সূরা আ'রাফ; আয়াত ১০৩-১০৮
সূরা আ'রাফের ১০৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
ثُمَّ بَعَثْنَا مِنْ بَعْدِهِمْ مُوسَى بِآَيَاتِنَا إِلَى فِرْعَوْنَ وَمَلَئِهِ فَظَلَمُوا بِهَا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ
"অতঃপর আমি তাদের পরে আমার নিদর্শনসমূহ দিয়ে মূসাকে পাঠাই ফেরাউন ও তার জাতির নেতাদের কাছে। বস্তুতঃ ওরা তাঁর মোকাবেলায় কুফরি করেছে। সুতরাং চেয়ে দেখ, কী পরিণতি হয়েছে অনাচারীদের।" (৭:১০৩)
এ পর্যন্ত সূরা আ'রাফের বিভিন্ন আয়াতে হুদ (আ.), সালেহ (আ.), লুত (আ.) ও শোয়েব (আ.)এর সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এ সূরায় অতীতের নবী-রাসূলদের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনার ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হচ্ছে,ওই সব নবীর পর হযরত মূসা (আ.)কে রাসূল হিসেবে পাঠানো হয়। প্রথমে তার উপর দায়িত্ব ছিল, ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়ের নেতাদের কাছে সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। মূসা (সা.) যে রাসূল,তা প্রমাণের জন্য আল্লাহ তাকে কিছু নিদর্শন ও মোজেজা দিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরাউন ও বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের নেতারা ওই সব নিদর্শন দেখার পরও মূসা (আ.)কে প্রত্যাখ্যান এবং তার সঙ্গে অন্যায় ও গোঁড়ামিপূর্ণ আচরণ করেছে। আল্লাহতায়ালা হযরত মূসা (আ.)কে যেসব নিদর্শন দিয়ে পাঠিয়েছিলেন,তারা সেগুলোকে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে কুফরি করে এবং জুলুম-অত্যাচার অব্যাহত রাখে।
পবিত্র কুরআনে ১৩৬ বার মূসা (আ.)এর নাম এসেছে। আ'রাফসহ বিভিন্ন সূরায় মূসা (আ.)এর জন্ম থেকে শুরু করে নব্যুয়তপ্রাপ্তি ও ফেরাউনের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো
হলো:
এক. সমাজকে সংশোধনের জন্য প্রথমে ওই সমাজের অত্যাচারী নেতাদেরকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। তাদেরকে অন্যায় পথ থেকে সরে আসার আহ্বান জানাতে হবে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাজ না হলে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে।
দুই. অত্যাচারী নেতাদের ভোগ-বিলাস ও বাহ্যিক চাকচিক্যের মোহে পড়লে চলবে না। এর ফলে আমাদেরকেও তাদের পরিণতি ভোগ করতে হবে।
সূরা আ'রাফের ১০৪ ও ১০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَقَالَ مُوسَى يَا فِرْعَوْنُ إِنِّي رَسُولٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (104) حَقِيقٌ عَلَى أَنْ لَا أَقُولَ عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ قَدْ جِئْتُكُمْ بِبَيِّنَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ فَأَرْسِلْ مَعِيَ بَنِي إِسْرَائِيلَ (105)
"মূসা বললোঃ হে ফেরাউন!আমি বিশ্ব জাহানের প্রভুর কাছ থেকে প্রেরিত।" (৭:১০৪)
"আমার দায়িত্বই হচ্ছে,আল্লাহর নামে সত্য ছাড়া আর কিছুই বলবো না। আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নিযুক্তির সুস্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছি। কাজেই তুমি বনী ইসরাঈলকে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও।" (৭:১০৫)
ফেরাউন নিজেকে বিশ্বের প্রভু বলে দাবি করতো। এ কারণে মূসা (আ.) ফেরাউনের সঙ্গে প্রথম দেখাতেই বললেন, আমি বিশ্ব জাহানের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমার কাছে এসেছি। আমি যা বলছি, তার সব কিছুই সেই প্রভুর পক্ষ থেকে বলছি। নিজে থেকে কিছু বলছি না। আমি কিছু ঐশী নিদর্শন নিয়ে এসেছি। যেসব মোজেজা প্রদর্শন করবো, তার সবই দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। কাজেই জুলুম- অত্যাচারের পথ থেকে সরে এসো এবং বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে মুক্তি দাও,যাতে তারা আমার সঙ্গে আসতে পারে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. নবী-রাসূলরা সব সময় মানুষকে সত্যের পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা কাউকে পরোয়া করতেন না।
