সূরা আন'আম;(৮ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(৮ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 12:32:24 3-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ৩৩-৩৬

আন’আমের ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُونَ فَإِنَّهُمْ لَا يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِينَ بِآَيَاتِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ (33) وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا وَلَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَبَإِ الْمُرْسَلِينَ

"আমি অবশ্যই জানি যে তারা যা বলে তা আপনাকে কষ্ট দেয়। (মূলতঃ) তারা তো আপনাকে প্রত্যাখ্যান করছে না বরং জালিমরা আল্লাহর আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করছে।" (৬:৩৩)

"আপনার আগেও তো রাসূলদের ওপর মিথ্যা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো;কিন্তু তারা তা সহ্য করেছেন যতক্ষন না আমার সাহায্য তাদের কাছে এসেছিল। কেউ আল্লাহর বাণী পরিবর্তন করতে পারে না। রাসূলদের বিষয়ে কিছু সংবাদ তো আপনার কাছে এসেছে।" (৬:৩৪)

রাসূল (সা.) সব সময় যৌক্তিক বক্তব্য ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে মুশরিকদেরকে সৎ পথের দিকে আহ্বান করেছেন। কিন্তু তারা তা গ্রহণতো করেইনা বরং জেদ ও হিংসার কারণে রাসূলকে উপহাস করেছে। বিশ্বনবী (সা.) তাদের এ ধরনের আচরণে দুঃখ পেতেন ও মনক্ষুন্ন হতেন। এ কারণে আল্লাহতায়ালা রাসূলকে পবিত্র কুরআনে বহুবার সাত্ত্বনা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, তারা আপনাকে প্রত্যাখ্যান করলেও আপনি মন খারাপ করবেন না। কারণ তারা স্বয়ং আল্লাহ ও তার আয়াতকেও প্রত্যাখ্যান করছে। এ ছাড়া, এটা এমন নয় যে তারা শুধু আপনাকেই প্রত্যাখ্যান করছে বরং এর আগেও কাফেররা নবী-রাসূলদের প্রত্যাখ্যান করেছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে নবী-রাসূলরা ধর্মবিরোধীদের মাধ্যমে নির্যাতিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এটি ধর্মবিরোধীদের স্বভাব। এর বিপরীতে আল্লাহর নীতি হলো, সৎ পথ অবলম্বনকারীদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা দেয়া। তবে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য কেবল ততক্ষণ পর্যন্তই অব্যাহত থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদাররা  কাজ-কর্মসহ সব ক্ষেত্রে আল্লাহর কর্তৃত্বকে মেনে চলবে এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস হারাবে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক.মহান আল্লাহর বাণী ও সত্যকে প্রত্যাখ্যানের ফলে সৃষ্টিকর্তার কোনো ক্ষতি হয় না বরং এর মাধ্যমে কাফিররা নিজেই নিজেদের ওপর জুলুম করে। কারণ তারা চূড়ান্ত কল্যাণ থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করছে।

দুই.সত্যের পথ কখনোই মসৃন ছিল না। অতীতেও নবী-রাসূলরা ঐশী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে যেয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন।

তিন.ঐশী ব্যক্তিত্বদের কখনোই এটা আশা করা উচিত নয় যে, পৃথিবী বা সমাজের সব মানুষই তাদের কথা শুনে সেভাবে পথ চলবে।

সূরা আন’আমের ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ إِعْرَاضُهُمْ فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَبْتَغِيَ نَفَقًا فِي الْأَرْضِ أَوْ سُلَّمًا فِي السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُمْ بِآَيَةٍ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدَى فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْجَاهِلِينَ

