সূরা আন'আম; আয়াত ৪৬-৪৯
সূরা আন’আমের ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَخَذَ اللَّهُ سَمْعَكُمْ وَأَبْصَارَكُمْ وَخَتَمَ عَلَى قُلُوبِكُمْ مَنْ إِلَهٌ غَيْرُ اللَّهِ يَأْتِيكُمْ بِهِ انْظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآَيَاتِ ثُمَّ هُمْ يَصْدِفُونَ
“(হে নবী!) আপনি বলুনঃ তোমরা কি এটা ভেবে দেখেছ, যদি আল্লাহ তোমাদের শোনার ও দেখার ক্ষমতা কেড়ে নেন এবং তোমাদের অন্তরে মোহর এঁটে দেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত ছাড়া উপাস্য কে আছে, যে তোমাদেরকে এসব ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন? দেখ, আমি কিভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বা বিভিন্নভাবে আমার নিদর্শনাবলী বর্ণনা করি। কিন্তু তারা (ঈমান না এনে ও আত্মসমর্পণ না করে) মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।” (৬:৪৬)
পবিত্র কুরআনে নানা প্রশ্ন তুলে ধরে আল্লাহ মুশরিকদের চিন্তা ভাবনা করার উৎসাহ দিয়েছেন যাতে তাদের মানবীয় প্রকৃতি জেগে ওঠে এবং মন-প্রাণ থেকে অজ্ঞতা ও অসচেতনতার পর্দা খুলে যায়। এ আয়াতেও আল্লাহ মানুষকে দেয়া তাঁর নেয়ামতগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন, আল্লাহ যদি তাদের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণ-শক্তি কেড়ে নেন এবং এর ফলে তারা বাস্তবতাকে বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তাহলে তাদের উপাস্য মূর্তিগুলো ও অন্য যাদের তারা শ্রদ্ধা করে তারা কি উপলব্ধি ও চেনার এ দু'টি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম তোমাদের ফিরিয়ে দিতে পারবে? এসব মূর্তিরই তো চোখ ও কান নেই, নেই চেতনা বা আকল। তাই তারা কিভাবে তোমাদেরকে এসব দিতে পারে?
আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, কুরআনে বিভিন্ন পন্থায় নানা দলিল তুলে ধরা হয়েছে, যাতে মুশরিক ও কাফেরদের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হয় এবং সত্যকে মেনে নেয়। কিন্তু অন্ধ-বিদ্বেষ ও গোঁড়ামির কারণে তারা এইসব যুক্তি-প্রমাণকেও উপেক্ষা করছে।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. আল্লাহর দেয়া নেয়ামতগুলোর গুরুত্ব বা মূল্য সম্পর্কে এবং সেগুলোকে হারানোর চিন্তা-ভাবনা করা আল্লাহকে জানার অন্যতম পন্থা।
দুই. সৃষ্টিকূল ও অস্তিত্বের জগতের উৎস হলেন আল্লাহ এবং তিনিই নেয়ামত ও অস্তিত্বগুলোকে টিকিয়ে রাখার মালিক। এইসবের কার্যকারিতা ও প্রভাবেরও মালিক তিনি।
সূরা আন’আমের ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ أَرَأَيْتَكُمْ إِنْ أَتَاكُمْ عَذَابُ اللَّهِ بَغْتَةً أَوْ جَهْرَةً هَلْ يُهْلَكُ إِلَّا الْقَوْمُ الظَّالِمُونَ
"(হে নবী ! ) আপনি বলুন : দেখতো, যদি আল্লাহর শাস্তি, আকস্মিক বা গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে তোমাদের উপর আসে, (তখন তোমরা কি করবে?) তবে জালেম গোষ্ঠী ছাড়া আর কে ধ্বংস হবে?" (৬:৪৭)
আগের আয়াতে আল্লাহ কাফের মুশরিকদের এ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, দেখার ও শোনার ক্ষমতার মত খোদায়ী নেয়ামতগুলো যদি আমি কেড়ে নেই তাহলে তোমরা কিছুই করতে পারবে না। এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ যদি আজাব বা শাস্তি পাঠান তাহলে তা মোকাবেলার বা প্রতিরোধের ও এড়ানোর ক্ষমতা তোমাদের নেই। তাই এখন এটা স্বীকার কর যেসব মূর্তি ও শক্তির প্রেমে মজে আছ তোমরা সেগুলো তোমাদেরকে যেমন কিছুই দিতে পারে না, তেমনি তোমাদের ওপর নেমে আসা কোনো বিপদ বা ক্ষতিও ঠেকাতে পারে না। তাই কেন তাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করছ ও আল্লাহকে ছেড়ে তাদের দ্বারস্থ হচ্ছ? সত্যের ব্যাপারে তোমাদের এ ধরনের গোঁড়া আচরণ এক ধরনের জুলুম। এ জুলুম কেবলই নিজের ওপর নয়, সমাজের ওপরও জুলুম এবং দুনিয়াতেই শাস্তি বা আজাবের ক্ষেত্র তৈরি করে এ ধরনের অনাচার। এভাবে আল্লাহ কাফের ও মুশরিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো থেকে মনে রাখা দরকার:
