সূরা আত তাওবা; (১১তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আত তাওবা; (১১তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 7:2:26 3-10-1403

সূরা আত তাওবা; আয়াত ৪৩-৪৭

সূরা আত তাওবার ৪৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

عَفَا اللَّهُ عَنْكَ لِمَ أَذِنْتَ لَهُمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَتَعْلَمَ الْكَاذِبِينَ

“আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করেছেন, কারা সত্যবাদী তা স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এবং কারা মিথ্যাবাদী তা না জানা পর্যন্ত আপনি কেন তাদেরকে অব্যাহতি দিলেন?” (৯:৪৩)

আগের কয়েকটি পর্বে বলা হয়েছে যে, রোমক বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য আল্লাহর রাসূল যখন মুসলমানদেরকে তাবুক অভিযানের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন, তখন অনেকেই বিভিন্ন বাহানায় মদিনায় থেকে যাওয়ার জন্য নবীজির কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। কেউ কেউ আল্লাহর রাসূলকে বললেন, শারীরিক সমস্যার কারণে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তাবুক অভিযানে যোগ দিতে তারা অক্ষম, আবার অনেকেই ফসল তোলার মৌসুম হওয়ার কারণে জিহাদে যেতে অপারগতার কথা জানান। শেষ পর্যন্ত নবীজি অনেকের আবেদন মঞ্জুর করেন এবং তাদেরকে জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে অব্যাহতি দান করেন।

এই আয়াতে মহানবী (সা.)কে পরোক্ষভাবে সংশোধন করে বা সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, যারা জিহাদ থেকে অব্যাহতি চেয়েছিল তাদের অধিকাংশের অজুহাত গ্রহণযোগ্য ছিল না।

তবে এই আয়াত দ্বারা আল্লাহতালা তার পয়গম্বরকে তিরস্কার করেননি। কারণ পরবর্তী আয়াত থেকে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহও এটা পছন্দ করেননি যে, মুনাফিকরা জিহাদে অংশগ্রহণ করুক।

এই আয়াতের মাধ্যমে মূলত: যারা বৈধ কারণ ছাড়া জিহাদে অংশ না নেয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেছিল তাদের মুখোশ উন্মোচিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তাদেরকে এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা এটা মনে করো না যে, তোমাদের মিথ্যাচার সম্পর্কে আল্লাহ ও তার রাসূল অবগত নন, বরং আমরা তা জানি এবং বুঝি। তাই আমরাই চাইনি তোমাদের মত মানুষ জিহাদের ময়দানে উপস্থিত হোক।

আসলে জিহাদ বা যুদ্ধের ময়দানেই প্রকৃত সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর পরিচয় ফুটে উঠে। এই আয়াতের তাৎপর্যের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা লক্ষ্য করবো যে, আল্লাহর সতর্কবাণীর মধ্যে ক্ষমা ও রহমতের পাথেয় রয়েছে। তিনি যেমন সতর্ক করেন তেমনি ক্ষমার বাণীও ঘোষণা করেন।

সূরার ৪৪ ও ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ أَنْ يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ (44) إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ فَهُمْ فِي رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُونَ

“আল্লাহ ও রোজ কিয়ামতের প্রতি যাদের ঈমান রয়েছে তারা জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করা থেকে আপনার কাছে অব্যাহতি কামনা করবে না, আল্লাহ মুত্তাকীদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।” (৯:৪৪)

“আপনার নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা করে কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে না এবং যাদের অন্তর সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, তারা তাদের সংশয়ের কারণে দ্বিধাগ্রস্ত।” (৯:৪৫)

আগের আয়াতের সঙ্গে এই আয়াতের সম্পর্ক রয়েছে। এই আয়াতে মুমিন ও মুনাফিক-এই দুই পক্ষের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা হয়েছে এবং এই দুই পক্ষের মন-মানসিকতা ও মনোবলের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে- যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাসী তারা মৃত্যুকে ভয় পায় না। তাই তারা জিহাদ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য অজুহাত খুঁজে বেড়ায় না। আর যারা অজুহাত খুঁজে বেড়ায় তারা আসলে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদের মনে সংশয় আছে এবং তারা প্রকৃতপক্ষে দ্বিধাগ্রস্ত।

