সূরা আন'আম;(৩৩তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(৩৩তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 12:1:51 3-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ১৪১-১৪৪

সূরা আন'আমের ১৪১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَهُوَ الَّذِي أَنْشَأَ جَنَّاتٍ مَعْرُوشَاتٍ وَغَيْرَ مَعْرُوشَاتٍ وَالنَّخْلَ وَالزَّرْعَ مُخْتَلِفًا أُكُلُهُ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ كُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآَتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ

"তিনিই উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন- যা মাচার উপর তুলে দেয়া হয় এবং যা মাচার উপর তোলা হয় না। এবং খেজুর গাছ ও শস্যক্ষেত্র এবং জয়তুন ও আনার সৃষ্টি করেছেন। (এসব ফলের কোনো কোনোটি) একটি অন্যটির মতো এবং (কোনো কোনোটি) সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এসব গাছ ফলবতী হলে এগুলোর ফল খাও ও ফসল তোলার সময় (বঞ্চিতদের) অধিকার প্রদান কর এবং অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি অপব্যয়কারীদের পছন্দ করেন না।" (৬:১৪১)

গত আসরে আমরা বলেছি, মক্কার মুশরিকরা তাদের চতুষ্পদ জন্তুর একাংশকে তাদের উপাসনার মূর্তিগুলোর সামনে কুরবানি দিত। এ ছাড়া, এর কিছু অংশ রেখে দিত আল্লাহর জন্য। অন্ধ কুসংস্কার ও বেদআতের অনুসরণ করতে গিয়ে তারা এ ঘৃণ্য কাজগুলো করতো। সে আলোচনার ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ বঞ্চিত ও এতিমদের দান করার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা শুধু চতুষ্পদ জন্তুর ভাগ নয় বরং ক্ষেতের ফসল ও ফলের বাগান থেকে উতপাদিত পণ্যেও দুঃস্থ মানুষের অধিকার রয়েছে। শস্য ঘরে তোলার সময় এর একটি অংশ আলাদা করে দুঃস্থদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে।

অবশ্য মক্কার মুশরিকদের একটি অংশ যেমন তাদের ফসলের বিন্দুমাত্র গরীব-দুঃখীদের দিত না, তেমনটি আরেকটি দল ছিল যারা নিজেদের জন্য কিছু না রেখে উতপাদিত শস্যের পুরোটাই বঞ্চিত ও এতিমদের মধ্যে বিলিয়ে দিত। এ কাজটি আল্লাহকে খুশি করার জন্য করা হলেও পবিত্র কুরআনে একে অপচয় হিসেবে উল্লেখ করে তা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, ইসলাম মধ্যপন্থা ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের নির্দেশ দেয়। দুঃস্থ মানুষকে অবজ্ঞা করারও যেমন সুযোগ নেই তেমনি নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন উপেক্ষা করে সবকিছু দান করে দিতেও ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। এ বিষয়ে সূরা ফুরকানের ৬৭ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে : “এবং তারা ব্যয় করার সময় অপচয় বা কার্পণ্য করে না, বরং এ দু’য়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন করে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :

এক.  একই মাটি ও পানি থেকে নানা প্রজাতির শস্য ও ফল-মূল উতপাদন মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার পরিচায়ক।

দুই.  শস্য বেড়ে ওঠার জন্য যে পানি, মাটি, আলো ও অক্সিজেন প্রয়োজন হয় তা আল্লাহরই দান। কাজেই আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা যে ফসল পাই তার একটি অংশ গরীবদের দান করা উচিত। এক্ষেত্রে কার্পণ্য করার অর্থ আল্লাহর অনুগ্রহকে অস্বীকার করা।

সূরা আন’আমের ১৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمِنَ الْأَنْعَامِ حَمُولَةً وَفَرْشًا كُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ

"তিনি বোঝা বহনকারী এবং বোঝা বহনে অক্ষম খর্বাকৃতি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তা থেকে খাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।" (৬:১৪২)

এ আয়াতে বলা হচ্ছে, মানুষের চোখে দৃশ্যমান সব বস্তু ও প্রাণী আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। প্রাণহীন মাটি থেকে উতসারিত গাছপালা ও লতাগুল্ম এবং ছোট-বড় সব ধরনের উপকারী প্রাণী- এসবই আল্লাহর দান। মুশরিকরা যে মূর্তির পুজা করে তার পক্ষে এর কোনোটি সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। কাজেই মূর্তির জন্য কোনকিছু উতসর্গ করার অধিকার মানুষের নেই। একমাত্র মহান আল্লাহ ঘোড়া ও উটের মতো বন্য প্রাণীকে ভার বহনের জন্য তোমাদের পোষ মানিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া, ভেড়া ও ছাগলের মতো ছোট পশুকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা এগুলোর গোশত খেতে ও চামড়া ব্যবহার করতে পারো।

এ আয়াতেও পশুর গোশত ব্যবহারের ক্ষেত্রে উগ্রপন্থা অবলম্বন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে বলা হয়েছে : তোমরা সেসব মুশরিকদের মতো হয়ো না যারা তাদের পশুর একটি অংশের গোশত খাওয়াকে নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। সেইসঙ্গে তাদের মতোও আচরণ করো না যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে হালাল ও হারাম- এ দুই ধরনের পশুরই গোশত ভক্ষণ করে। তোমরা হারাম জন্তুর গোশত থেকে দূরে থাকবে এবং শয়তানের ধোঁকায় প্রভাবিত হবে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :

এক. ইসলামে নিরামিষভোজী হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আল্লাহর দেয়া নেয়ামত অর্থাত হালাল পশুর গোশত খেতে হবে।

দুই. খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে হালাল-হারাম মেনে চলতে হবে। কারণ, আদিপিতা হযরত আদম (আ.)কে শয়তান নিষিদ্ধ ফল খাইয়ে পথভ্রষ্ট করেছিল।

সূরা আন’আমের ১৪৩ ও ১৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

  ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ مِنَ الضَّأْنِ اثْنَيْنِ وَمِنَ الْمَعْزِ اثْنَيْنِ قُلْ آَلذَّكَرَيْنِ حَرَّمَ أَمِ الْأُنْثَيَيْنِ أَمَّا اشْتَمَلَتْ عَلَيْهِ أَرْحَامُ الْأُنْثَيَيْنِ نَبِّئُونِي بِعِلْمٍ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (143) وَمِنَ الْإِبِلِ اثْنَيْنِ وَمِنَ الْبَقَرِ اثْنَيْنِ قُلْ آَلذَّكَرَيْنِ حَرَّمَ أَمِ الْأُنْثَيَيْنِ أَمَّا اشْتَمَلَتْ عَلَيْهِ أَرْحَامُ الْأُنْثَيَيْنِ أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ وَصَّاكُمُ اللَّهُ بِهَذَا فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا لِيُضِلَّ النَّاسَ بِغَيْرِ عِلْمٍ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

"(মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য হালাল করেছেন) আটটি মর্দা ও মাদী জন্তু। ভেড়ার মধ্যে দুই প্রকার ও ছাগলের মধ্যে দুই প্রকার। (হে রাসুল, যারা কোন কোন চতুষ্পদ জন্তুকে নিজেদের জন্য হারাম করে নিয়েছে, তাদের) জিজ্ঞেস করুন, তিনি কি উভয় মর্দা কিংবা উভয় মাদি হারাম করেছেন? নাকি যা উভয় মাদীর পেটে আছে? তোমরা আমাকে প্রমাণসহ বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।" (৬:১৪৩)

"এবং (তিনি তোমাদের জন্য হালাল করেছেন) উটের মধ্যে দুই প্রকার এবং গরুর মধ্যে দুই প্রকার। (তারপরও আপনি তাদের) জিজ্ঞেস করুন : তিনি কি উভয় মর্দা হারাম করেছেন, না উভয় মাদীকে? নাকি যা উভয় মাদীর পেটে আছে? তোমরা কি উপস্থিত ছিলে, যখন আল্লাহ এ নির্দেশ দিয়েছিলেন? কাজেই সে ব্যক্তি অপেক্ষা বেশি অত্যাচারি কে, যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা পোষণ করে যাতে করে মানুষকে বিনা প্রমাণে পথভ্রষ্ট করতে পারে? নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।" (৬:১৪৪)

আগের আয়াতে আমরা দেখেছি, মহান আল্লাহ হালাল পশুর গোশত ও চামড়া ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। সেইসঙ্গে পশুর গোশত ব্যবহারের ক্ষেত্রে সব ধরনের কুসংস্কার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এ আয়াতে পশুর নাম উল্লেখ করে তাদের ব্যাপারে মুশরিকদের ভ্রান্ত ধারণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।  মহান আল্লাহ মানুষের জন্য আট জোড়া পশুর কথা উল্লেখ করেছেন। দুম্বা, ছাগল, উট ও গরু-এই চার ধরনের প্রাণীর মর্দা ও মাদী মিলিয়ে মোট আট জোড়া প্রাণীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কার মুশরিকরা এসব প্রাণীর কোনো কোনোটির মর্দা এবং কোনো কোনোটির মাদি প্রজাতিকে নিজেদের জন্য হারাম করে নিয়েছিল বলে এ আয়াতে তাদের উভয় প্রজাতির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন, মর্দা ও মাদি উভয় প্রজাতির গোশত তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে।

আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হচ্ছে : মুশরিকরা যে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করছে তা আল্লাহর দিক-নির্দেশনার চরম লঙ্ঘন এবং তার প্রতি এক ধরনের অবিচার। এ ধরনের আচরণের ফলে মানুষ চিরতরে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। যারা এ ধরনের জঘন্য রীতি চালু করেছে, এর কঠোর পরিণতির জন্যও তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. কোন কিছু খাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদেরকে হালাল-হারাম মেনে চলতে হবে। যেসব বস্তু ও প্রাণী মানুষের জন্য ক্ষতিকর তাদের নাম ধরে ধরে তা খেতে নিষেধ করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ।

দুই. আলেমদের দায়িত্ব হচ্ছে ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের মূলোতপাটন করা এবং ইসলামের সঠিক চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরা।

তিন. যে কোন বিশ্বাস ও রীতিনীতি যুক্তি-বুদ্ধি ও জ্ঞানসম্মত হওয়া উচিত। কুসংস্কার ও গোঁড়ামির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক রীতিনীতি মানুষকে চিরতরে পথভ্রষ্ট করে দিতে পারে।