এক. আজাব নাজেল হওয়ার ক্ষেত্রে খোদায়ী সময়সীমার বিষয়টি যেন আমাদের অসতর্ক বা বেপরোয়া না করে। কারণ, খোদায়ী আজাব হয়ত আকস্মিকভাবে এসে পড়বে।
দুই. গোঁড়া ও একগুঁয়ে স্বভাবের লোকদের কাছে প্রশ্ন আকারে বাস্তবতা তুলে ধরা দাওয়াতের সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি যাতে তারা নিজেরাই চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। এভাবে তাদের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হতে পারে ও তারা সত্যকে মেনে নিতে পারে।
সূরা আন’আমের ৪৮ ও ৪৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ فَمَنْ آَمَنَ وَأَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (48) وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا يَمَسُّهُمُ الْعَذَابُ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ
“আমি পয়গম্বরদেরকে সুসংবাদ দেয়া ও ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে পাঠাইনি, তাই যারা ঈমান আনে বা বিশ্বাসী এবং সংশোধিত হয়, তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।" (৬:৪৮)
"আর যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে, তাদেরকে তাদের নাফরমানীর কারণে আযাব স্পর্শ করবে।” (৬:৪৯)
এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, আমি যুগে যুগে নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছি মানুষদেরকে সতর্ক করতে এবং সুসংবাদ দিতে। অন্য কথায় তাঁদের কাজই ছিল একদিকে মানুষকে চিন্তাগত বিভ্রান্তিসহ ভুল কাজ বা পাপাচার থেকে রক্ষা করা ও পাপের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা। অন্যদিকে সৎ কাজের উৎসাহ দেয়া ও এর খোদায়ী পুরস্কারের তথা চিরস্থায়ী সৌভাগ্য বা মহাসাফল্যের সুসংবাদ দেয়া।
নবী-রাসূলদের প্রচারিত সুসংবাদের কারণেই ঈমানদার ও সৎকর্মশীল মানুষ পার্থিব দুঃখ-বেদনা ও ভয়কে দূরে সরিয়ে রেখে দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক প্রতিকূলতাগুলোসহ মানব সমাজের প্রভুত্বকামী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছেন। এক্ষেত্রে তারা দূর্বল-চিত্ত ও ভীরু হননি।
অথচ পার্থিব সম্পদের ক্ষয়িষ্ণুতা বা অস্থায়ীত্ব দুনিয়া-পূজারি ব্যক্তিদেরকে পার্থিব স্বার্থ হারানোর ভয়ে সব সময়ই ভীত-সন্ত্রস্ত রাখে এবং এ ধরনের সম্পদের হানি ঘটলে তারা গভীর দুঃখ ও বেদনার শিকার হন।
খোদাদ্রোহী শক্তি বা কাফেররা ঈমান ও সৎকাজের প্রতিদান তথা বেহেশত ও পরকালীন সৌভাগ্যে বিশ্বাসী নয়। তারা পরকালীন কঠোর শাস্তিতেও বিশ্বাসী নয় বলে সব সময় দুর্নীতি ও পাপাচারে ডুবে থাকে। ফলে তারা দুনিয়াতেই প্রকাশ্য ও গোপন শাস্তির শিকার হয়। আর পরকালেও কঠোর শাস্তির শিকার হবে তারা।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হল:
এক. মানুষকে জোর করে সত্যের পথে আনা নবী-রাসূলদের দায়িত্ব নয়। বরং শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করা ও ঈমানের সুফল বা পুরস্কারের সংবাদ তুলে ধরে মানুষকে পথ-প্রদর্শন করাই তাদের দায়িত্ব।
দুই. ভয় ও আশা শিক্ষণ বা প্রশিক্ষণের ভিত্তি হওয়া উচিত যাতে মানুষ হতাশ কিংবা বেপরোয়া না হয়ে পড়ে।
তিন. সৎকাজ বা নেক আমল ছাড়া শুধু ঈমান অকার্যকর এবং ঈমানবিহীন সৎকাজও মূল্যহীন।
চার. ঈমান মানসিক সুস্থতার চাবিকাঠি। ভয় ও দুঃখ আধুনিক যুগেও সবচেয়ে বড় মানসিক রোগ বা অশান্তি হিসেবে বিবেচিত। এসব রোগ বা অশান্তির মূল কারণ হল আল্লাহ এবং ঈমান থেকে দূরে থাকা।