সূরা আন'আম;(৭ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(৭ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 12:22:1 3-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ২৯-৩২

সূরা আন’আমের ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَقَالُوا إِنْ هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا وَمَا نَحْنُ بِمَبْعُوثِينَ (29) وَلَوْ تَرَى إِذْ وُقِفُوا عَلَى رَبِّهِمْ قَالَ أَلَيْسَ هَذَا بِالْحَقِّ قَالُوا بَلَى وَرَبِّنَا قَالَ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ

"তারা বলেঃ ‘আমাদের এ দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন আর আমরা কখনো পুনরুত্থিত হবো না।" (৬:২৯)

"আপনি যদি দেখতেন,যখন তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের সামনে দাঁড় করানো হবে এবং তিনি (আল্লাহ্) বলবেন,‘এ কি প্রকৃত সত্য নয়?’ তারা বলবে, ‘আমাদের প্রতিপালকের শপথ! নিশ্চয়ই সত্য। তিনি বলবেন,‘তবে তোমরা যে অবিশ্বাস করতে,সেজন্য এখন শাস্তি ভোগ কর।" (৬:৩০)

গত আয়াতে মহান আল্লাহ, পবিত্র কুরআন ও তার রাসূল (সা.) সম্পর্কে মুশরিক ও কাফেরদের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা হয়েছে। এ দু'টি আয়াতে পুণরুত্থান দিবস সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, মুশরিকদের দৃষ্টিতে ইহকালীন জীবনই হচ্ছে একমাত্র জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যদিয়েই এ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। যদিও তারা কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করার পেছনে কোনো যুক্তি তুলে ধরতে পারে না।

এ আয়াতে আরো বলা হচ্ছে, এসব ব্যক্তিকে যখন পুণরুত্থান দিবসে আল্লাহর সামনে হাজির করানো হবে তখন তারা এতোটাই অস্থির ও আতংকিত হবে যে, তারা কসম করে বলতে থাকবে-পুণরুত্থান দিবস সত্য ও বাস্তব। কিন্তু সে সময় এ ধরনের স্বীকারোক্তি করে কোনো লাভ হবে না। কিয়ামতের দিন এ ধরনের স্বীকারোক্তির কোনো মূল্য নেই, কারণ এতে শাস্তি লাঘব হবে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. মুশরিক ও কাফেররা নিজেদেরকে উদার বলে দাবি করলেও আসলে তারা স্বার্থপর এবং তাদের মধ্যে সঠিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তারা ধারণা করছে, পুণরুত্থান দিবস ও আধ্যাত্মিকতাকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে তারা বিজয় অর্জন করছে। যদিও তারা পরাজিত।

দুই. পুণরুত্থান দিবসে স্বয়ং আল্লাহ বিচারকের আসনে বসবেন এবং সেখানে বিন্দু পরিমাণ অন্যায় করা হবে না।

সূরা আন’আমের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِلِقَاءِ اللَّهِ حَتَّى إِذَا جَاءَتْهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً قَالُوا يَا حَسْرَتَنَا عَلَى مَا فَرَّطْنَا فِيهَا وَهُمْ يَحْمِلُونَ أَوْزَارَهُمْ عَلَى ظُهُورِهِمْ أَلَا سَاءَ مَا يَزِرُونَ

"তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যারা (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে। কিন্তু যখন হঠাত করে তাদের কাছে কিয়ামত উপস্থিত হবে তখন তারা বলবে,‘হায়! এ বিষয়ে আমরা যে অবহেলা করেছি তার জন্য আক্ষেপ।’ তারা নিজ নিজ পীঠে তাদের পাপের বোঝা বহন করবে। আর তারা যা বহন করবে তা কত নিকৃষ্ট!" (৬:৩১)  

কিয়ামত বা পুণরুত্থান দিবসে দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা ও আত্মীয়তার বিষয়টি একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। এসবের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মানুষ পুণরুত্থান দিবসে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি ও পুরস্কার প্রদানসহ সার্বিক চিত্র দেখে আল্লাহর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে এবং তখন তারা তাদের ভুলের জন্য আক্ষেপ ও অনুশোচনা করবে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, কিয়ামত বা পুণরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করার কারণে আল্লাহর কোনো ক্ষতি হচ্ছে না বরং যারা অস্বীকার করছে তারাই ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ কিয়ামতকে অস্বীকার করার কারণে তারা বিচার দিবসের জন্য কোনো প্রস্তুতি নেয় না এবং এ কারণে তারা ব্যাপকভাবে পাপাচারে লিপ্ত হয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. যে ব্যক্তি পরকালে বিশ্বাস করে না এবং মৃত্যুকেই জীবনের পরিসমাপ্তি বলে মনে করে,সে ইহকালীন সুখ ও সমৃদ্ধিকেই চূড়ান্ত প্রাপ্তি বলে মনে করে। এর ফলে সে ন্যায়-অন্যায় বিচার না করে পাপাচারে লিপ্ত হয়।

