সূরা আন'আম; আয়াত ১০৭-১১০
সূরা আন’আমের ১০৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكُوا وَمَا جَعَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا وَمَا أَنْتَ عَلَيْهِمْ بِوَكِيلٍ
"যদি আল্লাহ চাইতেন (সব মানুষই ঈমান আনতে বাধ্য হত) তবে তারা শেরক করত না (কিন্তু এটা আল্লাহর বিধান নয়)। আমি আপনাকে তাদের সংরক্ষক করিনি এবং আপনি তাদের অভিভাবক নন।" (৬:১০৭)
আগের আয়াতে বিপুল সংখ্যক মানুষের শির্ক সম্পর্কে আলোচনার পর এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, তারা আল্লাহর কর্তৃত্বের আওতামুক্ত হয়ে গেছে-এমনটি যেন কেউ না ভাবে, বরং আল্লাহ যদি চাইতেন তবে এমন ব্যবস্থা নিতেন যে কেউই অংশীবাদী বা মুশরিক হত না। কিন্তু আল্লাহ চান মানুষ নিজেই নিজের পথ বেছে নেবে। তাই মহান আল্লাহ বিশ্বনবী (সা.)-কে বলছেন, এমনকি আপনিও কাউকে ঈমান আনতে বাধ্য করার অধিকার রাখেন না এবং আপনি জনগণের অভিভাবক নন। অন্য কথায় আল্লাহ আদেশ-নির্দেশের বা আইনি দিক থেকে চান সবাই ঈমান আনুক এবং এ জন্যই তিনি নবী-রাসূল পাঠিয়েছিলেন। অন্যদিকে আল্লাহ বিশ্বজনীন প্রকৃতিগত ব্যবস্থা অনুযায়ী চেয়েছেন মানুষ স্বেচ্ছায় বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে নিজের পথ নিজেই বেছে নিক এবং ধর্ম মত গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা যাবে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি দিক হল:
এক.খোদায়ী ইচ্ছা অনুযায়ী মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কাফের ও মুশরিকদের অস্তিত্বই মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রমাণ।
দুই. ধর্ম প্রচারক ও নবী-রাসূলদের দায়িত্ব হল মানুষকে সতর্ক করা ও উপদেশ দেয়া, ধর্ম গ্রহণের জন্য মানুষকে বাধ্য করা তাঁদের দায়িত্ব নয়।
সূরা আন’আমের ১০৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ كَذَلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ مَرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না,যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। তাহলে তারাও শত্রুতা করে ও অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহকে মন্দ বলবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাদের কাজ কর্ম সুশোভিত করে দিয়েছি। অতঃপর স্বীয় পালনকর্তার কাছে তাদেরকে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তাদেরকে বলে দেবেন যা কিছু তারা করত।” (৬:১০৮)
কাফের-মুশরিকদের জোর করে ধর্মের পথে আনতে নবী-রাসূল ও মুমিনরা সচেষ্ট নন- আগের আয়াতে এই বক্তব্য তুলে ধরার পর এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, কাফের-মুশরিকদেরকে কোনোভাবে উত্যক্তও করা যাবে না, তাদেরকে গালি-গালাজ করাও নিষিদ্ধ। মুশরিক ও তাদের উপাস্যদের গালি দেয়া হলে তারাও প্রতিশোধ হিসেবে তোমাদের প্রভু বা সত্যিকারের স্রস্টাকে গালি দেবে। তোমাদের পক্ষে যখন যুক্তি রয়েছে তখন কেন তোমরা অশালীন ভাষার আশ্রয় নেবে? বরং তোমাদের উচিত কাফের-মুশরিকদের কাছে সত্যের পক্ষের যুক্তিগুলো তুলে ধরা। তারা যদি গ্রহণ করে তাহলে তো ভাল কথা, আর যদি তোমাদের যুক্তি গ্রহণ না করে তাহলে তোমরা সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করলে এবং এরপর তোমাদের করণীয় আর কিছু নেই।
আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ বলছেন, সব সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীই নিজ নিজ বিশ্বাসের প্রতি প্রবল টান অনুভব করে। নিজেদের কাজকর্মও সব গোষ্ঠীর কাছেই সুশোভিত মনে হয়। কিন্তু কিয়ামত বা বিচার দিবসেই বাস্তবতা বা সত্য স্পষ্ট হবে। সেদিন মহান আল্লাহ সব গোষ্ঠীকেই তাদের ততপরতা সম্পর্কে অবহিত করবেন। সেদিন মানব-গোষ্ঠীগুলো বুঝতে পারবে যে তারা সঠিক কাজ করেছে না ভুল করেছে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু'টি দিক হল:
