সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৩৬-১৪০
সূরা আল আ'রাফের ১৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
فَانْتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَأَغْرَقْنَاهُمْ فِي الْيَمِّ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَكَانُوا عَنْهَا غَافِلِينَ
“সুতরাং আমি তাদের কাছ থেকে (তথা ফেরাউনের সম্প্রদায়ের কাছ থেকে) বদলা নিলাম এবং তাদেরকে দরিয়ায় ডুবিয়ে দিলাম। কারণ, তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল আমার নিদর্শনগুলোকে এবং তারা এসব ব্যাপারে গাফেল বা উদাসীন ছিল।” (৭:১৩৬)
হযরত মুসা (আ.)’র পক্ষ থেকে অনেক মোজেজা বা খোদায়ী নিদর্শন দেখার পরও ফেরাউন ও তার অনুসারীরা এই মহান নবীর দাওয়াত মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। তারা সব সময়ই হযরত মুসা (আ.)-কে নানা অপবাদ ও হুমকি দিত।
এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, অবশেষে চরম অবাধ্যতা ও গোঁড়ামির শাস্তি হিসেবে আমি এই দুনিয়াতেই ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে শাস্তি দিয়েছিলাম। তারা যখন নিল দরিয়া অতিক্রম করছিল তখন আমি তাদের সবাইকে ডুবিয়ে দেই। কিন্তু হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য দরিয়ার মধ্যেই পথ খুলে দেই যাতে তারা সহজেই তা অতিক্রম করতে পারে।
আল্লাহ কাফিরদের যেসব শাস্তি দিয়ে থাকেন তা তাদেরই হাতের অর্জন মাত্র। মানুষ সাধারণত যেরকম প্রতিশোধকামী হয়, আল্লাহ’র বদলা বা প্রতিশোধ সে ধরনের নয়। তাই আল্লাহ এখানে বলছেন, এটা হচ্ছে আমার নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করার ও সেগুলোর প্রতি গাফেল থাকার শাস্তি। তারা সত্যকে বোঝার পরও তা মেনে নিতে চায়নি।
এই আয়াতের দু’টি শিক্ষা হল:
এক. মহান আল্লাহ খুবই দয়ালু। আবার প্রতিশোধও নিয়ে থাকেন কঠোরভাবে। তাই মহান আল্লাহর দয়ার কথা ভেবে আমরা যেন তাঁর ক্রোধের ব্যাপারে উদাসীন না থাকি।
দুই. ব্যক্তি ও জাতির পরিণতি নির্ভর করে ওই ব্যক্তি বা জাতির কাজের ওপর। কুফুরি ও জুলুমের পরিণতি হল ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
সূরা আল আরাফের ১৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَأَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِينَ كَانُوا يُسْتَضْعَفُونَ مَشَارِقَ الْأَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ الْحُسْنَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ بِمَا صَبَرُوا وَدَمَّرْنَا مَا كَانَ يَصْنَعُ فِرْعَوْنُ وَقَوْمُهُ وَمَا كَانُوا يَعْرِشُونَ
“আর যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তাদেরকে আমরা (ফিলিস্তিন) ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের উত্তরাধিকারী করেছি যেখানে আমরা প্রাচুর্য রেখেছিলাম এবং এভাবে বনী-ইসরাইলের জন্য পরিপূর্ণ হয়ে গেছে তোমার পালনকর্তার উত্তম কথা (বা বিজয়ের প্রতিশ্রুতি) তাদের দৃঢ়তা বা ধৈর্য্য ধারণের দরুণ। আর ধ্বংস করে দিয়েছি সে সবকিছু যা তৈরী করেছিল ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় এবং ধ্বংস করেছি সেইসব উঁচু প্রাসাদ যা তারা নির্মাণ করেছিল।” (৭:১৩৭)
ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়কে শাস্তি দেয়ার বিবরণ তুলে ধরার পর মহান আল্লাহ এ আয়াতে বলছেন, বনি ইসরাইল ধৈর্য্য ধারণ করায় ও সত্যের পথে অবিচল থেকে হযরত মুসা (আ.)’র অনুসরণ করায় আমরা তাদের পুরস্কৃত করেছি। শস্য-শ্যামল ও সমৃদ্ধ ফিলিস্তিন ও সিরিয়া অঞ্চলের শাসন কর্তৃত্ব তাদের দিয়েছিলাম। এর আগে তারা ফেরাউনি শাসনে সব সময়ই হীনবল বা অপমানিত ও দূর্বল হয়েছিল। কিন্তু নিল নদ পার হওয়ার পর তারা ফিলিস্তিন অঞ্চলে শক্তিশালী ও শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়।
আয়াতটির পরবর্তী অংশে মহান আল্লাহ এটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, আমি যে শুধু ফেরাউন ও তার সেনাদলকেই ডুবিয়ে দিয়েছিলাম তা নয়, একইসঙ্গে তাদের মনোরম প্রাসাদ ও সুরম্য উদ্যানগুলোকেও ধ্বংস করেছি। ফেরাউনদের সাম্রাজ্য এত বিশাল ছিল যে আল্লাহ বলছেন, এই ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিমাংশ আমি দান করেছিলাম বনি ইসরাইলকে।
