সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৭৯-১৮৩
সূরা আল আ'রাফের ১৭৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آَذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ
"আমি অবশ্যই বহু মানুষ ও জিনকে দোযখের জন্যে নির্ধারিত করেছি ; কারণ তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তারা সত্যকে উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ থাকলেও তা দিয়ে তারা সত্যকে দেখে না, তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা সত্য বাণী শোনে না। ওরা পশুর মতো; বরং তার চেয়েও বেশী পথভ্রষ্ট; নিশ্চয়ই তারা উদাসীন।" (৭:১৭৯)
মহান আল্লাহ মানুষকে পূর্ণতা দেয়ার জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। আর এ জন্যে তিনি তাদেরকে প্রয়োজনীয় সমস্ত মাধ্যম দান করেছেন। চোখ, কান ও বিবেক সত্যকে জানা ও বোঝার মাধ্যম। কিন্তু যারা এসব মাধ্যম থাকা সত্যতেও সত্যকে বোঝার জন্যে এসব মাধ্যমকে কাজে না লাগিয়ে বরং অন্যায় কাজে এ মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে, তারা আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়। ফলে দোযখবাসই হয় তাদের পরিণতি। মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীব জন্তুরও সীমিত পর্যায়ে এ ধরনের মাধ্যম রয়েছে । মানুষ যদি তাদের কাছে আল্লাহর দেয়া শক্তিশালি মাধ্যমগুলোকে সঠিকভাবে কাজে না লাগায়, তাহলে সে পশুর চেয়েও অধম। কারণ, এ ধরনের মানুষ বিবেক, দৃষ্টি ও কান থাকা সত্ত্বেও নিজেকে পশুর মতোই উদাসীনতার মধ্যে নিমজ্জিত করেছে এবং এ জন্যে তারা সত্যকে মেনে নিতে প্রস্তুত হয়নি, অথচ পশুর মধ্যে থাকা এ ধরনের মাধ্যমগুলো মানুষের মতো শক্তিশালি নয় । অর্থাৎ সত্যকে জানা ও বোঝার জন্যে বিভিন্ন মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে, কারণ, এ কাজের জন্যেই মানুষকে বিভিন্ন মাধ্যম দেয়া হয়েছে বলে এ কাজ করা তাদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে মানুষকে বিভ্রান্ত লোকদের পরিণতি ভোগ করতে হবে তথা নরকে বাস করতে হবে।
এ আয়াতের দু’টি শিক্ষা হল:
এক. সবাই ঈমান আনবে বা সব মানুষই সংশোধিত হবে এমন আশা করা উচিত নয়। কারণ, মহান আল্লাহ মানুষকে পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়ায় অনেক মানুষ ভুল পথ নির্বাচন করবে এবং দোযখে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
দুই. মানুষের মনুষ্যত্বের মানদণ্ড হল- তারা সত্যকে উপলব্ধি করবে। মানুষের এ মানদণ্ড না থাকলে তাকে পশুর সমান, বরং পশুর চেয়েও অধম বলা যায়।
সূরা আ'রাফের ১৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
"সর্বোত্তম নামগুলো আল্লাহর জন্যেই নির্ধারিত । তাই, তোমরা আল্লাহকে এসব নামেই ডাকবে। যারা আল্লাহর নামসমূহের ব্যাপারে সঠিক পথ থেকে ভ্রষ্ট (ও সেগুলোকে বিকৃত করে) তাদের বর্জন করবে। তারা যা করেছে সে জন্যে তারা শিগগিরই শাস্তি পাবে।" (৭:১৮০)
সব ধরনের সুন্দর গুণ আল্লাহর জন্যেই শোভা পায় । কারণ, মহান আল্লাহই সব ধরনের পরিপূর্ণতা, মহৎ গুণ ও সৌন্দর্যের উৎস । তাই সর্বোত্তম ও সুন্দরতম নাম এবং শব্দগুলোকে আল্লাহর নাম বা পরিচয় হিসেবে তুলে ধরা উচিত । আল্লাহর নামগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করা উচিত। পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াতে আল্লাহর নামের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে বলা হয়েছে এবং মহান আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা তো দূরের কথা, মহান আল্লাহর নামের পাশে অন্যদের নাম উচ্চারণ করতেও নিষেধ করা হয়েছে, যাতে নামের ক্ষেত্রেও কেউ যেন মহান আল্লার সঙ্গে কাউকে শরীক না করে।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. সব ধরণের ভালো গুণ, সৌন্দর্য ও কল্যাণ মহান আল্লাহ থেকেই উৎসারিত । তাই, কল্যাণ বা সৌভাগ্য অর্জনের জন্যে অবশ্যই আল্লাহর পথে চলা উচিত ।