এক. বিরোধীদের সঙ্গে আমাদের আচরণের প্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে তা লক্ষ্য করা উচিত। কখনও বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া এমন ধরনের যে, আমাদের উচিত নীরব থাকা।
দুই. অভিশাপ ও সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া এবং গালিগালাজ করা এক নয়। কুরআনে উল্লিখিত ‘বারাআত’ বা কাফের-মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা বলতে কুফর, জুলুম ও শির্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া বা এসবের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশকে বোঝায়।
সূরা আন’আমের ১০৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَأَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ لَئِنْ جَاءَتْهُمْ آَيَةٌ لَيُؤْمِنُنَّ بِهَا قُلْ إِنَّمَا الْآَيَاتُ عِنْدَ اللَّهِ وَمَا يُشْعِرُكُمْ أَنَّهَا إِذَا جَاءَتْ لَا يُؤْمِنُونَ
“তারা সবচেয়ে জোরালোভাবে আল্লাহর কসম খায় যে,যদি তাদের কাছে কোন অলৌকিক নিদর্শন আসে, তবে অবশ্যই তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে। আপনি বলে দিনঃ অলৌকিক নিদর্শনাবলী তো কেবল আল্লাহর কাছেই আছে (এবং তা আল্লাহর হাতেই রয়েছে)। হে মুসলমানগণ, তোমাদেরকে কে বলল যে, যখন তাদের কাছে অলৌকিক নিদর্শনাবলী আসবে, তখন তারা বিশ্বাস স্থাপন করবেই ?”(৬:১০৯)
এ আয়াতে মহান আল্লাহ বিশ্বনবী (সা.)-কে বলছেন, আপনি কাফেরদের বলুন, অলৌকিক বিষয় বা মোজেজা তো আমার নিয়ন্ত্রিত বিষয় নয় যে, যখনই তোমরা যা কিছু চাইবে তখনই আমি তোমাদের তা এনে দেব। বরং এ ধরনের বিষয় আল্লাহই নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি যখন মোজেজা দেখানোর দরকার মন করবেন তখনই তা দেখানো হবে। মহান আল্লাহ ও তাঁর ধর্ম বা সত্যকে তুলে ধরার সর্বশেষ প্রমাণ হিসেবেই মোজেজা দেখানো হয়ে থাকে। জনগণের খেয়াল-খুশি বা কল্পনা-বিলাসকে পরিতৃপ্ত করার জন্য মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনা দেখানো হয় না। এটাও মনে রাখা দরকার, মানুষের বহু দাবি বা আকাঙ্ক্ষা অন্যায্য ও অসঙ্গত। যেমন, কাফেরদের কেউ কেউ আল্লাহকে দেখতে চায়, ঠিক যেভাবে চোখ দিয়ে দেখা যায় কোনো বস্তুকে! অস্তিত্বের জগত মুশরিকদের খেলার সামগ্রী নয় যে তাদের অন্যায় দাবিগুলো মেনে নিতে হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হয়েছে-
এক. খোদাদ্রোহী মহলের মিথ্যাবাদীরা যত কঠিন শপথই করুক না কেন তা তাদের কথায় বিশ্বাস করা উচিত নয়।
দুই. কুফরির মূল উৎস হল, অন্ধ-বিদ্বেষ ও গোড়ামী। তাই কাফেররা সব ধরনের অলৌকিক নিদর্শন বা মোজেজা দেখার পরও সত্যকে মেনে নিতে রাজি হয় না।
সূরা আন’আমের ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَنُقَلِّبُ أَفْئِدَتَهُمْ وَأَبْصَارَهُمْ كَمَا لَمْ يُؤْمِنُوا بِهِ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَنَذَرُهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ
“আমি ঘুরিয়ে দেব তাদের অন্তর ও দৃষ্টিকে, যেমনিভাবে তারা এর প্রতি প্রথমবার বিশ্বাস স্থাপন করেনি এবং আমি তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার মাধ্যমে উদভ্রান্ত করে রাখব।” (৬:১১০)
গোঁড়ামি ও সত্যকে অস্বীকারের প্রবণতা তথা কুফরি ধীরে ধীরে সত্যকে দেখার, শোনার ও বোঝার ক্ষমতা বিলুপ্ত করে দেয়। ফলে এ ধরনের মানুষ সত্যকে মিথ্যা মনে করে এবং মিথ্যাকে মনে করে সত্য। কুরআন বলছে, সত্যকে অস্বীকারকারীরা বিভ্রান্তির ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খেতেই থাকবে-এটাই খোদায়ী রীতি। কারণ, তাদের দৃষ্টি সব কিছুকেই উল্টা দেখে এবং তারা সৃষ্টির লক্ষ্য উপলব্ধি করতে পারে না।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
এক. আল্লাহ ও রাসূল (সা.)’র প্রতি ঈমান আনার জন্য সুস্থ, খেয়ালীপনামুক্ত ও গোড়ামীমুক্ত পবিত্র অন্তর থাকা জরুরি।
দুই. আল্লাহ ও তাঁর পথ থেকে দূরে থাকা মানুষকে ইহকালেই অনুশোচনা করতে হবে এবং বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে হবে।