আসলে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান দিয়ে প্রকৃত মুমিন-মুত্তাকী যাচাই করা সম্ভব নয়। একমাত্র জিহাদের ময়দানেই প্রকৃত মুমিন মুত্তাকী চেনা সম্ভব। যিনি প্রকৃত মুত্তাকী বা পরহেজগার তিনি জিহাদের ময়দানে অবর্তীর্ণ হবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সূরা তাওবার ৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَوْ أَرَادُوا الْخُرُوجَ لَأَعَدُّوا لَهُ عُدَّةً وَلَكِنْ كَرِهَ اللَّهُ انْبِعَاثَهُمْ فَثَبَّطَهُمْ وَقِيلَ اقْعُدُوا مَعَ الْقَاعِدِينَ

“যদি সত্যিই জিহাদে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের দৃঢ় সংকল্প থাকতো তাহলে অবশ্যই তারা যুদ্ধের জন্য কিছু সরঞ্জাম প্রস্তুত করতো, কিন্তু তাদের অভিযাত্রা আল্লাহর মনঃপুত ছিল না, তাই তাদের নিবৃত্ত রাখলেন এবং আদেশ হলো ঘরে বসা লোকদের মত তোমরা বসে থাকো।” (৮:৪৬)

এই আয়াতে তাবুক অভিযানে অংশ নিতে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের এবং মুনাফিকদের মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, যারা জিহাদ থেকে অব্যাহতি লাভের আশায় আল্লাহর রাসূলের দ্বারস্থ হয়েছিলেন আসলে তাদের যুদ্ধে যাওয়ারই কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এজন্য তারা যুদ্ধের কোনো সরঞ্জামই প্রস্তুত করেনি। আল্লাহও চান না এ ধরনের লোকজন জিহাদের ময়দানে উপস্থিত হোক। এ জন্য আল্লাহর রাসূল তাদেরকে অব্যাহতি দেন এবং তারা জিহাদে যাওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাদেরকে বলে দেয়া হয় নারী ও শিশুর মত তারাও যেন মদিনাতেই অবস্থান করে।

এ আয়াত থেকে আমরা এ উপলব্ধি করতে পারি যে, জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারাটা সৌভাগ্যের ব্যাপার, আল্লাহর দেয়া এই সৌভাগ্য অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের নসিবে হয় না।

এই সূরার ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَوْ خَرَجُوا فِيكُمْ مَا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ

“যদি মুনাফিকরা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে আসতো তাহলে বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করতো না। তারা বিভেদ সৃষ্টির জন্য তোমাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতো। তাদের কথা শোনার মত অনেক লোক তোমাদের মধ্যে রয়েছে। আল্লাহ জালিমদের ভালাভাবেই জানেন।” (৯:৪৭)

যুদ্ধের ময়দানে মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানের লোকজনের উপস্থিতি কেন আল্লাহর পছন্দ নয় এই আয়াতে তারই ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ যদি তাদেরকে যুদ্ধে যাওয়ার তাওফিক দিতেন তাহলে তারা সেখানে বিভ্রান্তি এবং ফেতনা সৃষ্টি করতো। আর সরলমনা মুসলমানদের অনেকেই হয়তো তাদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে যুদ্ধের ব্যাপারে নির্লিপ্ত হয়ে পড়তো। এর পরিণতিতে মুসলিম বাহিনীতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও হতাশা ছড়িয়ে পড়তো। এছাড়া মুনাফিকদের অনেকেই মুসলমানদের শত্রুদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত ছিল।

সত্যের জন্য জিহাদে ঈমান ও পরহেজগারী যথেষ্ট। লোকবল বিজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইসলামের ইতিহাসে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এ আয়াতে ফুটে উঠেছে তা হচ্ছে, মুসলিম সমাজে যারা বিভ্রান্তি ছড়ায়, সরলমনা মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিয়ে যারা সমাজে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে তাদের ব্যাপারে গভীর দৃষ্টি রাখতে হবে।