সূরা আন নিসা; (৫ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন নিসা; (৫ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 16:34:39 3-10-1403

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৫-১৮

সূরা আন নিসার ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَاللَّاتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِنْ نِسَائِكُمْ فَاسْتَشْهِدُوا عَلَيْهِنَّ أَرْبَعَةً مِنْكُمْ فَإِنْ شَهِدُوا فَأَمْسِكُوهُنَّ فِي الْبُيُوتِ حَتَّى يَتَوَفَّاهُنَّ الْمَوْتُ أَوْ يَجْعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلًا(১৫)

"তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যাভিচার করে,তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চারজন সাক্ষী তলব করবে,যদি তারা সাক্ষ্য দেয়,তবে তাদেরকে গৃহে অবরুদ্ধ করবে,যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু হয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য কোন ব্যবস্থা না করেন।" (৪:১৫)

আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম, সূরা নিসার প্রথম কয়েকটি আয়াত পরিবার সম্পর্কিত। যেসব নারী ও পুরুষ পারিবারিক পবিত্রতা লংঘনের মত অবৈধ ও নোংরা কাজে লিপ্ত হয় আজকের আলোচনায় তাদের শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হবে। সূরা নিসার ১৫ নম্বর আয়াতে স্বামীর সঙ্গে ঘর সংসার করছেন এমন মহিলারা যদি পর-পুরুষের সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত হন,তাহলে তাদের শাস্তি কি হবে,তা উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য এটাও জানা জরুরী যে,ইসলাম পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে অন্যদের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি নিষিদ্ধ করেছে। অন্যদের অবৈধ কাজ প্রমাণ করতেও ইসলাম উৎসাহ দেয় না। তাই তিন জন ন্যায়পরায়ন ব্যক্তিও যদি কোন বিবাহিতা মহিলার ব্যাভিচারের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অবশ্য একসঙ্গে চার জন ন্যায়পরায়ন ব্যক্তি এ ধরনের সাক্ষ্য দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। আর এ ক্ষেত্রে বিবাহিতা ব্যাভিচারী মহিলার শাস্তির যে বিধান দেয়া হয়েছে,তা অস্থায়ী বিধান অর্থাৎ মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে স্বামীর ঘরে বন্দী রাখতে হবে। পরিবারের মান মর্যাদা রক্ষার জন্যেই আল্লাহ এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে অসামাজিক কাজে লিপ্ত মানুষেরা এক জায়গায় সমবেত হয়ে একে অন্যের কাছে খারাপ কাজের বিভিন্ন পদ্ধতি ছড়িয়ে না দেয়। যেমন,আজকাল আমরা দেখছি গণ কারাগারগুলো অবৈধ তৎপরতা শিক্ষার কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। অবশ্য পরে বিবাহিত ব্যাভিচারীদের শাস্তির চূড়ান্ত বিধান তথা পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান আসার পর যাবজ্জীবন গৃহবন্দীত্বের দণ্ড পাওয়া বিবাহিত মহিলারা মুক্তি লাভ করেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : মুমিনদের সম্মান রক্ষা তার রক্তের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তাই হত্যাকারী প্রমাণের জন্য দুইজন সাক্ষী প্রয়োজন হলেও ব্যাভিচারী প্রমাণের জন্য চারজন সাক্ষী প্রয়োজন। নিঃসন্দেহে ব্যাভিচার খুবই নোংরা কাজ, কিন্তু ব্যাভিচারীর সম্মান ক্ষুন্ন করার পদক্ষেপ আরো নিকৃষ্ট কাজ।

দ্বিতীয়ত : ইসলাম পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সমাজ ও পরিবারে সংঘটিত অপরাধের কঠিন শাস্তির নির্দেশ দিয়েছে। ব্যাভিচারীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া এ ধরনের একটি শাস্তি।

সূরা নিসার ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَاللَّذَانِ يَأْتِيَانِهَا مِنْكُمْ فَآَذُوهُمَا فَإِنْ تَابَا وَأَصْلَحَا فَأَعْرِضُوا عَنْهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ تَوَّابًا رَحِيمًا (১৬)

"আর তোমাদের মধ্যে যে দুজন ব্যাভিচারে লিপ্ত হবে, তাদের উভয়কেই শাস্তি প্রদান কর। কিন্তু তারা যদি তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়,তবে তাদের রেহাই দেবে,আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়।" (৪:১৬)

