সূরা আন নিসা; (১৭তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন নিসা; (১৭তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 16:7:40 3-10-1403

সূরা আন নিসা; আয়াত ৬০-৬৩

সূরা নিসার ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا ((৬০

"আপনি কি তাদের লক্ষ্য করেননি, যারা দাবি করে যে, আপনার ওপর ও আপনার আগে যে সব ধর্মীয়গ্রন্থ নাজিল হয়েছে,তাতে তারা বিশ্বাস করে অথচ তারা খোদাদ্রোহী জালেম শাসক, মূর্তি বা শয়তানের কাছে বিচার প্রার্থী হয়; যদিও এদেরকে প্রত্যাখ্যান করতে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।"(৪:৬০)

সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে মুসলমানদের মধ্যে যে কোন বিরোধ মীমাংসার জন্য পবিত্র কোরআনে ও রাসূলের শরণাপন্ন হতে বলা হয়েছে৷ আর এই আয়াতে আল্লাহ অসৎ ব্যক্তি এবং জালেম শাসকদের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে নিষেধ করেছেন এবং একে পথভ্রষ্টতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এ ব্যাপারে ইতিহাসের বর্ণনায় এসেছে- মদীনায় কোন এক ইহুদী ও এক মুসলমানের মধ্যে কোন ব্যাপারে বিরোধ দেখা দিলে ওই ইহুদী মহানবী (সা.)'র বিশ্বস্ততা এবং আমানতদারীর জন্য তাঁকে বিচারক করার পরামর্শ দেয়৷ কিন্তু মুসলমান ব্যক্তিটি তার অবৈধ স্বার্থ পূরণের জন্য এক ইহুদী পণ্ডিতকে বিচারক মানার দাবি জানায়৷ কারণ ওই মুসলমান লোকটি জানতো ইহুদী পণ্ডিতকে ঘুষ দিয়ে বিচারের রায় তার পক্ষে আনা সম্ভব ৷ এ আয়াতে এ ধরনের জঘন্য মনোভাবের নিন্দা করা হয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : তাগুতি শক্তি ও মিথ্যা আদর্শের অনুসারীদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা ছাড়া ঈমানের দাবি করা হলে তা প্রকৃত ঈমান নয়, বরং তা হলো অন্তসারশূন্য ঈমান৷

দ্বিতীয়ত : যারা ঈমান আনার দাবি করে অথচ বাস্তবে খোদাদ্রোহী শক্তি, জালেম ও শয়তানদের সহযোগী হয়, তারা আসলে আল্লাহ এবং তাঁর নবীর বিরুদ্ধেই জোটবদ্ধ হয়েছে৷

তৃতীয়ত : খোদাদ্রোহী ও ধর্ম বিরোধী শক্তি কিংবা ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন শাসন ব্যবস্থা মেনে নেয়ার অর্থ হলো সমাজে শয়তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়া৷ উল্লেখ্য, বর্তমান যুগেও মুসলমানদের বিরোধ মীমাংসার জন্য পবিত্র কোরআন ও মহানবীর আদর্শই হল মানদন্ড৷

সূরা নিসার ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا ((৬১

"যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তার দিকে এবং রাসূলের দিকে এসো,তখন আপনি মোনাফিকদের দেখবেন, তারা আপনার আআহ্বান মেনে নিতে সম্পূর্ণ বিমুখ।" (৪:৬১)

এই আয়াতে বিধর্মীদেরকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়াকে কপটতা বা মোনাফেকীর লক্ষণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ একইসঙ্গে এটাও বলা হয়েছে, মোনাফেকরাই আল্লাহর কিতাব ও মহানবীর আদর্শ বা সুন্নাত থেকে দূরে সরে যায় এবং কাফেরদের মতামতই তাদের কাছে ভালো লাগে৷ আসলে এইসব লোকেরা নিজেরাও আল্লাহর বিধান থেকে দূরে থাকে এবং অন্যদেরকেও আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে পথভ্রষ্ট করে৷ কেউ যেন তাদের বিরোধীতা করতে না পারে সে জন্যেই তারা অন্যদেরও পথভ্রষ্ট বা বিভ্রান্ত করার কাজে ব্যস্ত থাকে৷

