াকুব (আ.)’র ১২ সন্তান ছিল। এ ১২ জন সন্তান থেকে বনী ইসরাইলের ১২ টি গোত্র সৃষ্টি হয়। মহান আল্লাহ এ আয়াতে বলছেনঃ হযরত মূসা (আ.)’র সেই বিখ্যাত হাতের লাঠি যা দিয়ে নীল নদে আঘাতের ফলে বনী ইসরাইল এ নদ অতিক্রম করতে পেরেছিল, ওই লাঠি দিয়ে হযরত মূসা (আ.) পাহাড়ের পাথরে আঘাত করলে সেখান থেকে ১২টি ঝর্ণা সৃষ্টি হয়। বনী ইসরাইল একটি মরুভূমিতে ৪০ বছর ধরে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিল, সে সময় বহুবার মেঘমালা তাদের মাথার ওপর ছাউনির মতো বিস্তৃত হয়ে তাদেরকে প্রখর তাপ থেকে রক্ষা করেছে এবং হালাল গোশতের পাখীরা ঐ মরুভূমিতে নেমে এসে তাদের খাদ্যের চাহিদা যুগিয়েছে । কিন্তু দুঃখজনকভাবে এতোসব নেয়ামত ও অলৌকিক নিদর্শন সত্বেও বনী ইসরাইলের বিপুল সংখ্যক লোক অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল এবং তারা হযরত মূসা (আ.)’র আদেশ অমান্য করতো। এ আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে- মানুষ যেন এটা না ভাবে যে আল্লাহর বিধান অমান্য করে আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পেরেছে, বরং বাস্তবে তারা নিজের ওপরই জুলুম করেছে এবং নিজেরাই নিজের ক্ষতি করেছে।
এ আয়াত থেকে আমাদের মন রাখা দরকার:
এক. মানুষের লক্ষ্যের মধ্যে যদি একতা থাকে, তাহলে তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হলেও ক্ষতি হয় না । বরং কাজ ভাগ করে দেয়ার জন্যে এবং সামাজিক বিষয়গুলোকে সহজ করার জন্যে অনেক সময় গোত্রীয় বা দলগত বিভক্তি জরুরী।
দুই. বিভিন্ন সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে নবীগণের ওসিলা ধরা তৌহিদ বা একত্ববাদের বিরোধী নয়, বরং এভাবে দোয়া চাইলে সহজে দোয়া কবুল হয়।
তিন. মহান আল্লাহ হালাল ও ভালো খাবার পাওয়া মানুষের জন্যে সহজ করে দিয়েছেন এবং মানুষকে হারামের পেছনে ছুটতে নিষেধ করেছেন । যখন হালাল জিনিষ পাওয়া হারাম জিনিষ পাওয়ার চেয়ে সহজ তখন হারামের পেছনে ছোটার তথা আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কি কোনো দরকার আছে?
সূরা আ'রাফের ১৬১ ও ১৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ قِيلَ لَهُمُ اسْكُنُوا هَذِهِ الْقَرْيَةَ وَكُلُوا مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ وَقُولُوا حِطَّةٌ وَادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا نَغْفِرْ لَكُمْ خَطِيئَاتِكُمْ سَنَزِيدُ الْمُحْسِنِينَ (১৬১) فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ قَوْلًا غَيْرَ الَّذِي قِيلَ لَهُمْ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِجْزًا مِنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوا يَظْلِمُونَ (১৬২)
“যখন বনী ইসরাইলকে বলা হলো, এ শহরে তথা বায়তুল মোকাদ্দস শহরে অবস্থান কর এবং এ স্থান হতে যা ইচ্ছে খাও। তবে এ শহরে প্রবেশের সময় বলঃ ক্ষমা চাই এবং সেজদাসহ নত শিরে প্রবেশ কর, ফলে আমি তোমাদের অপরাধগুলো মার্জনা করবো ও শিগগিরই সৎকর্মশীলদের জন্যে আমার দান বৃদ্ধি করবো।” (৭:১৬১)
“কিন্তু তাদের মধ্যে যারা অত্যাচারী ছিল, তারা, যা বলতে বলা হয়েছিল, তার পরিবর্তে অন্য কথা বলল। সুতরাং আমি আকাশ হতে তাদের জন্যে আজাব পাঠালাম, যেহেতু তারা সীমা লংঘন করেছিল।” (৭:১৬২)
দীর্ঘকাল ধরে মরুভূমিতে কষ্টকর জীবন যাপনের পর বনী ইসরাইলকে বায়তুল মোকাদ্দস শহরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। তবে তারা হযরত মূসা (আ.)কে বিরক্ত করেছিল ও তাঁর আদেশ অমান্য করেছিল বলে সেইসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাদেরকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার ও মাটিতে কপাল ঠেকানোর নির্দেশ দেয়া হয়। তাদেরকে আল্লাহর কাছে মাথা নত করার নির্দেশ দিয়ে বলা হয় যে, এর ফলে তাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করা হবে এবং যারা পাপ করেনি তাদের সওয়াব বা পুরস্কার বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বনী ইসরাইলের গোঁড়া লোকগুলো আল্লাহর এ নির্দেশকে উপহাস করে এবং তারা ক্ষমা চাই শব্দটি না বলে শব্দটিকে এমনভাবে বিকৃত করে বললো যে তার অর্থ হয় গম। এভাবে তারা তওবার পরিবর্তে উপহাস করলো । ফলে তাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে । কারণ, তারা আল্লাহর নির্দেশকে উপহাস করে নিজেরাই নিজের ওপর ও আল্লাহর ধর্মের ওপর জুলুম করেছিল ।
এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ
এক. তওবা করা ও ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মানুষের জন্যে আল্লাহর বস্তুগত নেয়ামত লাভের পথও প্রশস্ত হয় ।
দুই. মহান আল্লাহ মানুষের জন্যে বস্তুগত সমস্ত চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু মানুষের পাপই তাদেরকে আল্লাহর নেয়ামতগুলো থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের ওপর নেমে আসে আল্লাহর শাস্তি । অবশ্য ক্ষমা চাইলে ও তওবা করলে পুনরায় সেসব নেয়ামত তাদের কাছে ফিরে আসে।
তিন. মসজিদের মতো পবিত্র স্থানগুলোতে প্রবেশের সময় নির্দিষ্ট কিছু আদব কায়দা মেনে চলতে হয় ।
চার. হযরত মূসা (আ.)’র জীবদ্দশাতেই মহান আল্লাহর কোনো কোনো আয়াত বিকৃত ও পরিবর্তিত করা হয় এবং তার মৃত্যুর পর বিকৃতির এ ধারা জোরদার হয়েছে।
পাঁচ.সব শাস্তিগুলোই পরকালে ঘটবে এমন নয় । কোনো কোনো পাপের জন্যে পৃথিবীতেই খোদায়ী শাস্তি নেমে আসে।