সূরা আন'আম;(১৫তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(১৫তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 11:47:20 3-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ৬১-৬৫

সূরা আন’আমের ৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ وَيُرْسِلُ عَلَيْكُمْ حَفَظَةً حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُسُلُنَا وَهُمْ لَا يُفَرِّطُونَ

"তিনি তার নিজ বান্দাদের ওপর পূর্ণমাত্রায় কর্তৃত্বশীল,তিনি তোমাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। অতঃপর তোমাদের কারো যখন মৃত্যু এসে হাজির হয়, তখন প্রেরিত ফেরেশতারা তার জীবনের সমাপ্তি ঘটায়। দায়িত্ব পালনে তারা কোনো ভুল করে না।" (৬:৬১)

এ আয়াতে বলা হচ্ছে, মানুষের সব জীবনাচরণ ফেরেশতাদের মাধ্যমে পরিবীক্ষণ করা হয়। আল্লাহতায়ালাই তাদেরকে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। কোনো কোনো ফেরেশতা মানুষকে দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা করেন এবং আবার কেউ কেউ সেই ব্যক্তির সৎ কাজ ও অসৎ কাজগুলো সারা জীবন ধরে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। মৃত্যুর সময় হলে আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারাই মানুষের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। ফেরেশরাতারা আল্লাহর নির্দেশ পালনে কোনো কালবিলম্ব করেন না। এ আয়াতে আবারও এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, মানুষের সব কিছুর ওপরই আল্লাহর পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে এবং আল্লাহকে মোকাবেলা করার ক্ষমতা মানুষের নেই।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

এক. মানব জাতিসহ সব কিছুর ওপর আল্লাহতায়ালা পূর্ণ কর্তৃত্বশীল। আল্লাহ সদয়, অনুগ্রহশীল ও মহানুভব বলেই তিনি আমাদেরকে মুক্ত ও স্বাধীন রেখেছেন।

দুই. ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশেই বিশ্বজগতের নানা বিষয় দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন।

সূরা আন’আমের ৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

ثُمَّ رُدُّوا إِلَى اللَّهِ مَوْلَاهُمُ الْحَقِّ أَلَا لَهُ الْحُكْمُ وَهُوَ أَسْرَعُ الْحَاسِبِينَ

"অতঃপর তাদের সবাইকে বিচারের জন্য তাদের প্রকৃত মালিক (আল্লাহর) সামনে ফিরিয়ে নেয়া হবে। জেনে রাখো, সমগ্র ক্ষমতা কিন্তু একা তাঁর হাতে। আর তিনি সর্বাপেক্ষা দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।" (৬:৬২)

এ আয়াতে মানুষের ইহকালীন জীবনের পরিসমাপ্তি এবং মৃত্যুর পর আল্লাহর আদালতে তাদেরকে হাজির করার বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষ আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে এবং তাদের আমলনামার ভিত্তিতেই বিচার হবে। মানুষের কৃতকর্মের ভিত্তিতে তাকে বেহেশত অথবা দোজখে পাঠানো হবে। বিভিন্ন হাদিসে এসেছে, আল্লাহতায়ালা সব মানুষের বিচার একইসঙ্গে করবেন। যেমনিভাবে তিনি সব প্রাণীর জন্য একইসঙ্গে খাদ্যের ব্যবস্থা করেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. কেবলমাত্র আল্লাহই মানুষের চূড়ান্ত বিচার করার ক্ষমতা রাখেন। কারণ তিনি হচ্ছেন সবার প্রতিপালক এবং মানুষ হচ্ছে তার বান্দা।

দুই. মানুষের একমাত্র অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন মানুষই অপর মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে না। আল্লাহর অনুমোদনপ্রাপ্ত অভিভাবকদের মধ্যে রয়েছেন, বাবা-মা এবং নবী, রাসূল ও ইমামগণ।

সূরা আন’আমের ৬৩ ও ৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ مَنْ يُنَجِّيكُمْ مِنْ ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ تَدْعُونَهُ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً لَئِنْ أَنْجَانَا مِنْ هَذِهِ لَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ (63) قُلِ اللَّهُ يُنَجِّيكُمْ مِنْهَا وَمِنْ كُلِّ كَرْبٍ ثُمَّ أَنْتُمْ تُشْرِكُونَ