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা আমাদের সবারই কর্তব্য৷ এমনকি বহু মানুষ এই আহ্বান গ্রহণ করবে না, বা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করবে না এটা জানা সত্ত্বেও আমাদেরকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে৷

দ্বিতীয়ত : সত্য ধর্মের আআহ্বান উপেক্ষা করা বা প্রকৃত ইসলামী নেতৃত্বের বিরোধীতা করা মোনাফেকদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য৷

সূরা নিসার ৬২ ও ৬৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা'লা বলেছেন,

فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَاءُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا (৬২) أُولَئِكَ الَّذِينَ يَعْلَمُ اللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُلْ لَهُمْ فِي أَنْفُسِهِمْ قَوْلًا بَلِيغًا ((৬৩

"তাদের কাজ কর্মের জন্য যখন কোন বিপদ তাদের ওপর নেমে আসবে তখন তাদের কি অবস্থা হবে? এরপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করে আপনার কাছে এসে খোদাদ্রোহীদের কাছে বিচারপ্রার্থী হবার ব্যাপারে বলবে আমরা কল্যাণ ও সম্রীখোতি ছাড়া কিছুই কামনা করিনি৷ অর্থাৎ আমরা দু'পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছি!" (৪:৬২)

"কিন্তু তাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা জানেন ৷ তাই হে নবী, আপনি তাদের শাস্তি দেয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করুন,তাদের উপদেশ দিন এবং তাদের কাজের পরিণতির কথা স্পষ্টভাবে বলে দিন৷" (৪:৬৩)

আগের আয়াতে আল্লাহ এবং রাসূলের পরিবর্তে বিধর্মী ও খোদাদ্রোহীদের কাছে বিচার প্রার্থী মোনাফিকদের কথা উল্লেখের পর এ আয়াতে তাদেরকে দৈহিক শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে উপদেশ দিতে এবং তাদের মন্দ কাজের পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করতে বলা হয়েছে৷ আল্লাহই তাদেরকে শাস্তি দেয়ার বিষয়টি দেখবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ মোনাফিকরা যুক্তি দেখাতো যে, কোন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মহানবীর কাছে যাওয়া হলে তিনি নিশ্চয়ই দু'পক্ষের কোন এক পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করবেন৷ আর এতে ওই পক্ষ মহানবী (সা.)'র প্রতি অসন্তষ্ট হবে! এটা নাকি মহানবীর সম্মানের জন্য শোভনীয় নয়৷ তাই মোনাফেকরা বলতো আমরা মহানবীর জনপ্রিয়তা রক্ষার স্বার্থেই বিচার কাজের জন্য তাঁর কাছে যাইনি৷ এটা স্পষ্ট যে, এ ধরনের অজুহাত দায়িত্ব থেকে পলায়ন ছাড়া অন্য কিছু নয়৷ মহানবী (সা.)-এর মর্যাদা যদি এভাবেই রক্ষার দরকার হত তাহলে আল্লাহই তার নির্দেশ দিতেন৷ কারণ, তিনিই বেশী জানেন ও বোঝেন৷

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : ব্যক্তি ও সমাজের অধিকাংশ সমস্যা মানুষেরই কাজের ফল৷ মানুষ এইসব সমস্যার কারণ সম্পর্কে হয় অজ্ঞ অথবা এইসব সমস্যার কারণ জানার চেষ্টাও করে না৷

দ্বিতীয়ত : অজুহাত দেখানো মোনাফেকদের কাজ৷ মোনাফেকরা মহানবী (সা.)'র অবস্থান বা সম্মান রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে মহানবী (সা.)কে দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়েছিল৷

তৃতীয়ত : মিথ্যাবাদী ও মোনাফেকরা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য বা তৎপরতা ধামাচাপা দেয়ার জন্যেই কসম খেয়ে থাকে৷