এ আয়াতের দু'টি শিক্ষণীয় দিক হল:
এক. নবীরা যে শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন তা ছিল বঞ্চিত বা দূর্বলদের শাসন-ব্যবস্থা। দাম্ভিক ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের শাসন নয়। নবী-রাসূলদের শিক্ষার ছায়াতলে দুর্বল ও বঞ্চিতরা বলদর্পীদের কর্তৃত্ব থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং তারাই ক্ষমতা ও শাসন-কর্তৃত্বের অধিকারী হন।
দুই. মহান আল্লাহর অকাট্য ও অবশ্যম্ভাবি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুমিনরা যদি ধৈর্যশীল ও প্রতিরোধকামী হয় তাহলে তারা বিজয়ী হবে।
সূরা আল আ'রাফের ১৩৮ থেকে ১৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتَوْا عَلَى قَوْمٍ يَعْكُفُونَ عَلَى أَصْنَامٍ لَهُمْ قَالُوا يَا مُوسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آَلِهَةٌ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ (138) إِنَّ هَؤُلَاءِ مُتَبَّرٌ مَا هُمْ فِيهِ وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (139) قَالَ أَغَيْرَ اللَّهِ أَبْغِيكُمْ إِلَهًا وَهُوَ فَضَّلَكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ (140)
“এবং আমরা আমরা দরিয়া পার করে দিয়েছি বনী-ইসরাইলকে। এরপর তারা (পথে) এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছাল, যারা উপাসনার উদ্দেশ্যে মূর্তিদের সামনে অবস্থান করছিল। তারা বলতে লাগল, হে মূসা! তাদের যেমন উপাস্য রয়েছে তেমনি আমাদের জন্যও (ওই মূর্তির মত) এক উপাস্য স্থির কর (গড়ে দিন)। তিনি বললেন, তোমরা এমন এক জাতি যারা মূর্খতা (সুলভ আচরণ) করছ।” (৭:১৩৮)
“এরা যে, কাজে নিয়োজিত রয়েছে তা অবশ্যই ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তারা করেছে তা বৃথা হয়ে যাবে!” (৭:১৩৯)
“তিনি (আরো) বললেন, আমি কি তাহলে আল্লাহকে ছাড়া তোমাদের জন্য অন্য কোন উপাস্য খুঁজব, অথচ তিনিই তোমাদেরকে (ওই যুগে) বিশ্ববাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।” (৭:১৪০)
মহান আল্লাহ তাঁর মহাঅনুগ্রহে বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কর্তৃত্ব ও জুলুম-নির্যাতন থেকে উদ্ধার করেন এবং তারা সিরিয়া অঞ্চলে ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু মুসা (আ.)’র সহযোগিতায় স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে এসে বনি ইসরাইল নানা ধরনের চিন্তাগত বিভ্রান্তির শিকার হয়। যেমন, তারা এমন এক জাতির চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হয় যারা ছিল মূর্তিপূজারি।
ফলে বনি ইসরাইলের অজ্ঞ ও সাধারণ লোকেরা হযরত মুসা (আ.)’র কাছে এ আবেদন জানায় যে, তিনি যেন তাদের জন্যও কাঠ ও পাথরের উপাস্য তৈরি করে দেন যাতে ওই জাতির মত তারাও মূর্তিপূজা করতে পারে! সাপ্তাহিক বা দৈনিক অনুষ্ঠানে তারা যেন এইসব মূর্তির সামনে পূজা-অর্চনা এবং মানত ও উতসর্গের কাজগুলো করতে পারে।
এ ধরনের আবেদন শুনে হযরত মুসা (আ.) অত্যন্ত বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি বললেন, তোমরা কি এত তাড়াতাড়ি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণার কথাগুলো ভুলে গেলে? কয়েকটা পাথরের মূর্তি দেখেই সেগুলোর ভক্ত হয়ে গেলে? তোমরা কি জান না এইসব মূর্তি ক্ষণস্থায়ী ও ধ্বংসশীল? যে আল্লাহ তোমাদের এত বড় বিজয় ও কর্তৃত্ব বা শাসন ক্ষমতা দান করলেন তা কি ভুলে গিয়ে অন্য প্রভু বা স্রষ্টা খোঁজা উচিত? এ কেমন অজ্ঞতাপূর্ণ ও মূর্খতাসুলভ আব্দার?
এ তিন আয়াতে কারিমার শিক্ষা হল:
এক. বিচ্যুতি ও দুর্নীতির পরিবেশ জনসাধারণের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই আমাদের ঈমান যতক্ষণ না শক্তিশালী হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বিচ্যুত ও অনাচারের পরিবেশ থেকে দূরে থাকা উচিত।
দুই. কখনও কখনও অজ্ঞ ও বোকা বন্ধুরা বিচক্ষণ শত্রুর চেয়েও ঐশী পথপ্রদর্শকদেরকে বেশি কষ্ট দিয়েছে।