সূরা আল আনফাল;(১১তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আল আনফাল;(১১তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 1:50:7 3-10-1403

সূরা আল আনফাল; আয়াত ৪৬-৪৯

সূরা আনফালের ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ

"আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে আর নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না। বিবাদ করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। তোমরা ধৈর্য্য ধারণ করবে, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সঙ্গেই রয়েছেন।" (৮:৪৬)

এর আগের আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় আমরা ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ এবং ওই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর প্রতি আল্লাহতালার পক্ষ থেকে বিশেষ সাহায্যের বিষয়টি আলোচনা করেছি। আগের আলোচনার ধারাবাহিকতায় এই পবিত্র আয়াতে বলা হচ্ছে, ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে।

প্রথম শর্ত হচ্ছে, আল্লাহ ও তার রাসূলের পূর্ণ আনুগত্য করতে হবে। দুই, মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে হবে এবং তিন নম্বর শর্ত হচ্ছে, সকল বাধা-বিপত্তির মুখে ধৈর্য্যের সাথে অবিচল থাকতে হবে। কাজেই মুসলমানরা যদি সত্যিকারভাবে আল্লাহ ও রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করে, নিজেদের মধ্যকার কাঁদা ছুঁড়াছুড়ি বন্ধ করে, ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে এবং অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তাহলে অবশ্যই তাদের প্রতি ঐশি সাহায্য বা আসমানী মদদ নেমে আসবে।

সূরা আনফালের ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَاللَّهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ

"তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা গর্বভরে এবং লোক দেখানোর জন্য নিজ বাড়ি থেকে বের হয়েছিল অর্থাত যুদ্ধে গিয়েছিল। আসলে তারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করেছিল; বলা বাহুল্য তাদের সকল কীর্তিকলাপই আল্লাহর আয়ত্বে রয়েছে।" (৮:৪৭)

আল্লাহর পথে যারা মুজাহিদ অর্থাত যারা একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো অবস্থায়ই যেন গর্ব-অহংকার, উন্মত্ততা এবং রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব তাদেরকে গ্রাস না করে। যারা মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের জন্য লড়াই করবে তাদের সব কিছুই হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। উন্মত্ততা, ব্যক্তিগত শত্রুতা বা ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে হত্যা তো দূরে থাক কারো সামান্য ক্ষতি করা যাবে না। এই পবিত্র আয়াতে মুসলমানদেরকে এটা বলা হচ্ছে, তোমরা অমুসলমান কাফের মুশরেকদের মত হয়ো না, যারা শক্তির মদমত্ততা বা পেশি শক্তি প্রদর্শনের জন্য লড়াই করে এবং যাদের উদ্দেশ্য মানুষকে আল্লাহর রাস্তা থেকে বিরত রাখা।

সূরা আনফালের ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَّكُمْ  فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكُمْ إِنِّي أَرَىٰ مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّـهَ  وَاللَّـهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ

"স্মরণ কর, শয়তান তাদের কার্যাবলী তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল এবং বলেছিল আজ মানুষের মধ্যে কেউই তোমাদের ওপর বিজয়ী হবে না। আমি সাহাযার্থ্যে তোমাদের নিকটেই থাকব। অতঃপর দুই দল যখন পরস্পরের সম্মুখীন হলো তখন সে সরে পড়ল এবং বলল, তোমাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক রইল না। তোমরা যা দেখতে পাও না আমি তা দেখি। আমি আল্লাহকে ভয় করি এবং আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।" (৮:৪৮)

এই আয়াতেও বদর যুদ্ধের একটি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বদর যুদ্ধে শয়তান মানবরূপ ধারণ করে অমুসলিম কাফের বাহিনীর মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছিল। সে কাফের বাহিনীকে নিশ্চিন্ত বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু যখন শয়তান মুসলিম বাহিনীর সাহায্যার্থে ফেরেশতাদের উপস্থিতি টের পেল এবং বুঝতে পারলো যে, মুসলিম বাহিনী বিশেষ ঐশি সাহায্য লাভ করেছে তখন সে রণভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। অবশ্য পালানোর সময় হন্তদন্ত হয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর শাস্তির কথাও উচ্চারণ করেছিল।

এই আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, শয়তান সব সময় খারাপ ও অবৈধ কাজকে সুন্দর করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে। এ ছাড়া, শয়তানই সব সময় সব গণ্ডগোলের সূচনা করে থাকে, সে অন্যায়, অপকর্মের অনুপ্রেরণা যোগায় এবং অপকর্মকারীকে এই আশ্বাস দেয় যে, সে কখনোই ধরা পড়বে না বা কেউ তাকে শাস্তি দিতে পারবে না। তাই মুমিন মুসলমানদেরকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সচেতন থাকার উপদেশ দেয়া হয়েছে।

সূরা আনফালের ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ غَرَّ هَؤُلَاءِ دِينُهُمْ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

"স্মরণ কর, মুনাফেক বা কপট এবং অসুস্থ অন্তরের মানুষরা বলে, ধর্মই মুসলমানদেরকে অহংকারী করেছে, কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করলে আল্লাহ তো পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়।" (৮:৪৯)

মুনাফেক বা কপট ব্যক্তিরা মুসলমানদের সফলতা বা বিজয়কে মন থেকে গ্রহণ করতে পারে না। তারা নিজেরা যেমন কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না তেমনি অন্যদেরকেও আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামের ব্যাপারে নিরুতসাহিত করে। তাই মুসলমানদের বিজয়কে তারা গর্ব বা অহংকারের ফল বলে মন্তব্য করে অথচ মুমিন মুসলমানরা যে সফলতা বা নিজয় ছিনিয়ে আনে তা আল্লাহর উপর তাওয়াস্সুল বা নির্ভর করেই অর্জন করে থাকে। মহান আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান। তাই যারা আল্লাহর ওপর নির্ভর করে তাদের সফলতাও অনিবার্য।