"(হে নবী) আপনি তাদের বলুন,কে তোমাদের রক্ষা করে,যখন তোমরা স্থলভূমিতে বা সাগরের অন্ধকারে বিপদে পড়ে কাতর কণ্ঠে অথবা নীরবে শুধু তাঁর কাছেই মিনতি জানাতে থাকো? তোমরা তো তখন বলো,হে প্রভু! আমাদের যদি তুমি এ বিপদ থেকে বাঁচাও তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ বান্দাদের দলে শামিল হয়ে যাবো।" (৬:৬৩)

"বলুন,আল্লাহই তোমাদেরকে তা থেকে এবং সব ধরনের দুঃখ-কষ্ট থেকে উদ্ধার করেন। এরপরও তোমরা শিরক কর।" (৬:৬৪)

যেহেতু মানুষ অন্ধকারকে ভয় পায় সে কারণে আল্লাহতায়ালা অন্ধকারের উদাহরণ টেনে বলছেন, তোমরা স্থলে বা জলে যেখানেই থাক, সেখানেই মাঝে মধ্যে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ো। চরম ভীতি ও বিপদের মুহূর্তে তোমরা পৃথিবীর আর কোন কিছুর ওপরই নির্ভর করতে পারো না এবং দুনিয়ার কোনো কিছুই তোমাদেরকে রক্ষাও করতে পারে না। সৃষ্টিগত টানেই তোমরা আল্লাহকে ডাকো এবং তার কাছে সাহায্য চাও। কখনো মুখে উচ্চারণ করো, আবার কখনো মনে মনে তা বলো। মাঝে মধ্যে তোমরা এ ওয়াদাও করো যে, বিপদ কেটে গেলে আল্লাহর পথে ফিরে আসবো। কিন্তু বিপদ কেটে যাওয়ার পরও দেখা যায়, মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় এবং আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. মানুষ চূড়ান্ত বিপদের মুখে আল্লাহকে স্মরণ করে। কাজেই দুঃখ-কষ্ট কখনো কখনো মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। অবশ্য অনেকেই বিপদ কেটে যাওয়ার পর আবারও আল্লাহর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

দুই.আল্লাহকে দেয়া প্রতিশ্রুতি মেনে না চলার প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে এবং এটাই হলো সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।

সূরা আন’আমের ৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَى أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِنْ فَوْقِكُمْ أَوْ مِنْ تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُمْ بَأْسَ بَعْضٍ انْظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآَيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ

"আপনি বলুনঃ তিনিই শক্তিমান যে,তোমাদের ওপর কোন শাস্তি উপর দিক থেকে অথবা তোমাদের পদতল থেকে পাঠাবেন অথবা তোমাদেরকে দলে-উপদলে বিভক্ত করে সবাইকে মুখোমুখী করে দেবেন এবং একজনকে অন্যের ওপর আক্রমণের স্বাদ আস্বাদন করাবেন। দেখো, আমি কেমন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিদর্শনাবলী বর্ণনা করি যাতে তারা বুঝে নেয়।" (৬:৬৫)

এর আগের আয়াতে মানুষের প্রতি আল্লাহর ব্যাপক দয়া ও অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে। আর এ আয়াতে আল্লাহর ক্রোধ ও কঠোরতার কথা বলা হচ্ছে। আল্লাহ একইসঙ্গে খুবই দয়ালু ও কঠোর। কেউ যদি আল্লাহর পথে চলে এবং তাকে ডাকে, তাহলে তিনি তাকে দয়া ও অনুগ্রহ করেন। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শিরক করে তাহলে আল্লাহ তার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হন এবং তাকে শাস্তি দেন। একত্ববাদী না হলে মানুষের মধ্যে ঐক্যের অনুভূতি থাকে না এবং সমাজে অনৈক্য ও বিভেদ ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে যুদ্ধ-হানাহানি সমাজকে গ্রাস করে নেয়।

ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। ধনী ব্যক্তিরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মাধ্যমে অধঃস্তন ব্যক্তিদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে থাকে। এ অবস্থায় দরিদ্র ও নির্যাতিতরাও আন্দোলন ও বিদ্রোহের মাধ্যমে ধনীদের ঘুম হারাম করে দেয়। সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। স্বার্থপরতা ও আত্মম্ভরিতার মতো অসৎ গুণাবলী সমাজকে গ্রাস করে। সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার বিষয়ে অজ্ঞতা গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হলে মানুষের অহংকারী হওয়ার কোন কারণ থাকে না।

দুই. শিরক বা অংশীবাদ হচ্ছে অনৈক্য ও বিভেদের নির্দশন, যা সমাজ ব্যবস্থায় বিশৃংখলা সৃষ্টি করে এবং যুদ্ধ ও রক্তাক্ত পরিস্থিতির জন্ম দেয়।