সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৫০-১৫৩
সূরা আ'রাফের ১৫০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَمَّا رَجَعَ مُوسَى إِلَى قَوْمِهِ غَضْبَانَ أَسِفًا قَالَ بِئْسَمَا خَلَفْتُمُونِي مِنْ بَعْدِي أَعَجِلْتُمْ أَمْرَ رَبِّكُمْ وَأَلْقَى الْأَلْوَاحَ وَأَخَذَ بِرَأْسِ أَخِيهِ يَجُرُّهُ إِلَيْهِ قَالَ ابْنَ أُمَّ إِنَّ الْقَوْمَ اسْتَضْعَفُونِي وَكَادُوا يَقْتُلُونَنِي فَلَا تُشْمِتْ بِيَ الْأَعْدَاءَ وَلَا تَجْعَلْنِي مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
"যখন মুসা ক্রুদ্ধ ও দুঃখিত হয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে এলো, তখন সে বলেছিলো, আমার অনুপস্থিতিতে আমার কি নিকৃষ্ট প্রতিনিধিত্বটাই না তোমরা করেছ। তোমাদের পরওয়ারদেগারের আদেশ [পাওয়ার] আগেই তোমরা তাড়াহুড়ো করলে? সে (মুসা) ফলকগুলি নামিয়ে রাখলো এবং নিজের ভাইয়ের মাথার চুল চেপে ধরে নিজের দিকে টানতে লাগলো। ভাই (হারুন) বললেন, হে আমার সহোদর, লোকগুলো যে আমাকে দুর্বল মনে করল এবং আমাকে যে মেরে ফেলারই উপক্রম করেছিল। সুতরাং এমন কিছু করো না, যাতে শত্রুরা আনন্দ পায়। আর আমাকে জালিমদের সারিতে গণ্য কর না।" (৭:১৫০)
আগের পর্বে আমরা বলেছি, মূসা (আ.)আল্লাহর নির্দেশে ঐশী গ্রন্থ গ্রহণের জন্য তুর পর্বতে গিয়েছিলেন। প্রথমে কথা ছিল সেখানে তিনি ৩০ দিন অবস্থান করবেন, কিন্তু পরে সেখানে অবস্থানের মেয়াদ আরো ১০ দিন বাড়ানো হয়। আল্লাহর নির্দেশে মূসা (আ.)কে আরো বেশি দিন তুর পর্বতে অবস্থান করতে হবে,ইসরাইলি সম্প্রদায় তা জানতো না। এর ফলে এ গুজব রটিয়ে পড়ে যে, মূসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন। মূসা (আ.)এর ইন্তিকালের গুজব রটিয়ে পড়ার পর ইসরাইলি সম্প্রদায় সামেরির বাছুরের মূর্তির পূঁজা শুরু করেছিল। সামেরি নামে বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি বাছুরের মূর্তি তৈরি করে মানুষকে ওই মূর্তি পূজার দিকে আহ্বান জানিয়েছিল। ওই বাছুরটিই সামেরির বাছুর নামে পরিচিত।
এ আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত মূসা (আ.) তুর পর্বত থেকে ফেরার পর তার সম্প্রদায়ের লোকজনদের পাশাপাশি নিজের ভাই হারুনের সঙ্গেও ক্রুদ্ধ আচরণ করেন। তিনি বনি ইসরাইলের লোকজনের উদ্দেশে বলেন, আমার অনুপস্থিতিতে তোমরা ভালো ভূমিকায় ছিলে না। তোমরা বিভ্রান্তির পথে ফিরে গিয়েছিলে। তোমরা আমার ভাই হারুনের কাছে না গিয়ে সামেরির শরণাপন্ন হয়েছিলে। হযরত মূসা (আ.) তার ভাই হারুনের প্রতিও ক্ষুব্ধ হন এবং তার চুল ধরে টেনে এনে তাকে ভর্ৎসনা করেন। মূসা (আ.) তার ভাইয়ের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, হারুন (আ.) সঠিকভাবে ওই সম্প্রদায়ের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এরপর হারুন (আ.) তার ভাই মূসা (আ.) কে তার অনুপস্থিতি কালীন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে যেয়ে বলেন, তারা আমাকে ত্যাগ করেছিল এবং আমার কোন কথাই তারা শুনেনি। এমনকি তারা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কাজেই আমি কোন অপরাধ করিনি। আমাকে বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের লোকদের সারিতে গণ্য করা উচিত নয়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. সমাজের বিচ্যুতি ও পথভ্রষ্টতা সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। সমাজে যারা সত্য ধর্মের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে ও ভুল ব্যাখ্যা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমনিভাবে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনি (রহ.) মুর্তাদ লেখক সালমান রুশদির 'শয়তানের পংক্তিমালা' বইয়ের বিরুদ্ধে এ ধরনের কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।
দুই. বিভ্রান্তি ঠেকাতে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে পদমর্যাদা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বিবেচ্য নয়। এ ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং সমাজের দায়িত্বশীলদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করতে হবে।