অনেকের মতে, এই আয়াতের অর্থ সবার জন্য প্রযোজ্য এবং যে পুরুষ ব্যাভিচার করবে তা কোন নারীর সঙ্গেই হোক বা পুরুষের সঙ্গেই হোক তারা উভয় শাস্তির যোগ্য হবে। কিন্তু অধিকাংশ তাফসীরকারকদের মতে, এখানে অবিবাহিত নারী ও পুরুষ ব্যাভিচারীর কথা বলা হয়েছে। আর তাদের শাস্তি হলো,বেত্রাঘাত। কিন্তু আদালতে তাদের অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এ শাস্তি কার্যকর করা যাবে না। আর ব্যাভিচারী নারী ও পুরুষ যদি তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়,তাহলে তাদেরকে অবশ্যই ক্ষমা করতে হবে এবং তাদের বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আল্লাহও ক্ষমাশীল এবং দয়ালু। তিনি প্রকৃত তওবা বা ক্ষমা প্রার্থনা কবুল করেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : ইসলামী সমাজে কোন অপরাধীকে প্রশ্রয় বা নিরাপত্তা দেয়া উচিত নয়। বরং অপরাধীকে তাদের অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব।

দ্বিতীয়ত : অপরাধীদের জন্য সংশোধন ও ক্ষমার পথ বন্ধ করে দেয়া উচিত নয়। যারা আসলেই অনুতপ্ত ও লজ্জিত তাদেরকে সমাজে পুনর্বাসন করতে হবে।

সূরা নিসার ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولَئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا (১৭) وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآَنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا (১৮)

"আল্লাহ অবশ্যই সেইসব লোকের ক্ষমা গ্রহণ করবেন, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে এবং খুব দ্রুত তওবা করে। এরাই তারা যাদেরকে আল্লাহ পুণরায় দয়া করবেন এবং তাদের তওবা কবুল করবেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।" (৪:১৭)

"তওবা তাদের জন্য নয়, যারা আজীবন মন্দ কাজ করে এবং মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলেই বলে আমি এখন তওবা করছি। তওবা তাদের জন্যেও নয়, যাদের মৃত্যু হয় অবিশ্বাসী অবস্থায়,এরাই তারা, যাদের জন্য আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি।" (৪:১৮)

আগের আয়াতে ব্যাভিচারীদের ক্ষমার সম্ভাবনার কথা উল্লেখের পর এ আয়াতে তওবা কবুল শর্ত ও সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তওবা কবুলের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো,যে গোনাহ করা হয়েছে তা ভুলবশত করা হয়েছে এবং পাপের পরিণতির কথা চিন্তা না করেই নিতান্ত প্রবৃত্তির তাড়নায় তা করা হয়েছে অর্থাৎ অভ্যাসের প্রভাবে বা পাপের কদর্যতাকে গুরুত্বহীন ভেবে ঐ গোনাহ বা ব্যাভিচার করা হয়নি। তওবা কবুলের দ্বিতীয় শর্ত হলো,গোনাহর কদর্যতার কথা মনে আসার সাথে সাথেই অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে। তওবাকে পিছিয়ে রেখে গোনাহর পুনরাবৃত্তি করলে এবং জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গোনাহ করার কোন সুযোগ না থাকায় তওবা করলে তা কবুল হবে না। কারণ তওবা কবুলের শর্ত হলো সংশোধন করা। শেষ বয়সে সংশোধনের সম্ভাবনা থাকে না। তওবা পিছিয়ে দেয়া হলে গোনাহ অভ্যাসের অংশ হয়ে যায় এবং এ ধরনের মানুষ আর তওবার সুযোগই পায় না। এরা মুখে মুখে তওবা করলেও তাদের অন্তর গোনাহ বা পাপাচারে অভ্যস্ত হয়ে যায় বলে সুপথে ফেরার উপায় থাকে না ।

এ আয়াতে শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : আল্লাহ পাপীদের প্রকৃত তওবা কবুল করাকে নিজের জন্য জরুরী বলে উল্লেখ করেছেন । তাই আমরা যতক্ষণ জীবিত আছি, ততক্ষণ এই সুযোগ ব্যবহার করা উচিত ।

দ্বিতীয়ত : যে মানুষ নিজের কূপ্রবৃত্তির তাড়না দমন রাখতে পারে না, সে জ্ঞানী হলেও বাস্তবে জাহেল ।

তৃতীয়ত : তওবা কবুলের প্রধান চাবি হলো, দ্রুত পাপ কাজ বন্ধ করে তওবা করা। কারণ গোনাহর পরিমাণ বেশি না হওয়া পর্যন্ত তওবা করা সহজ ।

চতুর্থত : বিপথ বা মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে তওবা করলে তার কোন মূল্য নেই। সাধারণ ও মুক্ত অবস্থায় করা তওবাই প্রকৃত তওবা।