দুই. পুণরুত্থান দিবস হচ্ছে, অনুশোচনা ও অনুতাপের দিন। কিন্তু সেদিন আফসোস ও অনুশোচনা করে কোনো লাভ হবে না। যা করার ইহকালেই করতে হবে। পরকালের জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

সূরা আন’আমের ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَلَلدَّارُ الْآَخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

"পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয় আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আখিরাতের আবাসই শ্রেয়। তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?" (৬:৩২)

এর আগের কয়েকটি আয়াতে বলা হয়েছে, দুনিয়াপূজারি ব্যক্তিরা পার্থিব জীবনের বাইরেও যে পরকালীন জীবন রয়েছে, তা স্বীকার করে না। ওই সব ব্যক্তির এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাসের জবাবে এ আয়াতে বলা হচ্ছে, তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ইহজগত কেন্দ্রীক এবং তারা পূর্ণ বয়স্ক অবস্থাতেও অবুঝ শিশুর মতো আচরণ করছে। যেমন, শিশুরা তার সামনে যা কিছু আছে তার ভিত্তিতেই তার জগতকে চিন্তা করে এবং তারা ভবিষ্যত সম্পর্কে অজ্ঞ। যারা পরকালকে অস্বীকার করে তারা এটা উপলব্ধি করতে পারে না যে, দুনিয়া নয় বরং আখিরাতই মানুষের শ্রেষ্ঠ আবাস।

পরকালীন জীবনের তুলনায় ইহকালীন জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। তবে পবিত্র কুরআন কখনোই ইহকালীন জীবনকে তিরস্কার বা পুরোপুরি অস্বীকার করে না। কারণ ইহজগতের কোন গুরুত্ব না থাকলে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীকে সৃষ্টিই করতেন না। তবে এ কথা ঠিক যে, পরকালে বিশ্বাসী না হলে মানুষের ইহকালীন জীবনের কোনো মূল্য থাকে না। পবিত্র কুরআনেও এ সংক্রান্ত বহু আয়াত রয়েছে। পবিত্র কুরআন পরকালে অবিশ্বাসকে শিশুসুলভ বলে মনে করে।

আসলে পৃথিবী হচ্ছে পরকালীন জীবনের শস্যক্ষেত্র। যারা এ শস্যক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে পরকালীন জীবনের জন্য ফসল ফলাতে পারবে এবং তা নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হতে পারবে, তারাই সফলকাম। আর এই শস্যই হচ্ছে, ভালো বা পুণ্য কাজ। তবে পৃথিবীর জীবনের বাইরে আর কোনো জীবনের অস্তিত্ব নেই,এ ধরনের ভ্রান্ত চিন্তা ও বিশ্বাসের বিপরীতে আরেক দল উগ্র মানুষ আছে,যারা পৃথিবীর জীবনকে একেবারেই মূল্যহীন ও তুচ্ছ বলে প্রচার চালায়। তারা সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্য জীবন বেছে নেয়ার আহ্বান জানায়। তারা বিয়ে করাকেই হারাম বলে ঘোষণা করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গীও সঠিক নয়।

এ ধরনের ব্যক্তিরা এ কথা বুঝতে অক্ষম যে, আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যেসব নেয়ামত দিয়েছেন, তা দিয়েছেন মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষ এসব নেয়ামতকে সঠিক পন্থায় কাজে লাগাবে, আল্লাহতায়ালা সেটাই চান। কাজেই এসব নেয়ামতকে তুচ্ছ ও তাচ্ছিল্য করার অর্থ হলো, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করা।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. আমাদেরকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে, দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত থেকে যেন আমরা আখিরাতকে ভুলে না যাই। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে অনন্তকালীন আখিরাতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার অর্থ হলো, আমরা শিশুসুলভ আচরণ করছি।

দুই. দুনিয়াপূজারি ব্যক্তিদের বিপরীতে ধর্ম, মুমিন ব্যক্তিদেরকে চিন্তা ও গবেষণার প্রতি উৎসাহিত করে, যাতে তারা দুনিয়ার চাকচিক্যের ধোঁকায় পড়ে চূড়ান্ত গন্তব্যের কথা ভুলে না যায়।

তিন. মানুষের বিবেক সবসময় পবিত্রতা ও সংযমের প্রতি আহ্বান জানায়। আর খোদাভীরুতা মানুষের চিন্তা ও চেতনাকে সব ধরনের ভ্রান্ত পথ থেকে দূরে রাখে।