তিন. বিপ্লবী ও সংস্কারমূলক যে কোনো তৎপরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার অর্থ হলো, পিছনে ফিরে যাওয়া। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে এ ধরনের তৎপরতা ঠেকানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূরা আ'রাফের ১৫১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِأَخِي وَأَدْخِلْنَا فِي رَحْمَتِكَ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
"মূসা বললেন, হে আমার পরওয়ারদেগার, ক্ষমা কর আমাকে আর আমার ভাইকে এবং আমাদেরকে তোমার রহমতের অন্তর্ভুক্ত কর। তুমি যে সর্বাধিক করুণাময়।" (৭:১৫১)
যখন হযরত মূসা (আ.) এর ক্ষোভ প্রশমিত হলো তখন তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন। তার ভাই হারুন (আ.) যদি নিজের কাজে কোন ধরনের অবহেলা করে থাকেন, তাহলেও যাতে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন, সেই দোয়া করলেন হযরত মূসা (আ.)। কারণ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করলে রহমতের দরজা প্রশস্ত হয়। আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্তি সহজতর হয়।
সূরা আরাফের ১৫২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ اتَّخَذُوا الْعِجْلَ سَيَنَالُهُمْ غَضَبٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَذِلَّةٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُفْتَرِينَ
"অবশ্য যারা বাছুরকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে, তাদের উপর তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে পার্থিব এ জীবনেই গজব ও লাঞ্ছনা এসে পড়বে। এভাবে আমি অপবাদ আরোপকারীদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।" (৭:১৫২)
হযরত মূসা (আ.) তুর পর্বত থেকে ফিরে আসার পর বাছুর পূঁজা শুরু করার কারণে তার সম্প্রদায়ের লোকদের ভর্ৎসনা করেছিলেন। আল্লাহর নবীর পক্ষ থেকে তিরষ্কৃত হওয়া এবং সত্য প্রকাশ হওয়ার পরও এক দল লোক বাছুর পূঁজা থেকে বিরত থাকলো না। তারা ঘৃণ্য ওই কাজ অব্যাহত রাখলো।এ ধরনের লোকদের জন্য নির্ধারিত শাস্তি প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা এ আয়াতে বলেছেন,তাদের উপর তাদের পার্থিব এ জীবনেই গজব ও লাঞ্ছনা নেমে আসবে। কারণ তারা সত্যকে প্রত্যক্ষ করার পরও তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. নবী-রাসূলদের ক্ষুব্ধ করলে মানুষের উপর আল্লাহর গযব নেমে আসতে পারে।
দুই. সৎপন্থীদের প্রত্যাখ্যান করে অসৎ নেতৃত্ব মেনে নিলে আল্লাহ ক্ষুব্ধ হন এবং সমাজের লোকদের লাঞ্ছিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সূরা আ'রাফের ১৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَالَّذِينَ عَمِلُوا السَّيِّئَاتِ ثُمَّ تَابُوا مِنْ بَعْدِهَا وَآَمَنُوا إِنَّ رَبَّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
"আর যারা পাপ কাজ করে, তারপরে তওবা করে নেয় এবং (প্রকৃতপক্ষে) ঈমান আনে, নিশ্চয়ই তোমার প্রভু তওবার পর অবশ্য ক্ষমাকারী, করুণাময়।" (৭:১৫৩)
এ আয়াতে ওই সব ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে নাজিল করা হয়েছে, যারা প্রথমে বাছুর পূজারিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু হযরত মূসা (আ.) ক্ষুব্ধ হওয়ার পর সচেতন হয়ে ওঠেছিল এবং ওই কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিল। এ আয়াতে ওই লোকদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, কেউ যদি তওবা করে ও শিরক করা থেকে বিরত থাকে এবং পুণরায় আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, তাহলে আল্লাহ তাদের তওবা গ্রহণ করেন ও পুণরায় অনুগ্রহ করেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক-আল্লাহ মানুষের জন্য সব সময় তওবার সুযোগ খোঁলা রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে সময় সংক্রান্ত সীমাবন্ধতা নেই।
দুই-আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহের ব্যাপারে হতাশ হওয়া যাবে না। কারণ আল্লাহ বড় বড় পাপও মাফ করে দিতে পারেন।