সূরা আন'আম; আয়াত ১৫০-১৫২
সূরা আন'আমের ১৫০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قُلْ هَلُمَّ شُهَدَاءَكُمُ الَّذِينَ يَشْهَدُونَ أَنَّ اللَّهَ حَرَّمَ هَذَا فَإِنْ شَهِدُوا فَلَا تَشْهَدْ مَعَهُمْ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآَخِرَةِ وَهُمْ بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ
“(হে নবী! যারা কোনো কোনো পশু নিজেদের জন্য হারাম ঘোষণা করেছে) তাদের আপনি বলুনঃ তোমাদের সাক্ষীদের আন, যারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তা’আলা এগুলো হারাম করেছেন। যদি তারা (মিথ্যা) সাক্ষ্য দেয়, তবে আপনি এ সাক্ষ্য মানবেন না এবং তাদের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না, যারা আমার নির্দেশাবলীকে মিথ্যা বলে, যারা পরকালে বিশ্বাস করে না এবং যারা স্বীয় প্রতিপালকের সমতুল্য অংশীদার করে।” (৬:১৫০)
অতীতে আমরা বলেছি, মুশরিকরা কোনো কোনো বিষয়কে নিজেদের পক্ষ থেকে হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল, কিন্তু তারা একে খোদার নির্দেশ বলে প্রচার করত। এইসব কুপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দায়িত্ব দেন বিশ্বনবী (সা.)-কে। এ আয়াতে আল্লাহ তাঁকে বলছেন, হে নবী! আপনি তাদেরকে এ ব্যাপারে সাক্ষ্য আনতে বলুন, যদিও তাদের কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই, তা সত্ত্বেও তারা যদি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তাহলে এই সাক্ষ্যকে আপনি মেনে নেবেন না এবং নিজ ধর্মের দিকে তাদেরকে আকৃষ্ট করার আশায় তাদের সঙ্গে সুর মেলাবেন না। কারণ, তারা কখনও আপনার এবং কুরাআনের প্রতি ঈমান আনবে না। আপনি কখনও ভাববেন না যে কোনো কোনো বিষয়ে যদি তাদের সঙ্গে একমত হন তাহলে তারাও আপনার কথা মানবে ও ঈমান আনবে।
এ আয়াতের শিক্ষা হল:
এক. ইসলাম যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ধর্ম। কুসংস্কারের কোনো স্থান ইসলামে নেই। তাই এ ধর্ম তার বিরোধীদেরকেও যুক্তি-প্রমাণ দেখাতে বলে।
দুই. মানুষের আইন অনেক ক্ষেত্রেই খেয়ালীপনা থেকে উৎসারিত ও অবাস্তব। তাই সেগুলো মুমিনের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। মুমিন শুধু আল্লাহর আইনই মেনে চলেন।
সূরা আন’আমের ১৫১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
“(হে নবী!) আপনি মুশরিকদের বলুনঃ এস, আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শোনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন। এগুলো হল, আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করো, নিজ সন্তানদেরকে দারিদ্রের ভয়ে হত্যা করো না, আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই, নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন তাকে হত্যা করো না; কিন্তু ন্যায়ভাবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এসব নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুদ্ধি খাটাও (ও সত্যকে মেনে নাও)।” (৬:১৫১)
মুশরিকদের কুসংস্কারগুলোর অসারতা তুলে ধরার পর এ আয়াতে আল্লাহ এই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলো সব খোদায়ী ধর্মেই অভিন্ন। নিষিদ্ধ বিষয়গুলো কেবল ইসলামেই এসেছে এমন নয়। আল্লাহ বলছেন, নিষিদ্ধ হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হচ্ছে আল্লাহর আল্লাহর অংশীদার ঠিক করা। মুশরিকরা এ রোগেই আক্রান্ত। তারা ভেবেছে যে কোনো কোনো বিষয় নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ করার কারণে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন। অথচ এসব কাজ যে সবচেয়ে বড় পাপ তা তারা নিজেরাও জানে না। তারা কখনও কখনও অভাবের ভয়সহ নানা