সূরা আ'রাফ; (৪৩তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (৪৩তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 6:46:53 3-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৮৮-১৯২

সূরা আল আ'রাফের ১৮৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

"(হে নবী!) আপনি বলুন, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া আমার নিজেরও ভালো মন্দের বা লাভ ও ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতা নেই। এবং যদি আমি অদৃশ্য বিষয়ে জানতাম তাহলে তো আমি নিজে প্রচুর লাভ বা কল্যাণের অধিকারী হতে পারতাম এবং কোনো অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমি তো শুধু ঈমানদার বা বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্যে সতর্ককারী ও সুসংবাদবাহী।" (৭:১৮৮)

কোনো কোনো মানুষ ইসলামের নবী (সা.)'র কাছে এ প্রত্যাশা করতো যে তিনি গণক বা ভবিষ্যৎ-বক্তাদের মতো নিজের ও অন্যদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানবেন এবং এভাবে তাদের জন্যে কল্যাণ বয়ে আনবেন ও বিপদ থেকে মুক্ত থাকবেন । এ আয়াতে মহানবী (সা.) বলছেন, আমি তোমাদেরকে সুপথ ও দিক নির্দেশনা দেয়ার জন্যে এসেছি । তোমাদেরকে অদৃশ্যের খবর দেয়ার জন্যে আমি আসিনি । যদি আমি অদৃশ্যর  খবর রাখতাম, তাহলে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বা এ বিদ্যা খাটিয়ে নিজের জন্যে অনেক ধন সম্পদ জমা করতে পারতাম, কিম্বা ভবিষ্যৎ বা আসন্ন বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারতাম। তোমাদের মতো আমিও নিজের কল্যাণ বা অকল্যাণের  ক্ষমতা রাখি না।

আসলে অদৃশ্যের জ্ঞান শুধু আল্লাহর জন্যেই নির্ধারিত। অন্য কেউ অদৃশ্য সম্পর্কে জানতে পারলেও তা শুধু আল্লাহর অনুমতিক্রমেই জানতে পারেন। মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্যে অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সামান্য কিছু জ্ঞান নবীগণকে দেয়া হয়েছে। আর এ জ্ঞানকে ব্যক্তিগত কাজে লাগানোর অনুমতিও আল্লাহ তাদেরকে দেননি। নবী-রাসূলগণ অন্যান্য মানুষের মতোই সাধারণভাবে জীবন যাপন করতেন এবং তাঁরা অদৃশ্যের জ্ঞানের ভিত্তিতে জীবন যাপন করতেন না।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ

এক.  আমাদের যা আছে তা নিয়ে আমরা যেন অহংকার না করি, কারণ, আমরা আমাদের নিজ জীবনেরই মালিক নই। আমাদের সব কিছুই আল্লাহর হাতে রয়েছে এবং আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনো কিছুই ঘটে না ।

দুই. অদৃশ্যের জ্ঞান হেদায়াত বা সুপথ দেখানোর মাধ্যম মাত্র, এ জ্ঞান উপার্জন বা বিপদ দূর করার মাধ্যম নয় । এ কারণেই নবী-রাসূলগণের জীবন ছিল কষ্ট ও বিপদসংকুল।

সূরা আরাফের ১৮৯ ও ১৯০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا فَلَمَّا تَغَشَّاهَا حَمَلَتْ حَمْلًا خَفِيفًا فَمَرَّتْ بِهِ فَلَمَّا أَثْقَلَتْ دَعَوَا اللَّهَ رَبَّهُمَا لَئِنْ آَتَيْتَنَا صَالِحًا لَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ (১৮৯) فَلَمَّا آَتَاهُمَا صَالِحًا جَعَلَا لَهُ شُرَكَاءَ فِيمَا آَتَاهُمَا فَتَعَالَى اللَّهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ  (১৯০)

"আল্লাহ তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং ঐ ব্যক্তি হতে তার সহধর্মিণী সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়। এরপর যখন সে তার সাথে মিলিত হয়, তখন সে লঘু গর্ভধারণ করে  এবং কিছুকাল ঐ হাল্কা গর্ভসহ বিচরণ করে, এরপর গর্ভ যখন ভারী হয়, তখন তারা উভয়ে নিজ প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করে যে, যদি আপনি আমাদের পূর্ণাঙ্গ সুসন্তান দান করেন, তাহলে আমরা কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকবো।" (৭:১৮৯)

"আর যখন আল্লাহ তাদের নেক সন্তান বা সৎকর্মশীল সন্তান দান করলেন তখন তারা তাদের যা দেয়া হয় সে সম্বন্ধে আল্লাহর  শরীক করে, কিন্তু তারা যাকে শরীক করে, আল্লাহ তা থেকে অনেক উর্ধ্বে বা পবিত্র।" (৭:১৯০)