দুই. ইসলাম ধর্ম সুন্দর নামকে গুরুত্ব দেয় । ধর্মীয় মনীষী ও নেতৃবৃন্দ মানুষের নাম রাখার সময় সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম রাখতে বলেছেন ।
সূরা আরাফের ১৮১ থেকে ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِالْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ (181) وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ (182) وَأُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِينٌ (183)
"যাদের আমি সৃষ্টি করেছি, তাদের মধ্যে এমন একদল আছে যারা অন্যদেরকে সত্যের বা ন্যায়ের পথ দেখায় এবং ন্যায় বিচার করে।" (৭:১৮১)
"যারা আমার নিদর্শন বা আয়াতকে অস্বীকার করে, আমি তাদেরকে ক্রমশ এমন পথ দিয়ে জাহান্নাম বা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে তারা জানতেও পারে না।" (৭:১৮২)
"আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি, আমার কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও মজবুত (এবং এ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই)।" (৭:১৮৩)
এ আয়াতে মানুষকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একদল মানুষ নিজে সুপথ পেয়েছে এবং অন্যদেরও সুপথ দেখানোর চেষ্টা করে। এ ধরনের মানুষ সত্য ও ন্যায় বিচার অনুযায়ী কাজ করে বলে তারা অন্যদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হন। কিন্তু অন্য এক দল মানুষ সত্যকে মেনে নেয়নি ও সত্য পথে চলেনি এবং তারা আল্লাহর উপাসনার পরিবর্তে নিজ প্রবৃত্তির পূজা করেছে। আর এ কারণে তারা সত্য পথ ও আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করেছে।
মহান আল্লাহ এ শ্রেণীর লোকদের সম্পর্কে বলছেন, তিনি তাদেরকে এ দুনিয়ার জীবনে নিজ খেয়াল খুশিমতো চলার সুযোগ দিয়েছেন , তবে সুযোগের অপব্যবহারের কারণে অর্থাৎ পাপ ও বিভ্রান্তির পথ বেছে নেয়ার কারণে তাদের পাপের বোঝা দিন দিন বাড়ছে এবং তারা প্রতি দিন সত্য পথ থেকে বেশী দূরে তথা ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে।
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে যেসব শাস্তি দিয়ে থাকেন তার মধ্যে পর্যায়ক্রমিক বা ধীর গতির শাস্তি হল অন্যতম। পাপী ব্যক্তি এ ধরনের শাস্তিকে উপলব্ধি করতে পারে না, তবে এ ধরনের শাস্তি তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে। এ জন্যেই পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলছেন, আমি এমনভাবে তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে তারা টের পায় না।
এ তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হলোঃ
এক. অন্যদেরকে শুধু মুখে মুখে সৎ পথে চলার উপদেশ দিলেই চলবে না, কাজের মাধ্যমেও অন্যদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। আর এ ধরনের দৃষ্টান্তের মাধ্যমেই মানুষ বেশী সুপথ পেয়ে থাকে।
দুই. আমরা পাপ করা সত্ত্বেও যদি এর পরিণতি দেখছি না বলে যেন খুশি না হই । কারণ, আমরা হয়তো পাপের কারণে শাস্তি ঠিকই পাচ্ছি , কিন্তু তা বুঝতে পারছি না। তাই আমাদের উচিত তওবা করা এবং পাপের ক্ষতিগুলো পুষিয়ে নেয়া।
তিন. দয়াময় আল্লাহ সবার জন্যেই তওবার সুযোগ খোলা রেখেছেন। কিন্তু শুধু মুমিনরাই তওবার সুযোগকে কাজে লাগায়। আর পথভ্রষ্টরা তওবার সুযোগকে পালানোর সুযোগ মনে করে ভুল করে।