অজুহাতে নিজ সন্তানদের হত্যা করে ও দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর আশায় মূর্তির জন্য সন্তান বলি দেয়। মূর্তি নয়, বরং আমিই মানুষ ও তার সন্তানের রিজিকদাতা। মুশরিকরা প্রকাশ্যে ও গোপনে মাঝে মধ্যেই খুবই অশালীন কাজ করে। তারা নিজেরাও জানে সেগুলো কতটা কদর্য! তারা তুচ্ছ ও খুব সামান্য বিষয় নিয়ে পরষ্পর যুদ্ধ ও রক্তপাত করে। ফলে নিহত হয় বহু মানুষ। অথচ আল্লাহ অশ্লীল কাজ ও অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ বলছেন, মুশরিকদের এসব কাজ যে খুবই নোংরা ও নিকৃষ্ট তা একটু চিন্তা করলে তারাই বুঝতে সক্ষম হবে ও এসব কাজ করা থেকে বিরত থাকবে। অথচ আল্লাহ নিজেই যখন এসব কাজ না করতে মুশরিকদের সতর্ক করছেন তখন তাদের উচিত এসব নিষেধাজ্ঞাকে আরো গুরুত্ব দেয়া এবং নিষিদ্ধ কাজগুলো বর্জন করা।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হল:
এক. শির্ক সব ধরনের অনাচার ও দুর্নীতির উৎস। তাই নিষিদ্ধ কাজের তালিকার শীর্ষে রয়েছে শির্ক। আর বাবা-মায়ের যত্ন নেয়া বা তাদের সেবা করা সবচেয়ে ভাল কাজ। তাই একত্ববাদের পরই বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচারের কথা এসেছে।
দুই. কোনো কোনো পাপ এত বিপজ্জনক যে, সেগুলোয় জড়িত হওয়া তো দূরের কথা, সেগুলোর কাছাকাছি হওয়াও ঠিক নয়।
তিন. গর্ভপাত জাহেলি বা অজ্ঞতার যুগের নিদর্শন। আজ পাশ্চাত্যে এই কুপ্রথা ক্রমেই বিস্তৃত ও জোরদার হচ্ছে।
চার.খোদায়ী বিধি-বিধান মানবীয় বিবেক ও প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই এবং এসব বিধান মানবীয় গুণ ও বিবেককে সমৃদ্ধ করে।
সূরা আন’আমের ১৫২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى وَبِعَهْدِ اللَّهِ أَوْفُوا ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
“এতীমদের ধনসম্পদের কাছেও যেও না (তা আত্মসাত করা তো দূরে থাক); কিন্তু উত্তম পন্থায় (বা যা এতীমের জন্য কল্যাণকর সেরকম পন্থায় তার সম্পদের দেখা-শুনা কর) যে পর্যন্ত সে বয়ঃপ্রাপ্ত না হয়। ওজন ও মাপে সততা রাখবে। আমি কাউকে সাধ্যাতীত দায়িত্ব বা কাজ দেই না। যখন তোমরা কথা বল ( বিচার ও সাক্ষ্য দেয়াসহ সব সময়ই ), তখন সুবিচার কর, যদি (তাতে তোমার ক্ষতিও হয় বা ) সে আত্নীয়ও হয়। আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (৬:১৫২)
আগের আয়াতে কিছু কিছু নিষিদ্ধ বা হারাম কাজের তালিকা তুলে ধরার পর এ আয়াতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় কাজের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন, সমাজে এতীমদের সম্পদ যেন কারো লালসার শিকার না হয়, বরং সবচেয়ে ভাল পন্থায় এতীমের সম্পদ রক্ষা ও দেখা-শোনা করতে হবে। আর তারা যখন প্রাপ্ত বয়স্ক বা নিজের সম্পদ রক্ষার মত বয়সে উপনীত হবে তখনই মূল মালিক হিসেবে তাদের কাছে সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। অবশ্য এতীমের সম্পদকে লুণ্ঠণ বা গ্রাসের হাত থেকে রক্ষার জন্য দখল করা বৈধ যাতে তা যথাসময়ে এতীমের হাতেই দেয়া যায়।
এ আয়াতের শিক্ষা হল:
এক. আল্লাহ সব কাজই সর্বোত্তম পন্থায় সম্পন্ন করেন। তিনি চান মানুষও নিজের ও অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন করুক। তিনি সাধ্য অনুযায়ী দায়িত্ব দেন।
দুই. ন্যায়বিচারই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হওয়া উচিত, পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা ও সম্পদ বৃদ্ধি নয়।
তিন. কথা, কাজ ও আচরণে ন্যায় বিচার রক্ষা করা ইসলামের অন্যতম প্রধান বিধান। ঘনিষ্ঠতা বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের চেয়ে সত্য ও ন্যায়বিচারকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।