দুই. নবী-রাসূলদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল, অত্যাচারীদের আধিপত্য থেকে মানুষকে মুক্ত করা।
সূরা আ'রাফের ১০৬ ও ১০৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
قَالَ إِنْ كُنْتَ جِئْتَ بِآَيَةٍ فَأْتِ بِهَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ (106) فَأَلْقَى عَصَاهُ فَإِذَا هِيَ ثُعْبَانٌ مُبِينٌ (107(
"ফেরাউন বললোঃ তুমি যদি কোন প্রমাণ এনে থাকো এবং নিজের দাবীর ব্যাপারে সত্যবাদী হও, তাহলে তা পেশ করো।" (৭:১০৬)
"মূসা নিজের লাঠিটি ছুড়ে দিল। অমনি তা একটি জ্বলজ্যান্ত অজগরের রূপ ধারণ করলো।" (৭:১০৭)
মূসার কথা শুনে ফেরাউন প্রথমে ভাবলো-আগে পরীক্ষা করে দেখা যাক, মূসা অলৌকিক কিছু করে দেখাতে পারে কিনা। হয়তো সে পারবে না। এর ফলে নিজে নিজেই অপমানিত হবে। আর যদি সে অলৌকিক কিছু করতে পারে, তাহলে তখন তাকে জাদুকর হিসেবে অপবাদ দেয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেরাউন হযরত মূসা (আ.) কে বললো, যদি নিজের দাবির বিষয়ে সত্যবাদী হও, তাহলে তা পেশ করো। মূসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে নিজের হাতের লাঠিটি ছুড়ে দিলেন এবং তা বিশাল অজগরে রূপ নিল। অবশ্য এর আগে সেই লাঠিটি মূসা (আ.)এর সামনেও ছোট সাপের রূপ নিয়েছিল। প্রথমে লাঠিটিকে বিশাল অজগরের রূপে সামনে আনা হয়নি, কারণ মূসা(আ.) তা দেখে ভয় পেতে পারতেন। কিন্তু যেদিন ফেরাউন অন্য জাদুকরদের মাধ্যমে মূসা (আ.)কে অপমান করতে চেয়েছিল, সেদিন মূসা (আ.) এর লাঠিটি বিশাল অজগরের রূপ নিলো এবং অন্য জাদুকরদের কৃত্রিম সব সাপকে খেয়ে ফেললো। জাদুকরদের সাপগুলো খাওয়ার পর বিশাল অজগরটি আবার লাঠিতে পরিণত হলো।
মূসা (আ.) তার লাঠির মাধ্যমে আরো কয়েকটি মোজেজা প্রদর্শন করেছেন। সে সময় একবার প্রচণ্ড খরা দেখা দিল। মূসা (আ.) লাঠি দিয়ে একটি পাথরে আঘাত করলেন। এর ফলে ওই পাথর থেকে ঝর্ণার সৃষ্টি হলো। এ ছাড়া, নীল নদ পার হওয়ার সময় তিনি ওই লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করেন এবং নদীর পানি দুই ভাগ হয়ে যায়। মাঝখানে সৃষ্টি হয় শুষ্ক রাস্তার। এর ফলে মূসা (আ.) ও তার অনুসারীরা নদীটি পার হতে পারেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. মোজেজা হচ্ছে নব্যুয়তের প্রমাণ। মোজেজা দেখানোর পরও ফেরাউনের মতো লোকজন যে সত্য মেনে নেবে না, তা নবী-রাসূলরা জানতেন। কিন্তু তারপরও তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য নবী-রাসূলরা মোজেজা প্রদর্শন করেছেন।
দুই. নবী-রাসূলদের মোজেজা সেই যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। মূসা (আ.) এর সময়ে জাদুবিদ্যার বেশ প্রচলন ছিল। এ কারণে মূসা (আ.)কে আল্লাহতায়ালা লাঠি দিয়ে বিভিন্ন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটানোর ক্ষমতা দিয়েছিলেন।
সূরা আ'রাফের ১০৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَنَزَعَ يَدَهُ فَإِذَا هِيَ بَيْضَاءُ لِلنَّاظِرِينَ (108(
"আর বের করলেন নিজের হাত এবং তা সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের চোখে ধবধবে উজ্জ্বল দেখাতে লাগল।" (৭:১০৮)
ফেরাউনের দরবারে মূসা (আ.) আরেকটি চমকপ্রদ মোজেজা প্রদর্শন করেন। তিনি জামার ভেতর থেকে তার হাত বের করেন। সে হাত ছিল আশ্চর্যজনক শুভ্র উজ্জ্বল। মিশরীয়রা সাপকে ভীতি ও কুপ্রভাবের প্রতীক বলে মনে করতো। হযরত মুসা (আ.) এর লাঠি সাপে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যদিয়ে কারো মনে যাতে এ ধারনার সৃষ্টি না হয় যে, মুসাই হচ্ছেন ভীতি ও কুপ্রভাবের বার্তাবাহক, সে কারণে স্বর্গীয় জ্যোতি বিচ্ছুরিত হাত প্রদর্শন করা হয়েছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর রহমতের বিষয়ে আশাবাদী করে তোলা হয়েছে। মূসা (আ.)এর শুভ্র উজ্জ্বল হাত হচ্ছে, আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ ও আশার প্রতীক।