"যদি তাদের বিমুখতা আপনার কাছে কষ্টকর হয় (এবং ধৈর্য ধরতে না পারেন) তবে পারলে ভূগর্ভে সুড়ঙ্গ অথবা আকাশে কোনো সিড়ি খুঁজে বের করুন যেন তাদের কাছে (প্রদর্শনের জন্য) কোন নিদর্শন (মুজিজা) আনতে পারেন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের সবাইকে (বাধ্য করে) সৎপথে একত্রিত করতে পারতেন। সুতরাং আপনি নির্বোধদের অন্তর্ভূক্ত হবেন না।" (৬:৩৫)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় আল্লাহতায়ালা এ আয়াতে রাসূল (সা.)কে উদ্দেশ্য করে বলছেন, তারা ঈমান আনেনি বলে আপনি এটা ভাববেন না যে, আপনার শিক্ষা দেয়ায় ত্রুটি রয়েছে অথবা আপনি ভুল করছেন। এটাও মনে করবেন না যে, আপনি যে প্রক্রিয়ায় মানুষকে সত্যের পথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, সেটা ত্রুটিপূর্ণ। বরং তারাই ভুলের মধ্যে রয়েছে, যারা সত্যকে মানতে চায় না। আপনিও তাদেরকে সৎপথে আসতে বাধ্য করতে পারবেন না। কারণ আল্লাহই এমনটি চাননি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তাহলে সব মানুষই সত্যের মোকাবেলায় নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হতো। কিন্তু আল্লাহতায়ালা মানুষকে নিজের পথ নিজেকেই নির্বাচনের ক্ষমতা দিয়েছে। এ আয়াতের ধারাবাহিকতায় বলা হচ্ছে, তাড়াহুড়ো করে আল্লাহর বাণীকে অস্বীকার করার অর্থ হলো, তারা আল্লাহর নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানে না। আল্লাহতায়ালা রাসূল (সা.)কে নির্বোধদের মতো তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করেছেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৎপথে চলার সুযোগ দিয়েছেন এবং তিনি চান, সব মানুষই সৎপথে পরিচালিত হোক। কিন্তু আল্লাহ এটাও চান যে, মানুষ স্বাধীন থাকবে এবং তারা নিজের ইচ্ছায় সত্যকে মেনে নেবে।

দুই. যারা শুধুই অজুহাত খুঁজে বেড়ায় তাদের দাবি মেনে নেয়াটা নির্বুদ্ধিতা আর কিছুই নয়। কারণ তারা কোনো ভাবেই সত্যকে মেনে নেবে না।

সূরা আন’আমের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّمَا يَسْتَجِيبُ الَّذِينَ يَسْمَعُونَ وَالْمَوْتَى يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ ثُمَّ إِلَيْهِ يُرْجَعُونَ

"হে রাসূল! যারা (সরল মনে) (মুহাম্মদ সা. দাওয়াত) শুনে, শুধু তারাই আহ্বানে সাড়া দেয়। আর আল্লাহ মৃতদের (অর্থাৎ কাফিরদের) পুনর্জীবিত করবেন,এরপর তারই দিকে তাদের ফিরিয়ে আনা হবে।" (৬: ৩৬)

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে, যারা সত্যের বাণীকে শুনে না তাদেরকে বধির এবং যারা সত্যের বাণী শুনেও প্রভাবিত হয় না তাদেরকে মৃত মানুষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কারণ শ্রবণশক্তি থাকার পরও যারা সত্যকে শুনতে আগ্রহী নয়, তারা সেই সব লোকের মতো যাদের কান নেই এবং কথা শুনতে পায় না। যেমনিভাবে, যাদের বিবেক ও মন আছে কিন্তু তাদের ওপর সত্যের বাণী প্রভাব ফেলে না,তারা যেন মরেই গেছে। কারণ তারা উপলব্ধি ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এসব ব্যক্তিরা পুণরুত্থান দিবসের নানা দৃশ্য দেখে বিভ্রান্তির ঘুম থেকে জেগে ওঠবে এবং ঈমান আনবে। কিন্তু সেদিন ঈমান এনে কী লাভ হবে? কারণ এ ধরনের ঈমান আনার কোনো মূল্য নেই।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. একগুঁয়ে ও হিংসুটে কাফেররা কেবল মৃত্যুর পরই নিজেদের ভুল স্বীকার করে। কিন্তু সে সময় ভুল বুঝে কোনো লাভ হবে না। যা করার এই পৃথিবীতেই করতে হবে।

দুই. যদি খাওয়া আর ঘুমানোই হয় জীবন, তাহলে পশু-পাখির সঙ্গে মানুষের কোনো পার্থক্য থাকে না। মানুষের ঈমান কতটুকু সুদৃঢ়, সেটাই সবচেয়ে বড় বিষয়।

তিন. যারা ঈমান এনেছেন তাদের প্রতি আমাদের সহযোগিতা ও দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। তবে যেসব কাফেররা সত্যকে মেনে নেয় না, তাদের হিসাব-নিকাশ হবে আল্লাহর সঙ্গে। ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করার বিষয়ে তাদের ওপর জোর-জবরদস্তি করার কোনো প্রয়োজন নেই।