সূরা আন'আম; আয়াত ৫০-৫২ (পর্ব-১২)
সূরা আন’আমের ৫০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلَا تَتَفَكَّرُونَ
"(হে মুহাম্মদ সা.),বলুন ‘আমি তোমাদেরকে এটা বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার রয়েছে,তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয়ে অবগত নই; আর তোমাদেরকে এটাও বলি না যে, আমি ফিরিশতা,আমার প্রতি যে ওহী আসে, আমি শুধু তারই অনুসরণ করি। তাদেরকে বলুন,অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? তোমরা কি চিন্তা করো না।" (৬:৫০)
বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, কেবল সেই-ই রাসূল হতে পারেন, যার হাতে রয়েছে গোটা বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং তিনি যা করতে চাইবেন তাই করতে পারবেন। আর যে তার বিরোধিতা করবে সেই-ই ধ্বংস হবে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, প্রচলিত এ ধারণা সঠিক নয়। এসব রাসূলের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। নবী-রাসূলরা মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানান। তারা মানুষের কাছে ঐশী বার্তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন। আর রাসূল সে ধরনের কোনো ভবিষ্যত বক্তা নন, যেমনটি মানুষ প্রত্যাশা করে। সাধারণ মানুষজন ভাবতো, রাসূল অতীত ও ভবিষ্যত সব বলে দিতে পারবেন। এ ধারণাও সঠিক নয়। এমনকি রাসূল (সা.) কোনো ফেরেশতাও নন যে, তিনি খাদ্য গ্রহণ ও স্ত্রীর প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্ত থাকবেন।
রাসূল (সা.) যেসব মোজেজা ও অলৌককতা দেখিয়েছেন, তার সবই হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছেয়। মানুষ যা চাইবে তা প্রদর্শন করতে এবং সেই কাজ করতে রাসূল বাধ্য নন। আল্লাহতায়ালা এ আয়াতের শেষাংশে মানুষকে বিষ্ময়কর ও চমকপ্রদ কাজ দেখার আশায় বসে না থেকে নিজের কাজ সঠিকভাবে পালন করার এবং চিন্তা-গবেষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ চিন্তাশক্তিকে কাজে না লাগানোর কারণে অনেকেই চোখে দেখার পরও সত্যকে মেনে নিতে পারে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. নবী-রাসূলরা মানুষের কাছে কিছু লুকান না। যদি কোনো বিষয়ে নবী-রাসূলদের ক্ষমতা নাও থাকে সেটাও তারা মানুষকে জানিয়ে দেন।
দুই. চরমপন্থা ও কুসংস্কারের পক্ষে অবস্থান নেয়া যাবে না। কারণ আল্লাহ তা পছন্দ করেন না।
সূরা আন’আমের ৫১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَأَنْذِرْ بِهِ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْ يُحْشَرُوا إِلَى رَبِّهِمْ لَيْسَ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ وَلِيٌّ وَلَا شَفِيعٌ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
"আপনি এর মাধ্যমে তাদেরকে সতর্ক করে দিন,যাতে তারা এ ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কাছে এমন অবস্থায় একত্রিত করা হবে যে,তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত তাদের জন্য কোন অভিভাবক বা সুপারিশকারী থাকবে না। যাতে তারা সাবধান হয়।" (৬:৫১)
এ আয়াতে বলা হচ্ছে, রাসূল (সা.) সব মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান জানানোর পাশাপাশি অন্যায় কাজের পরিণতির বিষয়েও মানুষকে সতর্ক করে দেন। এরপরও সবাই সত্যকে মেনে নেয় না এবং তার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয় না। কেবল তারাই উপদেশ গ্রহণ করে, যারা আগে থেকেই সত্যকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকে। অন্ততঃ যারা বিশ্বাস করে যে, একদিন সব কিছুর হিসাব হবে এবং সবাই তার কাজের জন্য পুরস্কৃত অথবা তিরস্কৃত হবেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. সদয় প্রশিক্ষক এবং উপযুক্ত শিক্ষা-কর্মসূচিই কেবল সৎ পথ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এ জন্য মানুষকেও সত্য অনুসন্ধানী হতে হবে।
দুই. বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস মানুষকে সংযমী ও সতর্ক করে তোলে এবং এ কারণে সে হিসাব-নিকাশ করে সব কাজ পরিচালনা করে।
সূরা আন’আমের ৫২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِمْ مِنْ شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُونَ مِنَ الظَّالِمِينَ
"তাদের বিতাড়িত করো না, যারা প্রভাতে ও সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে তার সন্তুষ্টিলাভের জন্য ডাকে। তাদের কাজের জবাবদিহির দায়িত্ব তোমার নয় এবং তোমার কোন কাজের জবাবদিহির দায়িত্ব তাদের নয় যে, তুমি তাদের বিতাড়িত করবে। করলে তুমি সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।" (৬:৫২)
বিভিন্ন হাদিসে এসেছে, মক্কার মুশরিকদের মধ্য থেকে কিছু ধনী ব্যক্তি রাসূল (সা.)কে এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন আম্মার ইয়াসির ও বেলালের মতো দরিদ্র ব্যক্তিদেরকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেন। আর এমনটি করা হলেই কেবল তারা ঈমান আনবে। মুসলমানদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ ওই প্রস্তাব মেনে নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, এতে মুসলমানরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। আর এরপরই ওই আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহতায়ালা রাসূল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, কখনোই অন্যদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য নিজেদের লোককে দূরে সরিয়ে দেবেন না। এটা এক ধরনের জুলুম-নির্যাতন। ওই আয়াতে সব ধরনের শ্রেণী বৈষম্যের বিরোধিতা করা হয়েছে এবং শ্রেণী বৈষম্যকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের পথে প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করা হয়।
ইসলাম ধর্মে সব মানুষই সমান। কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠতর নয়। অর্থ ও পদমর্যাদার ভিত্তিতে কাউকেই বিশেষ সুবিধা ও ছাড় দেয়া উচিত নয়। সবাই আল্লাহর কাছে তার কাজের হিসেব দেবেন। আল্লাহ মানুষকে যতটুকু সুযোগ-সুবিধা ও জ্ঞান দিয়েছেন তার ভিত্তিতেই তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ কাকে পুরস্কার দেবেন বা আর কাকে শাস্তি দেবেন,তা নির্ভর করছে তার ঈমান ও আমলের ওপর। পৃথিবীর অর্থ-সম্পদ এবং পদমর্যাদা বিচার দিবসে আল্লাহর কাছে গুরুত্ব পাবে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. দরিদ্র ঈমানদার ব্যক্তি, অর্থশালী কাফিরের চেয়েও অনেক ভালো।
দুই. ইসলাম ধর্ম সব ধরনের শ্রেণী ও বর্ণ বৈষম্যের বিরোধী। আল্লাহর কাছে ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, লম্বা-খাটো,এসবের কোনো মূল্য নেই। কে কোন বংশের বা পরিবারের সেটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষের ঈমান ও আমলই হলো তার মর্যাদা ও সম্মানের মাপকাঠি। আল্লাহ মানুষের ঈমান ও কাজের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিন. কে বেহেশতে যাবে আর কে দোজখে যাবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহর। কাজেই এ পৃথিবীতেই কাউকে দোজখী বলে গালি দেয়া উচিত নয়।