এ দুই আয়াতে সন্তানের বাবা মা বা স্বামী-স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলছেন: আল্লাহ তোমাদেরকে একে অপরের জীবন সঙ্গী করেছেন যাতে তোমরা পরষ্পরের কাছে প্রশান্তি পাও এবং সন্তান পেতে পার। যখন সন্তানের জন্মের সময় ঘনিয়ে আসে তখন তোমরা আল্লাহর কাছে এ প্রার্থণা কর যে, সন্তানটি যেন ভালো, সৎ ও সুস্থ হয় এবং এ নেয়ামতের জন্যে তোমরা কৃতজ্ঞ থাকারও অঙ্গীকার করে থাকো। কিন্তু সন্তানের বাবা মা হবার পর তোমরা আল্লাহকে ভুলে যাও এবং সন্তানকে আল্লাহর আনুগত্য শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে শিরকের দিকেই পরিচালিত কর।

এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হল:

এক.  দাম্পত্য জীবন নারী ও পুরুষের পারষ্পরিক প্রশান্তির জন্যে জরুরী।  মানসিক সমস্যাগুলো থেকে দূরে থাকার জন্যে অবিবাহিত যুবক যুবতিদের উচিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া।

দুই. মানুষ ভালোবাসা ও সহমর্মীতার মুখাপেক্ষী। মহান আল্লাহ জীবন সঙ্গী ও পরিবার গঠনের মধ্যে মানুষের জন্যে এর ব্যবস্থা   রেখেছেন ।

তিন.  বিয়ের অন্যতম লক্ষ্য হলো মানব বংশ টিকিয়ে রাখা এবং সৎ ও নেককার সন্তান প্রতিপালন করা ।

চার.   সন্তান যাতে সৎ ও পবিত্র হয় সে জন্য সন্তান জন্ম দেয়ার আগেই পদক্ষেপ নেয়া এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া উচিত ।

সূরা আরাফের ১৯১ ও ১৯২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

أَيُشْرِكُونَ مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ (১৯১) وَلَا يَسْتَطِيعُونَ لَهُمْ نَصْرًا وَلَا أَنْفُسَهُمْ يَنْصُرُونَ (১৯২)

"তারা কি এমন বস্তুকে আল্লাহর শরীক করে যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, বরং ওরা নিজেরাই সৃষ্ট?" (৭:১৯১)

"এবং ওরা তাদের সাহায্যও করতে পারে না,  এমনকি ওরা  নিজেকেও সাহায্য করতে অক্ষম।" (৭:১৯২)

আগের আয়াতে আমরা জেনেছি, কোনো কোনো পিতা মাতা নিজ সন্তানদের আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট করার পরিবর্তে তাদেরকে অন্য দিকে আকৃষ্ট করে এবং তারা মনে করে আল্লাহ ছাড়াও অন্যান্য বস্তুর শক্তি ও সম্মান আছে। এ আয়াতে আল্লাহ প্রশ্ন করছেন, অন্যরা কি নিজেই কোনো কিছুর অধিকারী? আল্লাহ ছাড়া অন্যান্যরা কি কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে? ওরা নিজেরাইতো সৃষ্ট। ওরা কি বিপদের সময় বা অন্য কোনো সময় কাউকে সাহায্য করতে পারে?  ওরা নিজের প্রাণটি পর্যন্ত রক্ষার ক্ষমতা রাখে না। ওদের জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর হাতেই নিবদ্ধ। আল্লাহ কাফেরদের আরো বলছেনঃ তোমরা কেন আল্লাহর পথে চলছো না? আল্লাহর কাছে এমন কি নেই যা অন্যদের কাছে আছে? কেন সন্তানদের এমনভাবে প্রতিপালন করছো যে তারা শুধু দুনিয়া এবং দুনিয়ার ধন-সম্পদ নিয়ে ব্যস্ত থাকে? তোমরা কেন পরকালের ব্যাপারে  উদাসীন এবং কেন নিজ সন্তানকেও পরকালের ব্যাপারে উদাসীন করছো?

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ

এক.  সন্তান হলো বাবা মায়ের কাছে আল্লাহর এক বড় আমানত । তাই এ আমানতের ব্যাপারে অবিচার করা এবং তাদেরকে খোদাহীনতার দিকে পরিচালনা করা উচিত নয়।

দুই.  আল্লাহ ছাড়া কথিত অন্য উপাস্যদের কিছুই নেই এবং তাদের নিজস্ব বলতে কিছুই নেই বলে ওরা আসলে কিছুই নয় । কিন্তু আল্লাহ সব কিছুরই উৎস ও মালিক এবং তিনি সব কিছুরই অধিকারী । তাই 'কিছুই নয়' এমন বস্তুর জন্যে সব কিছুর মালিক ও উৎসকে ত্যাগ করা ঠিক হবে না ।